সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ২

সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ২

প্রাথমিক অবস্থায় গার্দিওয়ালাকে গদিতে বসানোর সিদ্ধান্তটিকে জুয়া বলে মনে হলেও পরবর্তী পথ পরিক্রমা খেয়াল করলে দেখা যাবে নিয়োগটি ছিল পরিকল্পিত। রাইকার্ড প্রাথমিক বুনিয়াদ গড়ে দিয়ে গেলেও বার্সার মূল দর্শন থেকে তার একটি দূরত্ব ছিল। গার্দিওলা থেকে শুরু করে বর্তমান কোচ ভালভার্দে পর্যন্ত যাদের বার্সা নিয়োগ দিয়েছে তারা হয় লা মেসিয়ার ক্যাডেট অথবা বার্সার দর্শনের সাথে সুপরিচিত। মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন টাটা মার্টিনেজ। যিনি একক গুণেই উড়তে থাকা বার্সাকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন।

যাই হোক ওয়াক্ত বিবেচনায় বার্সা তাদের ইতিহাসের সেরা সময়টি কাটিয়েছে গার্দিওলার অধিনে। বিস্ময়কর সব রেকর্ড এবং অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় নতুন শতকের শুরুর দশকেই অনেকে বার্সার গায়ে শতাব্দি শ্রেষ্ঠর তকমাও জুড়ে দিয়েছিলেন। গার্দিওলার প্রথম তিন বছরে সাম্ভাব্য ১৬ টি শিরোপার ১৩টিই  নিজেদের করে নিয়েছিল বার্সা। বিদায়ের আগে আরো একটি সহ মোট ১৪ টি শিরোপা জিতে ক্যাম্প ন্যু ত্যাগ করার আগেই হয়ে যান বার্সার সবচেয়ে সফল ম্যানেজার।

গার্দিওলা মূলত তার গুরু ইয়োহান ক্রুইফের দর্শনকেই কাজে লাগিয়েছিলেন নতুন করে। যার ফলে, দিনহো এবং ডেকোকে বিক্রি করে দিয়ে তিনি গুরুত্ব দিতে লাগলেন লা মেসিয়া ক্যাডেটদের ওপর। রাইকার্ড আমলে যাদের রাইকার্ড প্রস্তুত করে দিয়ে গিয়েছিলেন। বিষয়টিকে যদি শুধু এভাবেই দেখা হয় যে, মোক্ষম অস্ত্র তৈয়ারের যাবতীয় সরঞ্জাম রাইকার্ড তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন এবং গার্দিওলা শুধু তার ফায়দা লুটেছেন সেটি এক প্রকার অন্যায়ই হবে। হ্যা, রাইকার্ড অস্ত্রগুলো এক করেছিলেন বটে, তবে সেটিকে কাজে লাগাতেও দক্ষতার প্রয়োজন। সেটি যে গার্দিওলার ছিল তার সাক্ষ্য ইতিহাসই দেয়। তার আমলের তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা জিকরের প্রয়োজন। গার্দিওলার আমলে প্রথম স্প্যানিশ ক্লাব হিসাবে ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব দেখায় বার্সা। ইউরোপের ইতিহাসের এখন পর্যন্ত এক ক্যালেন্ডার ইয়ারের সাম্ভাব্য ছয়টি শিরোপার সবগুলো যেতে বার্সা এবং ইতিহাসের প্রথমবারের মত ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ব্যালন ডি’অরের প্রথম তিনজনই ছিলেন একটি নির্দিষ্ট যুব দলের।

এর রেশ পড়েছিল স্পেন জাতীয় দলেও। বিশ্বজয়ী স্পেন জাতীয় দলের সাতজন সদস্য ছিলেন লা মেসিয়ার ক্যাডেট, যাদের ছয়জনই ছিলেন ফাইনালের মূল একাদশে এবং একজনের গোলে বিশ্বজয় করেছিল স্পেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে লা মেসিয়া গার্দিওলার সাফল্যের অন্যতম পাথেয় ছিল। বার্সার মূল দলের সাথে লা মেসিয়ার ক্যাডেটদের রাবতা তিনি তৈয়ার করেছিলেন নিপুণ দক্ষতায়।

বার্সা তখন কতটা অজেয় তা জানতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। সে দশকে দশবারের মধ্যে সাতবারই লা লিগা জিতেছিল কাতালানরা। যে পথে এগুচ্ছিলো তাতে শতাব্দী শ্রেষ্ঠত্বের যে শোর বার্সা সমর্থকরা তুলেছিল তা অনেকের কাছেই তেতো লাগলেও কবুল করার পর্যায়েই চলে গিয়েছিল দলটি।

গার্দিওলার সময়কার আরো কিছু বিষয় দৃষ্টি আকর্ষনের দাবি রাখে। তার ট্রান্সফার পলিসি ছিল বার্সার প্রথাগত ঘরাণা থেকে আলাদা। তিনি রাইকার্ডের মতন কার্যকর খেলোয়াড়ের বদলে ঝুঁকেন তারকাদের দিকে। যার ফলে বার্সায় দেখা যায় ইব্রাহিমোভিচ, অঁরি, ফেব্রেগাস, মাসচেরানোদের। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে লা মেসিয়ার ক্যাডেটরা পেপের অধিনে যতটা উজ্জ্বল ছিলেন বাইরে থেকে আসা তারকারা ঠিক ততটা না। বিশেষ করে জ্লাতানের সাথে শেষ দিকে ক্লাবের সম্পর্ক ছিল ভয়াবহ এবং পেপের সম্পর্কে তার মন্তব্যগুলোর অধিকাংশই নেতিবাচক।

ট্রান্সফার পলিসির প্রসঙ্গটি যখন এসেছে তখন বার্সা ম্যানেজমেন্টের ভূমিকাও আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। কোনো এক অজানা কারণে, বার্সা ম্যানেজমেন্ট ট্রান্সফার পলিসিতে পূর্ণ স্বচ্ছতা আনতে ব্যার্থ হয়েছে। এখনো এ অভিযোগটি বিদ্যমান। যেমন নেইমারেকে ঠিক কত টাকা ব্যয়ে ক্যাম্প ন্যুতে ভেড়ানো হয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট না। অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে ক্লাবকে ডিঙ্গিয়ে সরাসরি খেলোয়াড়কে প্রভাবিত করে দলে টানার চেষ্টা চালিয়েছে কাতালানরা। এ নিয়ে একাধিক ক্লাব অভিযোগ এনেছে একাধিকবার। গেলো মৌসুমে কৌতিনহোর ট্রান্সফারটি ছিল তিক্ততা পূর্ণ। যার ফলে, নতুন করে প্রকাশিত এক খবরে জানা যাচ্ছে যে, রেডসরা কৌতিনহোর চুক্তিতে একটি অদ্ভুত শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে; একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত লিভারপুল থেকে আর কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারবে না বার্সা। এর চেয়ে দৃষ্টিকটূ ছিল রোমার সাথে ম্যালকমকে নিয়ে ঘটা ঘটনাটি। আইনি ব্যাখ্যায় বার্সা জয়ী হলেও নৈতিকতার দিক থেকে বিষয়টি বিস্তর সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার আগে আজকের লেখার ইতি টানবো গার্দিওলার শেষ দিয়ে। গার্দিওলা টিকিটাকায় যেমন সাফল্য গাথা লিখেছেন তেমনি বার্সায় তার শেষটা মধুর না হবার কারণও সেই টিকিটাকাই। শুরুর দিকে এ কৌশলে মার খেলেও পরবর্তীতে এর প্রতিষেধক বের করেন অন্যান্য কোচরা। যার পূরধা বলা যেতে পারে মোরিনহোকে। কিন্তু, গার্দিওলাও রাইকার্ডের মতনই নিজ দর্শনেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেন। যেটি নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়েছে।

গার্দিওলার সময়ে আরো একটি বিষয় যেটি বার্সা বিরোধীদের মন বিষিয়েছে সেটি হচ্ছে খেলোয়াড়দের ডাইভিং প্রবণতা এবং এটি নিয়ে তার নীরব থাকা। বার্সা যেমানের ফুটবল খেলছিল সে সময় তাতে রেফারির উপর মনস্তাত্বিক প্রভাব বিস্তার ছিল নিষ্প্রয়োজন। আমি জানি, বার্সার সমর্থকরা এটি কড়া ভাষাতেই প্রত্যাখ্যান করবেন। সেটাই স্বাভাবিক। তবে, সত্য সত্যই। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সার বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষ কতবার ভূল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছে এবং সেটি খেলার ফলাফলে কতটা প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনই ছেপেছিল বৈদেশিক গণমাধ্যম ডেইলি মেইল। এমনটা যে শুধু বার্সার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা না; তবে মাত্রাটা আলাদা করে নজরে আসার মত ছিল। আর এটি যে শুধু গার্দিওলার সময়েই ঘটেছে তাও না; তবে, সূচনাকাল তার সময়েই। অথচ, বার্সা তখন যেমন খেলছিল তাতে এ সাহায্য ছাড়াও বার্সার সাম্রাজ্য অটুট থাকত বলেই আমার বিশ্বাস।

মেসি গার্দিওলাকে নাকি গার্দিওলা মেসিকে অমরত্বের পথে এগিয়ে দিয়েছেন সেটি নিয়ে কুতর্ক হতে পারে। তবে, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, মেসির মেসি হয়ে ওঠার পথটা গার্দিওলাই করে দিয়েছিলেন। আর মেসি এমন এক গৌহর যাতে মুগ্ধ পুরো ফুটবল বিশ্বই। মেয়াদকাল বিবেচনায় গার্দিওলা খুবই স্বল্প সময়ই কাটিয়েছেন বার্সায়। কিন্তু, সে সময়টাতেই তিনি বার্সার ভবিষ্যত দর্শন কিরূপ হওয়া উচিত সেটিও এক প্রকার ঠিক করে দিয়ে যান বলা যায়। [চলবে …]

পড়ুন : সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ১