বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘জামায়াতে ইসলামী’কে নিয়ে আলোচনা যেন কোন ভাবেই থামছে না। এদেশের ডানপন্থীয় রাজনৈতিক দলগুলোও জামায়াতকে সাথে চেয়েছে কিংবা কেউ আবার জামায়াতকে সাথে নিয়ে সরকারও গঠন করেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৯৬ সালের মিত্র আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ শুরু করে । ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত পাকিস্তানে সেই সংগঠনের উত্থান-পতন নিয়ে একাডেমিক গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব মুয়েনস্টার’র পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো ড. মুজতবা ইসানী। রাজনৈতিক হিংসা বা অন্ধ পক্ষপাতের বাইরে ইসলামী রাজনীতির এই ধারাটিকে নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা খুব একটা চোখে পড়ে না। ‘ভার্জিনিয়া রিভিউ অব এশিয়ান স্টাডিজ’এ প্রকাশিত লেখাটি জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, হাসান ইকবাল। তিন পর্বে সমাপ্ত লেখাটির আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।
ভূমিকা
মউদুদী সাহেবকে বলতে শোনা গেছে, “ঐতিহাসিকেরা যখন জামায়াত সম্পর্কে লিখবে তখন তারা বলবে জামায়াত সেইসব তাজদীদ আন্দোলনের একটি যেগুলোর উত্থান আগেও হয়েছে এবং পতনও হয়েছে।” প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়েও দলটি এখনো সমুদ্রের তীরেই অবস্থান করছে। এর সাফল্যের মধ্যে বলতে গেলে কেবল উল্লেখ করা যাবে সরকারি জুলুম-নির্যাতনের মাঝেও টিকে থাকা এবং দেশের নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব বিস্তার, তবে পরিপূর্ণরূপে ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে পাকিস্তানের ক্ষমতারোহণে তারা সর্বোতভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মাওলানা মউদুদী’র অনবদ্য এই সৃষ্টি, জামায়াতে ইসলামী, ছিল একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু এটি যেমন ব্যর্থ হয়েছে তাদের লক্ষ্য অর্জনে, তেমনি ব্যর্থ হয়েছে মাওলানার প্রদত্ত পরিকল্পনা অনুসরণ করতে। জামায়াতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাওলানা মউদুদী অনেক ইতিহাস গড়েছেন যা ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদকে একটা কাঠামো দিয়েছে। তিনি প্রায় ১২০টির মতো বই লিখেছেন, হাজারের উপর বক্তৃতা দিয়েছেন এবং রচনা করেছেন তাফহীমুল কোরান— যাকে বলা যায় কোরানের কার্যকরি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। তিনি যে ধ্যান-ধারণাগুলো দিয়েছেন তা সারা বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দকে প্রভাবিত করেছে। ইতিহাসবিদ ফিলিপ জেনকিন্স গবেষণা করে দেখেছেন যে সাইয়েদ কুতুব এবং হাসানুল বান্নার মতো নেতৃবৃন্দ মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডে মউদুদীর মতবাদগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন। ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি, যার সাথে মউদুদীর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল, নিজে মউদুদীর অনেক কাজ ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ফিলিস্তিনের একজন বিচারক আবদুল্লাহ আজ্জাম যিনি ওসামা বিন লাদেনের একজন শিক্ষক ছিলেন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের যুদ্ধের পক্ষে দাড় করানো জন্য ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন, তিনিও মউদুদীর ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত ছিলেন। জামায়াতের ব্যর্থতা এখানে আরো ব্যাপক এজন্য যে, এটা ঘটছে পাকিস্তানে— যেখানে ইসলাম জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। যদিও অশিক্ষিত সাধারণ গেঁয়ো মানুষের ইসলাম এবং শিক্ষিত, শহুরে, অধার্মিক মানুষের ইসলামে বিস্তর ফাঁক; তবুও বলা যায় জনজীবনে ইসলামের একটা সাধারণ প্রভাব ভালোভাবেই চোখে পরে। তারপরও কেন জামায়াতের এই অবস্থা? তারা কোন পন্থায় সরকার এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইসলামীকরণ করতে চায়? সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা তাদের নীতিতে অটল থাকতে পেরেছে কি? পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারের সাথে তাদের বোঝাপড়া বা সম্পর্ক কেমন ছিল এবং এগুলোর পরিণাম কি? জামায়াতকে কি একটি সামাজিক আন্দোলন বলা যায়? সামাজিক আন্দোলন তত্ত্ব কি জামায়াতের ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করতে পারে?
এখানে আমরা উপরোক্ত প্রশ্নগুলোরই উত্তর দেবার চেষ্টা করবো, তবে প্রথমত আমাদের দেখতে হবে জামায়াতের ভাবধারা এবং দলটির প্রথমদিকের কর্মপন্থা; দ্বিতীয়ত, আমরা বিশ্লেষণ করবো সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বটি কি এবং তা দিয়ে কিভাবে জামায়াতের কর্মপন্থাকে বিশ্লেষণ করা যায়; তৃতীয়ত, আমরা দেখবো ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের সাথে জামায়াতের সম্পর্কের ধরণ; চতুর্থত, সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বটি দিয়ে আমরা জামায়াতের ব্যর্থতাকে ব্যাখ্যা করবো। অর্থাৎ, এই গবেষণাপত্রের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের আলোকে ১৯৪১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত জামায়াতের কার্যক্রমের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ। এই গবেষণাপত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে অধ্যাপক খুরশীদ আহমেদ কর্তৃক মাওলানা মউদুদীর কাজের ইংরেজি অনুবাদ; রেজা নাসের, আসাদ জিলানী, খুররম মুরাদ, ও খুরশীদ আহমেদ রচিত মউদুদীর জীবনী; ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল (১৯৪১-’৮৮ তে এটিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন); ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৭৩ এর সংবিধান; ১৯৪৯ এর প্রস্তাবনা; এবং জামায়াতের উপর রচিত বিভিন্ন বই।
মউদুদী প্রদত্ত মূল রূপরেখা (মাস্টার ফ্রেম)
জামায়াতের আদর্শের ভিত্তি হচ্ছে ইসলামের সার্বজনীনতা এবং সমাজ সংস্কারে ইসলামের পুনরুজ্জীবনের ধারণা, বা তাজদীদ। মউদুদীর নিজের ভাষায় ইসলাম হচ্ছে, “একটি সার্বজনীন, পরিপূর্ণ, এবং সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা যা সকল প্রশ্নের সঙ্গতিপূর্ণ উত্তর দিতে পারে। এর মূল আকিদা বা বিশ্বাস হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ। এর কাম্য জীবনধারা হচ্ছে শরিয়াহ; যা বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর ভিত্তিতেই রচিত হবে নৈতিকতা, সামাজিকতা, রাজনীতি, ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ হবে সেই সমাজ যেখানে মানুষ অন্যসকল ধ্যান-ধারণা ও ভক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে আল্লাহ-তে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে। এমন সমাজই পরিপূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারে” (মউদুদী ১৯৬০, ৫)। মউদুদী যুক্তি দিয়েছেনে যে, ইসলামি রাষ্ট্র মানুষের দ্বারা শাসিত নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার আইন দ্বারা শাসিত যেখানে মানুষ কেবল আল্লাহ’র প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সুতরাং রাষ্ট্রের এমন কোন আইন প্রণয়নের সুযোগ নেই যা কোরান ও সুন্নাহ’র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মউদুদীর কাছে মানব ইতিহাস হচ্ছে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের মাঝে সংঘর্ষের ইতিহাস। তার ভাষায় জাহিলিয়াত হচ্ছে, “সে সকল মতবাদ যেগুলো স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে এবং স্রষ্টার কর্তৃত্বকে অবজ্ঞা করে” (মউদুদী ১৯৭৬, ১০)। তিনি ইসলামের অবনতি পর্যবেক্ষণ করেছেন শুধু পাকিস্তানে নয়, সারা বিশ্বে। ইসলামের ইতিহাসের পর্যালোচনায় তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সংগ্রাম এবং সংস্কারবাদী আন্দোলনের ইতিহাস। বিশেষ করে তিনি মনে করেন, খেলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্ব চরম নেতৃত্ব সংকটে পড়ার সুযোগে বিভিন্ন জাহেলি মতবাদ সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। তাই তার কাছে সেই সময়টা ছিল তাজদীদ-এর। এখানে তাজদীদ হচ্ছে, “ইসলামকে অকৃত্রিমরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং সময়-কালের বিচারে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সমাজ-সংস্কার” (মউদুদী ১৯৬০, দ্র: ১২)। এখন তাজদিদ বাস্তবায়নে দরকার একটি দল বা গোষ্ঠী— এটিই ছিল জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠায় মাওলানা মউদুদীর মূল লক্ষ্য। বলাবাহুল্য যে, তাজদীদ-এর জন্য একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারকও দরকার যিনি কাঙ্খিত সংস্কার সাধনে নেতৃত্ব দেবেন।
মউদুদীর দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামী কেবল ভারতের মুসলমানদের একটি সংগঠন ছিল না, এটাকে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির কল্যাণ ও মুক্তির আন্দোলন হিসেবে তিনি দেখতেন। তিনি মনে করতেন ইসলামের পরিপূর্ণ চর্চা খুব ‘স্বাভাবিকভাবে’ সকলকে আকর্ষণ করবে এবং সকল মুসলমান হয় এমন একটি কাল্পনিক ইসলামী রাজ্যে এসে বসবাস শুরু করবে, নতুবা তারা যে সমাজে বাস করছে সেখানে ইসলামের আলোকে পরিবর্তন সাধন করবে। এভাবেই তিনি উপমহাদেশে তাজদীদ আন্দোলনের সূচনা করেন এবং সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেন।
তো কিভাবে চলবে এই সমাজ সংস্কারের কাজ? মউদুদী তার “ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি” বইটিতে এর একটি পরিকল্পনা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) এর সমাজ সংস্কারের পদ্ধতিকে আদর্শ ধরে মউদুদী তিন-পর্যায়ভিত্তিক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। প্রথমত, শক্ত ভিত্তিতে মজবুত কাঠামো তৈরির জন্য রাসুল (সা.) মানুষকে প্রথমে বিশ্বাসের পথে ডেকেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের সংঘবদ্ধ করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন এবং সমাজে ভালো কাজকে উৎসাহিত করা এবং মন্দকে নিরুৎসাহিত করার সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। তৃতীয়ত, অর্থাৎ চুড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হয় মদীনায় যেখানে ইসলামকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম এমন প্রায় ৪০০ প্রশিক্ষিত ও সত্যনিষ্ঠ কর্মীকে একটি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় এনে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সমাজ গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁরা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার এমন উজ্জল একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যে মাত্র আট বছরে পুরো আরব ইসলামের এই বিপ্লবী ডাকে সাড়া দেয়।
এই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ইসলামের বিপ্লবী আহবানে সাড়া দানকারীদের প্রথমে ঐক্যবদ্ধ করবে, অতঃপর তাদের আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে তারা সঠিকরূপে ইসলামকে জানবে ও শিখবে। মউদুদী প্রথমে গুরুত্ব দিয়েছেন জ্ঞানী, সুসংহত, এবং নিবেদিত – এমন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরির যারা উত্তম চরিত্র এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে নেতৃত্বে এগিয়ে আসবেন। এরপর সময় আসবে পরিপূর্ণ আন্দোলনে যাবার – তখন ইসলামী ভাবধারা ও মূল্যবোধের আলোকে পুনঃনির্মিত হবে সমাজ ও জীবন ব্যবস্থা। সমাজ পুনঃনির্মানের এই কর্মসূচী হবে সমন্বিত এবং সামগ্রিক যা ব্যক্তির সর্বান্তকরণে পরিবর্তন আনবে। এমন কৌশলে কাজটি করতে হবে যেন প্রতিটি এলাকায় এমন একদল সৎ ও ধার্মিক মানুষ তৈরি হয় যারা এমন অবস্থানে থাকবেন যে সমাজে সংঘটিত খারাপ কাজগুলোকে তারা বন্ধ করে দিতে পারেন এবং সাধারণ মানুষকে সততা ও ধার্মিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এর ফলশ্রুতিতে দেশের সর্বত্র মন্দকে পরিহার করে ইসলামের সেবায় একটি ন্যায়-নীতি ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রবল জনসমর্থন তৈরি হবে। কেবল এই শর্তগুলো পূরণ হবার পরই জামায়াত রাষ্ট্রের ক্ষমতা অধিগ্রহনের চেষ্টা করতে পারে। মউদুদীর দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামী কেবল ভারতের মুসলমানদের একটি সংগঠন ছিল না, এটাকে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির কল্যাণ ও মুক্তির আন্দোলন হিসেবে তিনি দেখতেন। তিনি মনে করতেন ইসলামের পরিপূর্ণ চর্চা খুব ‘স্বাভাবিকভাবে’ সকলকে আকর্ষণ করবে এবং সকল মুসলমান হয় এমন একটি কাল্পনিক ইসলামী রাজ্যে এসে বসবাস শুরু করবে, নতুবা তারা যে সমাজে বাস করছে সেখানে ইসলামের আলোকে পরিবর্তন সাধন করবে। এভাবেই তিনি উপমহাদেশে তাজদীদ আন্দোলনের সূচনা করেন এবং সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেন।
তবে সেই সময়ে পাকিস্তানের বড় বড় আলেমগণ বিশ্বাসীদের আরেকটি নতুন দল তৈরির জন্য মউদুদীর সমালোচনা করেছেন (নাসের ১৯৯৬, ১১০)। বিশেষ করে দেওবন্দি, বেরেলভি, আহলে হাদীস অন্তর্ভূক্ত আলেমরা মউদুদীর বেশি সমালোচনা করেছেন। ঐসকল সম্প্রদায়ের কিছু তরুণ আলেম মওদুদীর আন্দোলনে যোগদান করলেও প্রথিতযশা আলেমরা, যেমন: মানাযির আহসান জিলানি, আবদুল মজিদ দারিয়াবাদি, হুসেইন আহমেদ মাদানি, সাব্বির উসমান প্রমুখ কখনই মউদুদী’র মতবাদকে সমর্থন দেননি (নাসের ১৯৯৬, ১১৫)। তাদের মতে মউদুদী ‘তাজদীদ’-এর ধারণাকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং ইসলামের পুনরুজ্জীবনের চাইতে নিজেকে ‘মুজাদ্দিদ’ রূপে দাখিল করাই ছিল তার মূল চেষ্টা। তাদের মতে ‘তাজদীদ’ ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট না। যেহেতু বেশিরভাগ আলেম সেই সময়ে মউদুদীর ধারণাকে গুরুত্ব বা সমর্থন দেননি, তাই তার ধারণাগুলো নিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে বা বিভিন্ন মসজিদে তেমন আলোচনা হয়নি।
জামায়াত কি একটি সামাজিক আন্দোলন? সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের পর্যালোচনা
সামাজিক আন্দোলনকে বলা যায়, “বৃহত্তর পরিবর্তনের লক্ষ্যে কোনো গোষ্ঠীর সমন্বিত, ঐচ্ছিক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড” (ব্রান্নেন ২০০৯, ১)। এখানে ব্রান্নেন উল্লেখ করেছেন ‘উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড’ তখনই প্রয়োজন হবে যখন সমাজ পরিবর্তনের অন্যান্য রাস্তাগুলো যেমন রাজনৈতিক আন্দোলন করার অধিকার, ভোটের অধিকার ইত্যাদি অগ্রহণযোগ্য, নিষিদ্ধ বা ব্যর্থ বিবেচিত হবে। এই গবেষণাপত্রে আমি চেষ্টা করছি সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বকে জামায়াতের উপর প্রয়োগ করতে। ফ্রেঞ্চ পণ্ডিত ফ্রেডরিক গ্রেয়ার জামায়াত সম্পর্কে বলেছিলেন: এটা প্রথমে একটা সামাজিক আন্দোলন ছিল, তারপর এটা একটা চাপ-সৃষ্টিকারি গোষ্ঠীতে পরিণত হয় যারা সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ আদায় করতে পারে, সর্বশেষে এটি পরিণত হয় একটি রাজনৈতিক দলে। গ্রেয়ারের মতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত যতদিন জামায়াত (বৃটিশ ও পাকিস্তান উভয়) সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়নি ততদিন একটি সামাজিক আন্দোলন ছিল। যখনই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারের সাথে জামায়াতের দর-কষাকষির সুযোগ হলো তখন এটি হয়ে গেল একটি চাপ-সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা pressure group-এ। আর যখন প্রকারান্তরে সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে অংশ নিল, তখন জামায়াতকে একটি রাজনৈতিক দলই বলতে হবে। অর্থাৎ গ্রেয়ারের চিন্তা অনুযায়ী সামাজিক আন্দোলন তত্বকে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ এই ৭ বছরই জামায়াতের উপর প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত হবে। তবে আমি ১৯৪১ থেকে ১৯৮৮ এই পুরোটা সময়ই জামায়াতকে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ধরেছি এই পত্রে। কারণ, ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে এবং ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাধারা অনুযায়ী কোন ইসলামী দল ক্ষমতায় থাকলে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হলেও সেটা সামাজিক পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় লেবাননে হিযবুল্লাহ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং সরকারেরও অংশ হয়েছে, কিন্তু তারপরও তাদেরকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন কাপেল (১৯৯৩), জাইদ মানসুন (২০০৯) ও অন্যান্য সমাজ বিজ্ঞানীরা। একইভাবে, মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড যদিও সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত তারপরও তারা বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে নির্বাচন করছে এবং পাশাপাশি তাদের সামাজিক আন্দোলনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক ইসলামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা প্রথমে প্রক্রিয়ার অংশ হতে চায় এবং পরে ভেতর থেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী অনৈসলামিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জামায়াতের ব্যাপারেও আমরা এটাই দেখি। পাকিস্তান একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হবে— কেবল এই শর্তেই মউদুদী পাকিস্তানকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়েছিলেন। ১৯৫৭ তে যখন জামায়াত সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকাশ্যে দলাদলির রাজনীতি শুরু করলো সেটা মউদুদী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হবার উদ্দেশ্যে করেননি, করেছিলেন পাকিস্তানে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এবং সেই সূত্রে একজন মুজাদ্দিদ হতে। তার এই ইচ্ছা তিনি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছিলেন নির্বাচনের পূর্বে দলের সদস্যদের নিকট নির্বাচনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে ছয় ঘন্টাব্যাপী এক বক্তৃতায়। তিনি সেখানে আরও বলেছিলেন জামায়াত ক্ষমতায় গেলে ‘ইকামতে দ্বীন’, অর্থাৎ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে; এবং ‘হুকুমতে ইলাহী’ কায়েম করবে, অর্থাৎ স্রষ্টার দেয়া বিধান অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করবে (মউদুদী ১৯৫৬, ২)। অতএব, প্রথমত বলা যায় জামায়াত কখনই গতানুগতিক ক্ষমতার রাজনীতির জন্য রাজনীতি করেনি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল আরও বৃহৎ এবং জামায়াত ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে কেবল তাদের সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। তাই জামায়াতকে সামগ্রিক বিচারে একটি সামাজিক আন্দোলনই বলতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই পর্যালোচনার সময়কালে (১৯৪১-১৯৮৮) জামায়াতকে বিভিন্ন সময়ে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হয়েছে বিভিন্ন সরকারের আগ্রাসী দমন নীতির কারণে। এমনটা ঘটেছে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় জোট গঠনের সময়, ভুট্টোর বিরুদ্ধে নিজামে মুস্তফা আন্দোলনের সময়, এবং জিয়া-উল হকের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের সময়। এই সময়গুলোতে জামায়াত উক্ত সরকারগুলোর পতন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে যেমন গণ অসহযোগ আন্দোলন, মিছিল, র্যালি, এমনকি সরকার প্রধানদের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন ফতোয়াও দিয়েছেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এতগুলো সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেও জামায়াত আসলে রাজনীতি করার সুযোগ খুব একটা পায়নি। স্বাধীনতার পূর্বে বৃটিশদের সময় এবং স্বাধীনতার পরে ১১ বছর, ১৯৫৮ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে জামায়াত রাজনীতির অঙ্গনে মোটামুটি অনুপস্থিত ছিল (১৯৫৭ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া)। এরপর সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ১৩ বছরের শাসনামলে তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। এরপর যখন ভুট্টো ক্ষমতায় আসেন তিনি একজন কম্যুনিস্ট স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হন এবং গোপন পুলিশবাহিনীর মাধ্যমে দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখেন, তাই সে সময়ও জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ হয়নি। এরপর আসেন সামরিক সৈরশাসক চালবাজ জিয়া-উল হক। তিনি জামায়াতকে বলেছিলেন যে তার সময়ে প্রকৃতপক্ষে জামায়াতই ক্ষমতায় থাকবে। জামায়াত প্রথমে এই ধূর্ততায় গলে গেলেও তাঁদের বুঝতে দেরি হয়নি যে এটা ছিল জামায়াতকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য জিয়ার কৌশল। অতএব বলা যায় ১৯৪১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সময়ে সামাজিক অঙ্গন ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে জামায়াত কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি বা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশও হতে পারেনি।
সমাজে জামায়াতের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজন হবে ‘মাস্টার ফ্রেম’ এর ধারণা (বেনফোর্ড ১৯৮৮, ৬)। মাস্টার ফ্রেমের সাহায্যে সমাজে বঞ্চনা, অনাচার, অসহনশীলতা কেন এবং কোন কোন পারিপার্শ্বিক কারণে ঘটছে তা চিহ্নিত করা যাবে (স্নো ও বেনফোর্ড, ১৩৭)। এই পারিপার্শ্বিক কারণগুলো আন্দোলনের ভিত্তি গড়তে অপরিহার্য।
এ পর্যন্ত আমি এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে জামায়াতকে কেন একটি রাজনৈতিক নয় বরং সামাজিক আন্দোলন হিসেবে দেখতে হবে। এখন আমরা সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের পর্যালোচনা করবো, যা ব্যাখ্যা করবে কেন এধরনের সামাজিক আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত হয়, দানা বাঁধে, এবং সফল বা ব্যর্থ হয়। চিরাচরিতভাবে বলতে গেলে সামাজিক আন্দোলনগুলো ঘটে যখন সমাজে কোন শ্রেণি বা ব্যক্তি বঞ্চনার শিকার হয়। এই বঞ্চনার কারণে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর যে অসন্তুষ্টি পুঞ্জীভূত হয় তারই ফলশ্রুতিতে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। সম্পদের হস্তান্তরযোগ্যতার বিচারে, “সামাজিক আন্দোলনগুলো নির্ভর করে অসংগঠিত এবং বঞ্চিত ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী কি পরিমান সামাজিক প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও সম্পদের মালিক হয়ে উঠছে তার উপর। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের যোগান থাকলেই কেবল মানুষকে কোন লক্ষ্য অর্জনে সুসংগঠিত করা যায়” (জেনকিন্স ও পেরো, ২৫০)। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিচারে তিনটি বিষয়ের উপর সামাজিক আন্দোলন নির্ভরশীল: (১) অসংগঠিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুসংগঠিত হবার যোগ্যতা; (২) জনমনে, অর্থাৎ যারা আন্দোলন করছেন তাদের মনে এমন ধারণা থাকতে হবে যে আন্দোলনের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যটি অর্জন করা সম্ভব; এবং সবচেয়ে দরকারি (৩) যে দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সমর্থন থাকা (ম্যাক এডাম, ৪০)। এছাড়া, সমাজে জামায়াতের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজন হবে ‘মাস্টার ফ্রেম’ এর ধারণা (বেনফোর্ড ১৯৮৮, ৬)। মাস্টার ফ্রেমের সাহায্যে সমাজে বঞ্চনা, অনাচার, অসহনশীলতা কেন এবং কোন কোন পারিপার্শ্বিক কারণে ঘটছে তা চিহ্নিত করা যাবে (স্নো ও বেনফোর্ড, ১৩৭)। এই পারিপার্শ্বিক কারণগুলো আন্দোলনের ভিত্তি গড়তে অপরিহার্য।
আন্দোলনে সফলতার সম্ভাবনা নির্ভর করে সমাজের বিত্তবান, সুবিধাভোগীদের সাথে বিত্তহীন বা সুবিধাবঞ্চিতদের দূরত্বের উপর। সম্পদের হস্তান্তরযোগ্যতার বিচারে আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে কাদের কাছে কি পরিমান (সামাজিক ও অর্থনৈতিক) সম্পদ রয়েছে এবং সেই সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর। যদি কোনো গোষ্ঠী প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করতে সক্ষম হয় এবং তা সঠিক খাতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ব্যবহার করতে পারে তবে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিচারে আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে: আন্দোলনকারীদের নিজস্ব বিশ্বাস ও শক্তির উপর, কোনো ঘটনাকে রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করার যোগ্যতার উপর, সংগঠনের যোগাযোগের নিজস্ব নেটওয়ার্কের উপর, এবং নেতৃত্ব ও তৃণমূল ভিত্তির উপর। ম্যাকএডাম আরও গুরুত্ব দিয়েছেন দলের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাতন্ত্রের উপর। তার মতে যখন আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সবাই দৃঢ়ভাবে আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ব হবে এবং বিশ্বাস করবে যে সফলতা অর্জন সম্ভব, কেবল তখনই আন্দোলনের পেছনে অসংখ্য মানুষ দাড়িয়ে যাবে এবং তাদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়া সম্ভব হবে (ম্যাকএডাম ১৯৯৯, ৪৮)। জামায়াতের ক্ষেত্রে ম্যাকএডামের ‘সংগঠনের যোগাযোগের মাধ্যম বা নেটওয়ার্ক’ তত্ত্বটিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি বলিষ্ঠ যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া আন্দোলন কেবল ছোট পরিসরে, এলাকাভিত্তিক, ও সাময়িক হতে পারে – বৃহত্তর ধারাবাহিক আন্দোলন সম্ভব নয় (ম্যাকএডাম ১৯৯৯, ৪৪)।
জামায়াতে ইসলামী, বছরের পর বছর
শুরু : জামায়াতের জন্মকে ব্যাখ্যা করা যায় বঞ্চনা এবং সম্পদের হস্তান্তরযোগ্যতার তত্ত্ব দিয়ে। ১৯৪১ সালে যখন জামায়াতের প্রতিষ্ঠা হয় তখন মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় কম শিক্ষিত, কম সম্পদের অধিকারী, এবং কম প্রভাবশালী ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল হিন্দুদের মত মুসলমানরা কখনোই বৃটিশ আধিপত্যকে মেনে নেয়নি, বৃটিশদের ক্ষমতাকে স্বীকার করেনি, এবং বৃটিশদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও গ্রহণ করেনি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে বৃটিশরা মুসলমানদেরকে বিদ্রোহী এবং গণ্ডগোল বাধানোর হোতা হিসেবে দেখতো। একারনে মুসলমানরা বৃটিশদের কাছ থেকে কোন সুবিধাই পেত না এবং আশাও করতো না। তাই তারা সামাজিক প্রভাব বা প্রতিপত্তি কোনোটাই গড়তে পারেনি। মউদুদীর জীবনী লেখক সৈয়দ ভালি রেজা নাসের এক ঘটনার বর্ণনায় বলেন, মউদুদী একবার বোম্বের তৎকালীন চিফ মিনিস্টার বি. জে. খেরের সাথে ট্রেনের একটি কামরা শেয়ার করেন। এরপর থেকে মউদুদী সিদ্ধান্ত নেন তিনি হিন্দুদের অহংকারের বিরুদ্ধে লড়বেন। তিনি মনে করতেন যে হিন্দু এবং বৃটিশ আধিপত্য, ক্ষমতা, ও প্রভাব মুসলমানদেরকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যূত করছে এবং ইসলামের পথ থেকে সরে যাবার কারণেই মুসলমানদের পতন হয়েছে। এতে তারা দুনিয়াতেও যেমন সহায়-সম্পত্তি গড়তে পারেনি, তেমনি খুইয়েছে আখেরাতকে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই তিনি জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে সম্পদের হস্তান্তরযোগ্যতার বিচারেও জামায়াতের জন্মকে ব্যাখ্যা করা যায়।
মউদুদী প্রথমে যে কাজটি করেছেন তা হলো প্রচুর লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ একটি গোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলা এবং তাদের মাঝে আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটানো। তার লেখার গুণে ‘তরজমানুল কোরান’ নামের সাময়িকীটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর ফলে জামায়াত প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি মানুষের মাঝে জামায়াতের ভাবধারা পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। তাই তিনি যখন জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন তখন অনেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল জামায়াতে যোগ দিতে। ইসলামের মূলধারার অনেক আলেম-ওলামা ছাড়াও দেওবন্দি, নদভি, আহলে হাদিস সম্প্রদায় থেকেও অনেকে, বিশেষ করে তরুণরা, মউদুদীর আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ২২৪ জন আলেম জামায়াতে যোগ দেন। তাদের মধ্যে ৬০ জন বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করতেন (খুরশিদ ১৯৮০, ৬০)। এটা মনে হতে পারে যে মাত্র ২২৪ জন আলেম সমগ্র উপমহাদেশের তৎকালীন মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। কিন্তু আসলে সম্পূর্ণ নতুন ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত নতুন একটি সংগঠনের জন্য ২২৪ জন আলেম একেবারে কম নয়, বিশেষ করে তাদের অনেকে যখন মসজিদ মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন এবং এমন অনেক আলেম জামায়াতে যোগ দিয়েছিলেন যাদের অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী আছে। এছাড়াও মূলধারার এবং মূলধারার বাইরের যেসকল আলেম জামায়াতে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবার ব্যপারে একটা কথা বলা যায় যে তারা সবাই ছিলেন উচ্চ-শিক্ষিত, অত্যন্ত পণ্ডিত, ও জ্ঞানী। তখনকার খুব কম আলেমই তাঁদের মত শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৪৫ সালের হিসাব অনুযায়ী জামায়াতের সদস্যদের মাঝে আলেম-ওলামাই ছিলেন প্রায় ৪০%।
আল্লামা ইকবাল এবং মাওলানা মউদুদী উভয়ের ভাবাদর্শ দ্বারাই জিন্নাহ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তার ধারণা হয়েছে যে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। জিন্নাহ’র এই বিজয়ে মউদুদী বুঝতে পারলেন যে মুসলিম সমাজে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত, তাই অসীম ক্ষমতার উৎস হতে পারে ইসলাম
পাকিস্তান আন্দোলন এবং জামায়াত
মাওলানা মউদুদী শুরুতে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। এজন্য যে, তিনি জানতেন পাকিস্তানকে ইসলামের রূপরেখা অনুযায়ী সাজানোর কোনো আগ্রহই জিন্নাহ’র ছিল না। জামায়াতের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মের আলোকে সমাজ সংস্কার, কিন্তু মুসলিম লীগ এর পরিবর্তে নতুন একটি চেতনা নিয়ে আসে। আর তা হলো মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেতনা। মুসলিম লীগ বলেছিল ভারতের সকল মুসলমানদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তান হবে একটি মুসলিম দেশ যেখানে পাশ্চাত্যের গ্রহণযোগ্য কিন্তু ক্ষতিকারক নয় এমন মতবাদগুলো স্থান পাবে— যেমন গণতন্ত্র, সংসদ, আইনের শাসন, ইত্যাদি। তারা এমনও বলতো যে পাশ্চাত্যের দর্শন, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান— এগুলোকে গ্রহণ করা খুব ক্ষতিকর কিছু হবেনা। কিন্তু মউদুদী মনে করতেন এসব ধর্মহীন বা সেক্যুলার ধারণা এবং জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রের সাথে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না। মউদুদী জাতীয়তাবাদকে দেখতেন একটি ভিনগ্রহের ধারণা হিসেবে। তিনি মনে করতেন উপনিবেশবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে মুসলিম উম্মাহকে শতভাগে বিভক্ত করেছে; মুসলমানদের সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনার মধ্যে পাশ্চাত্য ভাবধারা ঢুকিয়ে দিয়েছে; এবং মুসলমানদেরকে ধর্মভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই তিনি মনে করতেন না যে ইসলামের আলোকে সমাজ সংস্কারে জাতীয়তাবাদ কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি জাতীয়তাবাদকে ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতেন। এদিকে জিন্নাহ মুসলিম জাতীয়বাদকে পুঁজি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে খুব সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ১৯৪৫-৪৬ এর নির্বাচনে খুব ভালো ফলাফল করে প্রমাণ করলেন যে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে সফল হওয়া সম্ভব। মজার ব্যপার হচ্ছে, আল্লামা ইকবাল এবং মাওলানা মউদুদী উভয়ের ভাবাদর্শ দ্বারাই জিন্নাহ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তার ধারণা হয়েছে যে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। জিন্নাহ’র এই বিজয়ে মউদুদী বুঝতে পারলেন যে মুসলিম সমাজে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত, তাই অসীম ক্ষমতার উৎস হতে পারে ইসলাম (মউদুদী ১৯৪৭, ১৫)। যখন পাকিস্তান অবশেষে ১৯৪৭-এ স্বাধীন হলো তখন মউদুদী এটাকে তার স্বপ্নের ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখলেন – এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এর সার্বজনীনতায় এবং একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হবার পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ’র মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে। শুধুমাত্র এই আশায় তিনি পাকিস্তানের অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছিলেন।