স্লিম বা সুন্দর দেহের অধিকারী হওয়ার উপায় কী? সহজ উত্তরটা হচ্ছে– অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা। যেটাকে সচরাচর আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ হিসাবে। আসলে কি এটাই সঠিক উত্তর বা সঠিক সমাধান? বাস্তবতা হচ্ছে মোটা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে দায়ী হচ্ছে চিনি! কিন্তু এই সত্যটি যাতে সবাই না জানতে পারে বা মনযোগ যাতে এদিকে না পড়ে সে জন্য বড় চিনি কোম্পানিগুলো এবং একই সাথে কোকা-কোলার রয়েছে বিশাল কারসাজির ইতিহাস।
চিনি কেলেঙ্কারি
‘নিউইয়র্ক টাইমসে ‘How the Sugar Industry Shifted Blame to Fat’ বা ‘কিভাবে চিনি কোম্পানি চর্বির ওপর দোষ চাপালো’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
সেখানে পত্রিকাটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ‘জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইন্টারনাল মেডিসিনে’ চিনিসংক্রান্ত একটি কেলেঙ্কারির ঘটনা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ‘Sugar Industry and Coronary Heart Disease Research, A Historical Analysis of Internal Industry Documents’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্রে এমন দাবি করেছে।
‘রিসার্চ প্রজেক্ট ২২৬’-এর আওতায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন বিজ্ঞানীকে হার্ট অ্যাটাকের কারণ নির্ণয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সুগার অ্যাাসেসিয়েশন বিপুল পরিমাণে ফান্ড প্রদান করে। ফলে গবেষকদ্বয় হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসেবে চিনিকে বাদ দিয়ে শুধু চর্বি ও কোলেস্টেরলকে দায়ী করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তখন সুগার অ্যাসোসিয়েশন উক্ত গবেষকদের প্রায় ৫০ হাজার ডলার ঘুষ প্রদান করে।
চিনি ব্যবসায়ীদের এই যোগসাজশের মাধ্যমে, ১৯৬৭ সালে ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হার্ভার্ডের উক্ত দুই গবেষকের গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশ করা হলে দেখা যায়, সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসাবে চিনিকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের জন্য একতরফাভাবে চর্বি ও কোলেস্টেরলকে দায়ী করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
হার্ট অ্যাটাকের কারণ থেকে চিনি অব্যাহতি পেয়ে গেলে সুগার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাবসায় আলাদিনের চেরাগ নেমে আসে। তারা এই চেরাগকে কাজে লাগিয়ে সারাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চিনি ও চিনিজাত দ্রব্যের ব্যবসা খুলে বসে। যা এখনও একতরফাভাবে অব্যহত রয়েছে।
‘জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইন্টারনাল মেডিসিন’ এর সহকারী লেখক স্ট্যান্টন গ্লান্টজ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘সুগার ইন্ডাস্ট্রির কাজটি ছিল খুবই স্মার্ট, কারণ হিসাবে তাদের রিভিউ পেপারের কথা বলতে হয়। বিশেষত তারা তাদের গবেষণাপত্র একটি খুব বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশ করেছিল। সর্বোপরি তারা একটি বৈজ্ঞানিক ভাব বা পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল’।
কোকাকোলা কেলেঙ্কারি
এর আগে নিউইয়র্ক টাইমস ‘কোকা-কোলা বাজে ডায়েট এর বদলে অন্যকিছুকে দোষারোপ করতে বিজ্ঞানীদের পেছনে অর্থলগ্নি করে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখান থেকে জানা যায়, কোকাকোলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিনিভিত্তিক বেভারেজ কোম্পানি। নিউইয়র্ক টাইমস এমন একটি ইমেইল হাতে পায় যেখানে দেখা যায়, কোকাকোলা কোম্পানি গবেষকদের সঙ্গে সবসময় একটি সুবিধাজনক যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। তারা সেজন্য গবেষকদের বড় অংকের অর্থ পরিশোধ করে। ফলে এসব গবেষকরা তাদের গবেষণায় বলে থাকেন, চিনিসমৃদ্ধ কোমল পানীয়র সঙ্গে শরীরের ওজন বৃদ্ধির তেমন কোন সম্পর্ক নেই।
উদাহরণ হিসাবে ড. হান্ডের কথা বলা যায়। যিনি ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনার চাকরিরত ছিলেন। কোকাকোলার ফান্ড পেয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। কোকাকোলা কোম্পানি ২০১১ সালে ‘শক্তি প্রবাহ’ নামে একটি গবেষণার জন্য তাকে ৮ লাখ সাড়ে ছয় হাজার মার্কিন ডলার প্রদান করে। পরবর্তী বছর তিনি ‘গ্লোবাল এনার্জি নেটওয়ার্ক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আরও ৫ লাখ ৭ হাজার মার্কিন ডলার ফান্ড গ্রহণ করেন। তার কাজ হচ্ছে কোকাকোলা কোম্পানিকে বৈজ্ঞানিক সমর্থন দিয়ে যাওয়া। এ রকম আরও অনেককে ফান্ড দিয়ে থাকে কোকাকোলা। যার মধ্য দিয়ে কোকাকোলা সারাবিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসায়িক আধিপত্য ধরে রেখেছে।
ক্যান্ডি প্রসঙ্গ
চিনি দ্বারা তৈরি আরেকটি পণ্য হচ্ছে ক্যান্ডি। আমাদের দেশে ক্যান্ডি চকলেট নামেই অধিক পরিচিত।
এপি নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘দি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ এমন একটি ইমেইল হাতে পেয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ক্যান্ডির বাণিজ্য সংস্থাগুলো কিভাবে গবেষকদের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে। ক্যান্ডি কোম্পানি থেকে ফান্ড নেয়া এসব গবেষক তাদের গবেষণায় বলে থাকেন, যারা ক্যান্ডি খায় না তাদের চেয়ে যারা ক্যান্ডি খায় তাদের স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকে।’ এভাবে বৈজ্ঞানিক সমর্থনের নামে তারা তাদের কোটি কোটি ডলারের মুনাফা লুফে নেয়।
কোলেস্টেরল ও হার্ট অ্যাটাক
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা যুগ যুগ ধরে বলে এসছেন যে, কোলেস্টেরলের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়। এমনকি এই কথা এখনও অধিক প্রচলিত। এরই প্রেক্ষিতে চিকিৎসকরা অনন্তকাল ধরে রোগীদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো এবং চর্বিজাতীয় খাবার না খেতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
চিকিৎসকদের ধারণা– চর্বিজাতীয় খাবার কম খেলে এমনিতেই রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে আসবে। কিন্তু এ ধারণা সত্য নয়। কারণ শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির মূল কারণ চর্বিজাতীয় খাবার নয়, বরং অত্যধিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার। স্বাভাবিক মাত্রার কোলেস্টেরল এবং চর্বিজাতীয় খাবার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ নয়– এ কথা বলা অদ্যাবধি চিকিৎসাশাস্ত্রে এক মহাপাপ বলে গণ্য করা হতো।
তবে রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল, বিশেষ করে এলডিএলের উপস্থিতি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। শরীরে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল বা এলডিএল তৈরি হতে পারে না, যদি কেউ সবকিছু পরিমিত পরিমাণে খায়। আর কোলেস্টেরলই হার্ট অ্যাটাকের একমাত্র কারণ নয়।
কেলেঙ্কারি ফাঁস যেভাবে
কোটি কোটি টাকা ফান্ড নেয়া বা দেয়াই মূল কথা নয়। এর সাথে রয়েছে ক্ষমতার সম্পর্কও। ফলে টাকার বিনিময়ে বের হওয়া ভুয়া গবেষণাপত্রের গোমর ফাঁস চাইলেই করা যাচ্ছিল না, যদিও অনেক বিজ্ঞানী এসব ভাওতাবাজি টের পেয়েছিল।
গোমর ফাঁস করার এই দায়িত্বটি প্রথম নিয়েছিলেন প্রফেসর জন ইয়াদকিন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। নীরবে হারিয়ে যাওয়া ওই বিজ্ঞানীর গবেষণা পত্রগুলোও গায়েব করে দেয়া হয়েছিল। তবে তার কাজটি একেবারে পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়নি।
ব্রিটিশ পুষ্টিবিদ প্রফেসর জন ইয়াদকিন ১৯৭২ সালে তার ‘পিওর, হোয়াইট অ্যান্ড ডেডলি’ বইয়ে চিনির ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চিনির ক্ষতি করার যে ক্ষমতা তার সামান্য অংশ যদি খাদ্যে ব্যবহৃত অন্য কোনো উপাদানে থাকত, তবে সেই উপাদান নিষিদ্ধ হয়ে যেত। ইয়াদকিনের চিনিবিষয়ক এই উপাত্তটি আলোর মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ফুড কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চিনির পক্ষে সাফাই গাওয়া পুষ্টিবিদদের সহযোগিতায় প্রফেসর ইয়াদকিন আর তার গবেষণাকর্ম সবার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

অনেকদিন পরে এই গবেষণায় ফের নতুন যাত্রী হিসাবে যোগ দেন রবার্ট লাস্টিগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাচ্চাদের মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। চিনির ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে সরব আছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই। ইতোমধ্যে কর্পোরেট সংস্কৃতি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভুবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে; চিনি নিয়ে পুষ্টিবিদরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সময়েরও পরিবর্তন ঘটেছে। মিডিয়ার বহুমুখিতা এসেছে, ফলে আশঙ্কা থাকলেও রবার্ট লাস্টিগকে প্রফেসর ইয়াদকিনের মতো একা করে ফেলা সম্ভব হয়নি।
তথ্য-উপাত্ত প্রচারের এক পর্যায়ে রবার্ট লাস্টিগ জানতে পারেন প্রফেসর ইয়াদকিন সম্পর্কে। বহু চেষ্টার পর তিনি সংগ্রহ করেন চিনিবিষয়ক ইয়াদকিনের হারিয়ে যাওয়া বইটি। লাস্টিগ দেখতে পান, চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিজে যা জেনেছেন, ৩৫ বছর আগে প্রফেসর ইয়াদকিন তা জানিয়ে গেছেন বিশ্ববাসীকে।
ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে লো-ফ্যাট ডায়েট হছে স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট– এই হুজুগে হারিয়ে যায় প্রফেসর ইয়াদকিনের চিনিবিষয়ক গবেষণা। তখন চিনি শিল্পের হর্তাকর্তারা চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা কার্যক্রমে নজর রাখতে শুরু করেন এবং ফ্যাটকে দায়ী করে গবেষণা ফলাফল প্রকাশে অনৈতিক উৎসাহ দিতে থাকেন।
২০০৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়, এমনকি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুসন্ধানে হৃদরোগের সঙ্গে হাই-ফ্যাট ডায়েটের বিশ্বাসযোগ্য যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক প্রায় অধিকাংশ গবেষণায় হৃদরোগ আর মোটা হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে চিনির দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। লিভারে চিনি ফ্যাটে পরিণত হয়, চিনি রক্তে চর্বি-প্রবাহ ত্বরান্বিত করে, ফ্যাটি লিভারসহ নানা রকম অসুখ-বিসুখে চিনির যোগসূত্রের তথ্য ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
‘সাদা চিনি’ যাকে আমরা ‘টেবিল সুগার’ বলি, কার্বোহাইড্রেট পরিবারে এটি ‘সুক্রোজ’ নামে পরিচিত। সুক্রোজের গাঠনিক উপাদান হচ্ছে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ। সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুষ্টি নির্দেশনায় এই টেবিল সুগারের পরিমিত ব্যবহার ভীষণ জরুরি হয়ে উঠছে।
১ thought on “চিনি কোম্পানি ও কোকা-কোলার যুগপৎ দুর্নীতির ইতিহাস”
কমেন্ট বন্ধ।