ওয়েঙ্গার যুগ কি শেষের পথে

ওয়েঙ্গার যুগ কি শেষের পথে

আর্সেনালে অবেশেষে শেষ হতে চলেছে আর্সেন ওয়েনগার যুগ? বিষয়টি এখনো প্রাথমিক অবস্থায় থাকলেও মৌসুমে গানার্সদের পারফরমেন্স এবং মালিকপক্ষের অবস্থানের কারণে এমনটি এখন বলাই যায়। এর আগেও বহুবার এমন গুঞ্জন ছড়ালেও সেগুলো তেমন শক্ত জমিন পায়নি ওয়েনগারের ওপর ক্লাবের অটল আস্থার কারণে। কিন্তু সেটিতেই যখন চিড় ধরেছে তখন নতুন মৌসুমে নতুন কারো হাতে গানার্সদের কৌশল নির্ধারণ হতে দেখাটা খুব একটা বিস্ময়কর হবে না। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ওয়েনগার এর সম্ভাব্য বিকল্পের সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করে ফেলেছে বোর্ড; যাতে নাম রয়েছে বর্তমান জার্মান কোচ জোয়াকিম লো, সেল্টিক ম্যানেজার ব্র্যান্ডন রজার্স, মোনাকো ম্যানেজার লিওনার্দো জার্দিম এবং সাবেক গানার্স অধিনায়ক এবং বর্তমানে সিটির সহকারী কোচ মিকায়েল আরটেটার নাম।

ওয়েনগার আমলে গেলো মৌসুমেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ালিফাই করতে ব্যার্থ হয় গানার্সরা। তখন গুঞ্জন উঠলেও অতীত রেকর্ড বিবেচনায় বোর্ড চুপচাপ ছিলো। কিন্তু চলতি মৌসুমের এ পর্যায়ে এসে এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে আসছে মৌসুমেও ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে এলিট আসরটিতে খেলা হবে না গানার্সদের। একমাত্র সম্ভাব্য উপায় ইউরোপা লিগ জেতা। সেটিও বর্তমানে অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে, অবস্থার উত্তরণে এমতাবস্থায় পরিবর্তনই অপরিহার্য পথ, এমনটাই ভাবছে বোর্ড।

সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ডের বিভিন্ন পদে আসা পরিবর্তন আর্সেনালে ওয়েনগারের বাইশ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্য অনেকটাই খর্ব করে দিয়েছে। যার নমুনা প্রকাশ্যেই দেখা গিয়েছে এ মৌসুমে। দলবদলের বাজারে বরাবরই খরচে অনাগ্রহী ওয়েনগার সাত মাসের মধ্যে দুইবার বাধ্য হয়েছেন ক্লাবের ট্রান্সফার ফি’র রেকর্ড ভাঙ্গতে। নতুন সভ্যদের দারা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও ওয়েনগারের আশার শেষ প্রদিপটি জ্বলে আছে ক্নাবের মেজর শেয়ার হোল্ডার ক্রর্নকির দিকে তাকিয়ে। কেননা শেষ পর্যন্ত ওয়েনগারের থাকা না থাকার সিদ্ধান্তটি তিনিই নেবেন। ক্রর্নকির সমর্থনে এর আগে দু বছরের জন্য আর্সেনাল ওয়েনগারের সাথে চুক্তি বাড়াতে বাধ্য হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আরো এক মৌসুম উচল এর বাহিরে থাকতে হলে ক্লাবকে মুখোমুখি হতে হবে বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির। বহু বছর ধরেই মেজর কোনো সাফল্য এনে দিতে না পারাটা এমনিতেই ওয়েনগারের জন্য একটি নেতিবাচক দিক, তার ওপর যদি যোগ হয় আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তখন ক্রর্নকির অবস্থান আগের মতন নাও থাকতে পারে।

এতদিন ক্রর্নকি ক্লাবের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনেকাংশেই ওয়েনগারের ওপর নির্ভর করলেও পরিস্থিতি যে বদলাচ্ছে তার আঁচ পাওয়া গিয়েছে ক্রর্নকির সন্তান জশের আচরণে, যিনি আর্সেনালের বোর্ড মেম্বার এবং রবিবার সিটির হাতে আর্সেনালের বিধ্বস্ত হবার দৃশ্যটি মাঠে বসেই দেখেছেন। ম্যাচের পরপরই জশ লন্ডন পৌছে আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেন ক্লাবের সমস্যাগুলো। এতদিন এসব থেকে দূরে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে জশের আচরণে এমিরেটসের অন্দরে সাম্ভাব্য পরিবর্তনের গুঞ্জন চলছে। টানা ব্যার্থতায় ক্লান্ত গানার্সদের অনেক খেলোয়াড়ই ক্লাব বদলের কথা ভাবছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। আর এমন গুঞ্জনই ক্রর্নকি পরিবারকে প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকার চারজনের বাইরে সাবেক আর্সেনাল কিংবদন্তি থিয়েরি অরির নামও শোনা যাচ্ছে সাম্ভাব্য কোচ হিসাবে। মোদ্দা কথা, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা এখন বলাই যায় যে, নাটকীয় কিছু না ঘটলে এ মৌসুমেই আর্সেনালে শেষ হচ্ছে আর্সেন ওয়েনগারের প্রায় দুই যুগের রাজত্ব।

১৯৪৯ সালের ২২ অক্টোবর জন্ম নেয়া ৬৮ বছর বয়সী এই ফরাসি কোচ কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন স্বদেশি ক্লাব ন্যান্সির হয়ে ১৯৮৪ সালে। সেখান থেকে মোনাকো, নাগোয়া গ্রান্টস এইট এর পর গানার্সদের দায়িত্ব নেন ১৯৯৬ সালে। সেই থেকে অদ্যাবধি একই পদে অাসীন তিনি। আর্সেন আর্সেনালের দায়িত্ব নেয়ার সময় এক ব্রিটিশ গণমাধ্যম শিরোনাম করেছিলো ‘আর্সেন কে?’। কালক্রমে সে আর্সেনেই এখন প্রিমিয়াল লিগে সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা ব্যাক্তি। ১৯৯৬ তে যখন দায়িত্ব নেন, তখন আর্সেনাল ছিলো মাঝারি মানের আর্থিক ভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল এক ক্লাব। দ্য প্রফেসর নামে পরিচিত এ ফরাসি পরবর্তী সময়টাতে আর্সেনালকে শুধু এলটি ক্লাবেই না, পরিণত করেছেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাবের একটিতে। আর্সেনালের ইতিহাসের সোনালী সময়ের রুপকারও তিনি। প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের একমাত্র গোল্ডেন লিগ জয়ী এ কোচের হাত ধরে উঠে এসেছেন পৃথিবী কাঁপানো বহু ফুটবলার। থিয়েরি অঁরি, ডেনিস বার্গক্যাম্প, রবি পিরেস, প্যাট্রিক ভিয়েরাদের নিয়ে গড়া তার দ্য ইনভিন্সিবল ফুটবলপ্রেমীদের কাছে চিরকালই হয়ে থাকবে এক মুগ্ধতার নাম।

ফলসর্বস্ব এ যুগেও দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের দর্শন আকড়ে ধরে থাকা এই আদমির বিদায়ে কারণ হিসাবে হয়তো ট্রফি জয়ে ব্যর্থতার কথা ফলাও করে প্রচার করা হবে। কিন্তু তাতে মুছে যাবে না আর্সেনাল এবং ইংলিশ ফুটবলে তার অবদান। রেফারিদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া বলুন অথবা আধা পেশাদার থেকে পুরো পেশাদার কাঠোমোতে আর্সেনালকে নিয়ে আসার কৃতিত্বই বলুন, ওয়েনগারকে মনে রাখার মতো বহু ঘটনাই ইতোমধ্যেই স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এটাই যদি তার শেষ মৌসুম হয়, তাতেও তিনি দেখিয়েছেন মাস্টার স্ট্রোক। প্রায় বিনামূল্যে হারাতে বসা সানচেজ এর বদলে মিখিতারিয়ানকে এবং জিরুড-বাতসুয়েসু-অবামেয়ঙ্গারের ত্রিমুখি চুক্তি সফলতার সাথে সম্পন্ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন ব্যবসাটা তিনি বেশ ভালোই বোঝেন। একটা ছোট্ট তথ্য উল্লেখ করি, প্রায় দু যুগে আর্সেনালে ওয়েনগারের খেলোয়াড় ক্রয়ের জন্য করা খরচ পাঁচ বছরেরও কম সময়ে টপকে গিয়েছেন সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। পেট্রো ডলারে যখন সাফল্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে তখন নিজস্ব দর্শন আকড়ে রাখা ওয়েনগারের জন্য কঠিনই সাফল্যর পথ খুঁজে বের করা।

এটা সত্য, ক্লাব সমর্থকরা গাটের পয়সা খরচ করে মাঠে যায় দলের জয় দেখার আশাতেই। এ যুক্তিতে গানার্স বোর্ড নতুন কারো হাতে দলকে তুলে দিয়ে তাৎক্ষণিক সাফল্য চাইতেই পারেন। তবে আর্সেনালের ইতিহাসে ওয়েনগার নামটা থাকবে অক্ষয় হয়ে। প্রিমিয়ার লিগটাও কেমন যেন নতুনই ঠেকবে। এ প্রজন্ম যে আর্সেনালের ডাগ আউটে ওয়েনগারকে ছাড়া আর কাউকে দেখেইনি।