রিয়ালের রুহতে পরিণত হওয়া রোনালদো রিয়াল ছেড়ে তুড়িনের পথ ধরার পর থেকেই জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে পর্দার পেছনের কালপ্রিটটি কে সেটি নিয়ে। প্রাথমিকাবস্থায় রোনালদোর এজেন্ট হোর্হো মেন্দেসকে মূল ক্রীড়নক মনে হলেও সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে রোনালদো খোলাখুলিই জানিয়েছেন রিয়াল ছাড়ার পিছনে একমাত্র কারণ ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রোনালদোর সে সাক্ষাৎকারের পর থেকেই রিয়াল সমর্থকদের বিশেষ করে রোনালদোকে যারা অন্ধ অনুসরণ করেন তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন পেরেজ।
ক্লাব বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর পেরেজ রিয়ালের হিরো না ভিলেন তা নিয়ে সহজ উপসংহারে আসাটা বেশ কঠিন। একই রকম জটিল তার চরিত্রের ধরণ বোঝাটাও। যখনই, মনে হয় পেরেজ ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তখনই নতুন করে বিতর্কে জড়ানোকে যেন অভ্যাসে পরিণত করেছেন তিনি। এটা যে কোনো বিশ্লেষকের জন্যই কঠিন তাকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা। আবার একই সাথে তার ভুলের যে মাশুল রিয়াল দিয়েছে, দিচ্ছে তার পূর্ণ ফায়দা লুটে বার্সা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে অন্যতম প্রধান শক্তিতে। আমি পেরেজকে হিরো বা ভিলেন কোনো আসনেই বসাতে চাচ্ছি না, এ লেখায় আমি তার পথ পরিক্রমাটাই তুলে ধরবো। যাতে না চাইতেও একাধিকবার আসবে বার্সার নাম।
রিয়ালের প্রধান হবার বাসনা পেরেজ প্রথম প্রকাশ করেন নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু প্রথমবারের ভোটের লড়াইটি তার জন্য সুখকর হয়নি। ৬৯৯ ভোটের বেশ বড় ব্যবধানেই পরাজিত হন তিনি। তারপর তার রিয়ালে ফেরাটা একরকম ত্রাতার মতই বলা যায়। মাঠে সাফল্য আসলেও আর্থিক দিক দিয়ে দূর্বল হয়ে পড়া রিয়ালকে উদ্ধার করেন দেনা শোধ করে। সাথে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বার্সেলোনা থেকে নিয়ে আসেন লুইস ফিগোকে। প্রাথমিকাবস্থায় ত্রাতা বলে মনে হলেও পেরেজের অনভিজ্ঞতা এবং বাণিজ্য লিপ্সা প্রকাশ প্রায় দ্রুতই। তাই দায়িত্ব নেয়ার আগে রিয়ালের যে দলটি সফল ভাবে মাঠ মাতাচ্ছিল সেটিকে ভেঙ্গে তারার হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। একে একে জিদান, বেকহাম, রোনালদো, ওয়েন, নিস্টলরয়রা ফিগোর পথ ধরে বার্নাব্যুতে আসলেও কাঙ্খিত সাফল্যের ছিটেফোটাও মিলে নি। বরং, এর মধ্যে তিনি বরখাস্ত করে বসেন সফল কোচ দেল বস্ককে।
এখন পেরেজের প্রথম দফা পর্যালোচনা করলে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যার সরাসরি দুটির সুফল ভোগ করেছে বার্সা।
- বর্ণবাদ
- ভুল ট্রান্সফার নীতি
- কোচ নিয়োগ/ছাটাইয়ে অস্পষ্টতা
পেরেজকে সরাসরি বর্ণবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা না গেলেও ‘কালো’ বর্ণের প্রতি তার অনীহা স্পষ্ট। যার ফলে প্রাপ্যের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পেয়ে রিয়াল ছেড়ে চেলসিতে যোগ দেন মধ্যমাঠের মেরুদন্ড ম্যাকেলেলে। যার প্রভাব খুব বাজে ভাবেই পড়েছিল রিয়ালে। একই সাথে যুব দলের আবিষ্কার ই’তোও রিয়াল ছেড়ে যোগ দেন বার্সায় এবং হয়ে ওঠেন বার্সার অন্যতম মূল অস্ত্র। পেরেজের এই সাদা বর্ণ প্রীতির কারণে রোনালদিনহোর বদলে তিনি বেছে নেন বেকহামকে। সন্দেহ নেই বেকহাম তার সময়ের অন্যতম সেরা, কিন্তু দিনহো সর্বকালেরই অন্যতম সেরা। ফলটাও আসে হাতেনাতে; রিয়াল যখন টানা ট্রফিলেস সময় পার করছে তখন দিনহোয় ভর করে পুর্ণজন্ম নিয়েছে বার্সেলোনা।
পেরেজের ট্রান্সফার নীতি আরো একটি বিতর্কিত বিষয়। দলের জন্য কার্যকর, এমন খেলোয়াড়ের চেয়ে তারকা তকমাধারীদের প্রতি তার প্রীতি ছিল চোখে পড়ার মত। যার ফলে ভেঙ্গে যায় দলীয় ঐক্য। জন্ম নেয় এক চাপা ক্ষোভ এবং অসন্তোষের। এর প্রভাবও মাঠের ফলেই স্পষ্ট।
লীগ জেতার পরেও খেলোয়াড় এবং কোচ দুই ভূমিকাতেই সফল দেল বস্ককে ঠিক কী কারণে পেরেজ বরখাস্ত করেছিলেন সেটির ব্যাখ্যা একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন। এখানে যোগ্যতা নাকি অন্ধ আনুগত্য কোনটি প্রাধান্য পেয়েছে বলা কঠিন। কারণ, বস্ককে বরখাস্ত করার পর যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের কেউই খুব বেশি সময় বার্নাব্যুতে কাটাতে পারেননি। অতএব, অন্ধ আনুগত্য বিষয়টাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অপর দিকে বার্সা রাইকার্ডের নেতৃত্বে নিজেদের প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছিল নতুন উচ্চতায়। শুধু তারকার সম্মেলন আর যাকে খুশি তাকে কোচ নিয়োগের ফল যে ফলপ্রসু হয় না, সেটি পেরেজ বার্সা থেকে দেখেই শিখতে পারতেন। বার্সাকে ছাড়ানোর তীব্র মনোবাসনা তার মধ্যে স্পষ্ট হলেও বার্সার সাফল্যের পিছনের কারণটা তিনি কখনো খুঁজে দেখেছেন বলে মনে হয় না।
প্রথম দফায় পেরেজের মূল সাফল্য বলা যায় রিয়ালকে রক্ষা করা। কারণ, এমন অনেক ক্লাবই রয়েছে যারা মাঠে আলো ছড়ালেও আর্থিক দুরাবস্থায় স্থান নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। যার সর্বশেষ উদাহারণ হতে পারে এসি মিলান। একই সাথে অবকাঠামোগত এবং বাণিজ্যিক সাফল্যও ছিলো চোখে পড়ার মত। কিন্তু এটি রিয়ালের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে, আমার মতে এ মতটা ভুল। রিয়াল অনেক আগে থেকেই এলিট ক্লাবের একটি। তাই নতুন করে চেনানোর কোনো বিষয় ছিল না। তিনি যেটি পেরেছিলেন সেটি হচ্ছে এশিয়ার বাজারে প্রভাব ফেলতে। যেটি রিয়ালকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছে। কিন্তু শুধু মাত্র তারার হাট বসিয়েই যে সাফল্য আসে না, সেটি স্পষ্ট হবার পর পেরেজ নিজেই ইস্তফা দেন। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, ত্রাতা হিসাবে আবির্ভুত হয়ে তিনি রিয়ালকে রক্ষা করেছেন ঠিকই কিন্তু মাঠের রিয়ালের ব্যার্থতার দায়ও অনেকাংশেই তার। যেটি কাধে নিয়ে নিজে থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
দ্বিতীয় মেয়াদে পেরেজ কি করেন সেটা নিয়েও বেশ কৌতুহল ছিল। প্রথম দফায় মাঠের খেলায় ব্যর্থ হলেও বিদায় নিয়েছিলেন আলোচিত এক চরিত্র হিসাবেই। পেরেজের বিদায়ের পর থেকে পুনরায় দায়িত্ব নেয়া মধ্যবর্তী সময়ে বার্সা পরিণত হয়েছিল ইউরোপের ত্রাসে। নিখুঁত পরিকল্পনা, এবং মাঠে সমান তালের নৈপুণ্যে বার্সার চূড়ান্ত একাধিপত্য তখন একরমক কবুল করে নিয়েছে সবাই।
এখানে যে বিষয়গুলো বিশেষ নজরে আসার মত তা হল, বার্সা সফল হয়েছে নিজস্ব ধাঁচেই। একই সাথে তারা সমান দৃষ্টি রেখেছিল যাদের ওপর ভর করে তারা ছড়ি ঘুরাচ্ছে তাদের বিদায়ে যেন শূণ্যতার সৃষ্টি না হয়। যার ফলে, বার্সা জামানার জন্ম যাদের হাত ধরে সে দিনহো, জুলি বা ডেকোরা বিদায় নিলেও বার্সার আধিপত্যে সামান্য ছেদ পরেনি। কারণ, ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছেন মেসি, ইনিয়েস্তা, জাভিরা। কোচ বদলের ক্ষেত্রেও বার্সা দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া স্থিরতার পরিচয়ই দিয়েছে। টিকিটাকা আটকানো কৌশল প্রতিপক্ষ রপ্ত করলেও বার্সা পুরোপুরি সে ধাঁচ থেকে না সড়ে ভিন্নমাত্রা যোগ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখেছে। বার্সার ট্রান্সফার পলিসি নিয়ে যদিও সমালোচনা রয়েছে কিন্তু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সে জায়গাতেও তারা উন্নতি করছে। তারকার বদলে খেলার ধরণের সাথে খাপ খায় এমন খেলোয়াড়দের দিকেই বার্সা ঝুঁকছে বেশি করে। দু’একটি ব্যতিক্রম যে হয়নি তা না, কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা ঠিক পথে হেটেছে বলে চলতি মৌসুমেও ক্ষুরধার বার্সাকেই দেখা যাচ্ছে। একই সাথে বার্সার সব সময়ই বিশেষ নজর ছিল লা মেসিয়ার প্রোডাক্টদের ওপর। যার ফলে, নতুন যেই এসেছে মানিয়ে নিতে খুঁব একটা সময় লাগেনি।
[চলবে …]