সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নুরুল হকের যে জনপ্রিয়তা ও বারবার ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে যেভাবে দাঁড় করিয়েছেন তা সত্যিই বিষ্ময়কর। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। নির্বাচনের অনিয়ম সবাই দেখেছেন। ছাত্রলীগ বাদে সবাই নির্বাচন বর্জন করেছেন। ছাত্রলীগের মার খেয়ে নুর হাসপাতলে ছিলেন নির্বাচনের দিন।
এমন নির্বাচনে নুরকে ভিপি পদে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে আসলে ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত সমিকরণটি নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ভিপি পদে নুরু পেয়েছেন ১১ হাজার ৬২টি ভোট। কিন্তু তার প্যানেলের জিএস রাশেদ হেরে গেছেন।
গত রাত সোয়া ৩ টায় ঘোষিত ফলে দেখা যায়, ভোট বর্জন করেও সহ সভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন নুরুল হক। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানীসহ সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) হয়েছেন সাদ্দাম হোসেন। ডাকসু’র মোট ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই ছাত্রলীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচন যে ডাকাতির উৎসব ছিল তা সারাদিনই মিডিয়াতে সবাই দেখেছেন। এমন নির্বাচনে নুরকে ভিপি নির্বাচিত করার কারণ কি? এই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে সবার মনেই। কেউ কেউ বলছেন ডাকাতি না হলে নুরদের প্যানেল আরও বিপুল পদে জয়ী হতো। এবং স্বয়ং নুরও মিডিয়ার সামনে সে কথা বলেছেন।
যেখানে নুর ভিপি হয়েছে অথচ তার প্যানেলে আখতার হোসেন ব্যাতিত অন্যরা গোনার মতো ভোট পায়নি এটাই এই প্রশ্নকে উস্কে দিচ্ছে। তাছাড়া নির্বাচনের পরে নুরকে ছাত্রলীগের বরণ করে নেয়া এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, যিনি নুরুর কাছে হেরে গেছেন। তার বন্তব্য থেকে এটা পরিস্কার হয়েছে যে নুরকে ভিপি করার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এক. নির্বাচনকে জায়েজ করা
দুই. আন্দোলনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়া
তিন. নুরকে ছাত্রলীগের ভেতরই রাখা
এক.
নির্বাচনের তফিসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। বিরোধী সংগঠনের দাবি-দাওয়ার তোয়াক্কা না করে হলে রাখা হয়েছিল ভোটকেন্দ্র। এছাড়া আচরণবিধি ভাঙার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি শোভনের বিরুদ্ধে। েএছাড়াও যে পরিমাণ অনিয়ম ঘটেছে তাতে নির্বাচন প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে বাঁচতে নুর’র মতো জনপ্রিয় প্রার্থীকে ভিপি করে নির্বাচনকে জায়েজ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে প্রশাসন-ছাত্রলীগ।
দুই.
অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচনের ঘন্টা খানেক আগেই ভোট বর্জন করে ছাত্রলীগ ব্যাতিত অন্যান্য সবগুলো প্যানেল। এবং নুর’র উপর হামলা করে বসে ছাত্রলীগের নারী কর্মীরা। তাকে যেতে হয় হাসপাতালে। এ অবস্থায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতা রাশেদ, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের লিটন নন্দী, ছাত্র ফেডারেশন’র উম্মে হাবিবা বেনজির আর স্বাধিকার স্বতন্ত্র প্রার্থী অরণি সেমন্তির নেতৃত্বে বিক্ষোভে পেটে পড়ে ক্যাম্পাস। ঘোষিত হয় ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি। গর্জে ওঠা এই সময়ে আন্দোলনকে স্থবির করাটা জরুরি। নির্বাচনের পরে সেই চালটাই দিয়েছেন শোভন।
তিন.
নুর কোটা সংস্কারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুই’ই তুঙ্গে। ছাত্রলীগ তাই নুরকে সরিয়ে নিজেদের ছায়ার নিচে রাখতে ব্যস্ত। নির্বাচনে শুধু তাকে জয়যুক্ত করার মধ্য দিয়ে প্রশাসন-ছাত্রলীগ সেই ছকটাই কষেছে।
এখন দেখার বিষয় নুর কি করেন? তবে এই ভিপি পদকে কুরবানি দিয়ে ছাত্রলীগের একজন নেতার ভিপি হওয়ার সুযোগ হয়তো বন্ধ হল। কিন্তু এর মধ্যদিয়ে ছাত্র আন্দোলনের সংকট মোকাবেলা করার সহজ পথটিই ক্ষমতাসীনরা বেছে নিল। অন্যদিকে নুরুদের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হল। আদর্শবাদী যে ইমেজ নিয়ে নুররা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল তার গোঁড়ায় কুঠার মারার কাজটিই ছাত্রলীগ করার চেষ্টা করছে।
সাবধান হতে হবে নুরকে। সাধারণ শিক্ষার্থী পরিষদের এজিএস প্রার্থী ফারুক হোসেন বলেছেন, নুর ভিপি’র শপথ নেবে কি না সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। সংগঠনের অবস্থান পরে জানানো হবে। এখানেই শঙ্কা, নুরকে কি তাহলে সংগঠন থেকে ছিটকে পড়তে হচ্ছে? যদি সেটাই হয়, তবে অতলে হারিয়ে যেতে হবে এই তরুণ নেতাকে। কেননা, যে শিক্ষার্থীদের সমর্থনে আজ ডাকসু’র ভিপি হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন তিনি। তারাই তাকে প্রত্যাখান করবে। উচিত হবে, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
জাতীয় নির্বাচনেও দেখা গেছে সরকার নিজেদের তৈরি বিরোধী শক্তির মাধ্যমেই একদলীয় শাসন সুন্দরভাবে কায়েমের পথে সফল হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির বেলাও এই একই কৌশল কাজে লাগিয়ে শেষ রক্ষা হবে কি না তা বলার সময় এখনও আসে নি! নুর ভিপি হিসেবে ছাত্রলীগের মনমত দায়িত্ব পালন করেন নাকি সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে আন্দোলনের মাঠে থাকেন সেটাই এখন দেখার বিষয়! তবে ইতিমধ্যে এই নাটকীয়তা নির্বাচন নিয়ে জনগনের আগ্রহ ও আশার অবসান ঘটিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠকেও দেখতে হলো একটি পাতানো নির্বাচন। কিন্তু নাটকীয়তার শেষটা আসলে কোথায় তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নুরকে নেতৃত্ব দিতে হবে ঠিকই কিন্তু ছাত্রলীগের ছায়ায় থেকে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন নিয়ে!
আজ ক্যাম্পাসে ফিরে নুর প্রথমে বলেছিলেন, ভিপি এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদ ছাড়া বাকি পদগুলোতে নির্বাচন চান। সেটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক হলেও, প্রকৃত অর্থে না। বরং সবিশেষ তিনি বলেছেন, সবগুলো পদেই পুনরায় নির্বাচন দিতে হবে। এখানেই অটল থাকতে হবে। এটাই মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।