২০ ফেব্রুয়ারি, বুধবার, রাত্রি দশ ঘটিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জোর কদমে চলছে পরবর্তী দিনে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি। স্বভাবত শহিদ মিনারে তখন সাজো সাজো রব। ঠিক সেই সময়েই প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চকবাজার চুড়িহাট্টা অতর্কিত অগ্নিকাণ্ডে হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী! স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, চুড়িহাট্টা মোড়ের যানজটে ঠাসা সংকীর্ণ গলিতে প্রথমে বিস্ফোরিত হয় একটি পিকআপ সিলিন্ডার, জ্বলে ওঠে লেলিহান অগ্নিশিখা। আগুনের তাপে নিকটবর্তী রেস্তোরাঁয় মজুত পাঁচ-ছয়টি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ার ফলে আরও দ্রুত ছড়িয়ে যায় আগুন, তারপর প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় রাস্তার ধারে পোস্টের ওপরের একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার। ততক্ষণে কাছাকাছি পাঁচ-ছয়টি বহুতল আবাসন আগুনের গ্রাসে, তার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহিদ ম্যানসন। খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আবাসিক এবং পথচলতি মানুষেরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৮১টি মৃতদেহ, অন্তত ৫০-৬০ জনকে পাঠানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। অগ্নিদগ্ধ অধিকাংশ মানুষের অবস্থা গুরুতর আশঙ্কাজনক, জানিয়েছেন চিকিৎসকগণ। রবিবার পর্যন্ত আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে, জানা গিয়েছে স্থানীয় সূত্রে।
পুরনো ঢাকার চকবাজার আয়তনে-চেহারায় অনেকটা কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটে বড়বাজারের মতো। যাতায়াতের রাস্তা সংকীর্ণ, সেই রাস্তায় মানুষের ভিড় ঠেলে এগোয় পিকআপ ভ্যান, মোটরবাইক। চকবাজারেও ঘিঞ্জি বহুতলের নিচুতলায় রাসায়নিক দ্রব্য, সুগন্ধী প্রস্তুতকারী কারখানার পাশাপাশি ছিল প্রসাধনী, কাপড়ের দোকান এবং গুদাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলে সপরিবার বসবাস করত ঢাকার বাইরে থেকে আগত শ্রমিকগণ। সরকার সূত্রে জানানো হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অধিকাংশ কারখানায় বানানো হত নকল সামগ্রী। গত সপ্তাহেও বাহিনী নিয়ে খোদ মেয়র এসে ওই এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামগুলি সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা হাসপাতাল গিয়ে শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, “নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।” তার নির্দেশে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়, সমস্ত সরকারি, আধা-সরকারি দফতর এবং প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। শেখ হাসিনা আক্ষেপ করে বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ড ঘটার আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারখানা, গুদাম সরানো হবে। কিন্তু, কেউ তখন রাজি হয়নি। আমরা আধুনিক গুদাম তৈরি করে দিতে চাইলেও মালিকেরা রাজি হননি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য! চকবাজারে কীভাবে আগুন লেগেছে তা তদন্ত করে দেখার পাশাপাশি সব প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হবে। পুরনো ঢাকার সংকীর্ণ রাস্তাগুলো নতুনভাবে গড়তে হবে।” প্রত্যক্ষদর্শী মানুষদের বক্তব্য, খবর পেয়ে প্রথম দফায় দ্রুত দমকল বাহিনীর ১০টি ইঞ্জিন এসেও সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে আগুন নেভাতে হিমশিম খেয়ে যায়, পরে আরও ২৭টি ইঞ্জিন আনা হয়। গভীর রাতে শ-দুয়েক দমকল বাহিনীর সদস্য কয়েক ঘন্টার প্রাণপণ লড়াইয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে খানিকটা দম নেয়, তারপর হঠাৎ একটি গুদামে মজুত কয়েকটি সিএনজি জার ফেটে গিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। জরুরিভিত্তিক হাজির হয় চারটি হেলিকপ্টার, আকাশ থেকে জলের ফোঁয়ারা ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর এগারোটা নাগাদ দমকল বাহিনী ঘোষণা করে, আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে। দমকল বাহিনীর সদস্যগণ প্রাণ বাজি রেখে যেভাবে আগুন নিভিয়েছে, তাদের প্রাণ খুলে কুর্নিশ করতেই হয়!
চকবাজারের নিকটবর্তী পুরনো ঢাকার নিমতলী এলাকায় ২০১০ সালের ৩ জুন ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছিল ১২৪ জন মানুষের। ভবিষ্যতে যেন এমন লঙ্কাকাণ্ড দেখতে না হয়, সেই বিষয়ে প্রচারেও খামতি হয়নি। তারপরও সচেতনতা তৈরি হয়নি জনগণমনে। সংকীর্ণ গলি, ঘিঞ্জি বহুতল যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে, বুঝতে নারাজ জনতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বলেছেন, “পুরনো ঢাকার নিমতলীর ঘটনার পর আরও সতর্কভাবে নজরদারি চালানো হলে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল প্রাণহানি হয়তো এড়ানো যেত। দেশে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষমতাসীন সরকার দায় এড়াতে পারে না। এটা তো সত্য কথা। কিন্তু জনসাধারণ যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও সচেতন হওয়া আবশ্যক। কারণ, তাদের এখানে জীবিকার চেয়ে জীবনের ঝুঁকি বেশি। সেখানে সচেতনতাও একটা ব্যাপার ছিল।” আমজনতা অভিযোগের আঙুল তুলছে সরকারের দিকে। তাদের বক্তব্য, প্রতিটি উন্নত দেশের শহরে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকে যা দ্রুত গতিতে পানি ছিটিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নেভাতে সক্ষম। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডরিক গ্রাফ সিনিয়র এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রটি আবিষ্কারের ২১৮ বছর পরও বাংলাদেশের সব জনবহুল শহরে দেখা যায় না; একমাত্র চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটি আছে। উন্নত শহরগুলোতে ‘এলিড ফায়ার’ অগ্নিনির্বাপক বল ব্যবহৃত হয়, যা চোখের পলকে নিভিয়ে দেয় বড় আকারের আগুনের হলকা। আমজনতার আক্ষেপ, উন্নত দেশগুলো থেকে আমরা নিরাপত্তায় কয়েক যোজন পিছিয়ে রয়েছি, অথচ আমাদের সরকার এই বিষয়ে সচেতন নয়।
বাঙালি বরাবর বিতর্কপ্রিয়। এই অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গেও বহু কাহিনি সামাজিক মাধ্যমে এবং লোকমুখে ঘুরপাক খাচ্ছে। চকবাজারের একটি মসজিদে নাকি আগুন নেভানোর জন্য পানি চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু পানি দিতে অস্বীকার করেন মসজিদের ইমাম। যারা ইসলামবিদ্বেষী, তাদের কাছে এই অভিযোগ ইসলাম ধর্মকে কালিমালিপ্ত করার মহা সুযোগ! তারা বলছেন, ইসলাম ধর্ম কোনও কালে মানুষের কল্যাণে ভূমিকা গ্রহণ করেনি। “ফজরের ওজু করতে পানি লাগবে” অজুহাতে ইমাম পানি দেয়নি, এই অভিযোগের সত্যাসত্য এখনও জানা যায়নি। যদি সত্যিই অভিযোগ সত্য, তবে যুক্তিবাদী আস্তিক হিসাবে আমার দাবি, তিনি নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য কাজ করেছেন, যার জন্য ইসলাম ধর্ম বিন্দুমাত্র দায়ী নয়। ইসলাম ধর্ম কোনও কালে মানবতাবিরোধী এবং জনকল্যাণ-পরিপন্থী নয়। তাই, এই অভিযোগের দায় কেবল ওই ইমামের ওপর বর্তায়। ভয়াল অগ্নিকাণ্ডে অক্ষত কোরআনের এবং আরবি-উর্দু বাক্য লেখা কিছু ছবিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা হচ্ছে ইসলাম ধর্ম এবং আল্লাহর মহিমা প্রচার করার লক্ষ্যে। এই প্রয়াস কোনও দুর্ঘটনায় শোকস্তব্ধ অঞ্চলে অত্যন্ত বেমানান। এই প্রয়াস অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের নিকট যে ধর্মকে খেলো করে, সন্দেহ নেই! যারা আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা তথা নবী-রসুল ছিলেন, তাদের জীবনে বহু ‘মুজেজা’ অর্থাৎ অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে, যা বর্তমান সময়পর্বে নাস্তিক মানুষদের নিকট অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর। তাই, সচেতন মুসলিম এহেন আল্লাহর গরিমা-মহিমা প্রচারে বিরত থাকলে তা ইসলাম ধর্মের জন্য কল্যাণকর হয়!
আত্মজনের মৃত্যু ভীষণ বেদনাদায়ক! চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে বেশ কিছু পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তাদের দুঃখ বেটে নেওয়ার নয়, তাদের সান্ত্বনা দেওয়ারও ভাষা নেই। তবে, এই দুঃখের আবহে আপামর জনতাকে শপথ নিতে হবে, লাশের মিছিল বারবার দেখব না! বাঙালি জাতির মনের মণিকোঠায় একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি শপথের, স্বীকৃতির, সংগ্রামের প্রতীক। চলতি বছরের এই দিনটিতে যে-ভাইবোনদের জানাযা পড়লাম আমরা, সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে আমরা সামাজিক কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। সরকার পক্ষ এবং আমজনতা ও কারখানা কর্তৃপক্ষ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করলে সমস্যার সমাধান হবে না। সরকার এবং জনতা দুই পক্ষ উপলব্ধি করুন, কোন ক্রুটি এবং গাফিলতির কারণে এত ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড ঘটল, তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে সংশোধিত হয়ে যান। নইলে, আবার দেখতে হবে এমনতর লঙ্কাকাণ্ড!
প্রথম দফায় যে ৬৭টি মৃতদেহ শনাক্ত করা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৪৬টির পরিবার মৃতদেহ শনাক্ত করতে পেরেছে। ওই ৪৬টি মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে জানাযা সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট লাশগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছে, দেখে চেনার উপায় নেই। তাই পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ নেওয়া হচ্ছে নিখোঁজ মানুষের স্বজনদের। সিআইডি–র সহকারি ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন বলেন, “শুক্রবার পর্যন্ত আমরা ২০ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি। আমাদের একটি অত্যাধুনিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে এই নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হবে। নিহতদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে স্বজনদের ডিএনএ মিলে গেলেই পুলিশের মাধ্যমে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।” অনেক অবোধ বালক-বালিকা তাদের পিতা-মাতার লাশ চেনার জন্য ডিএনএ দিচ্ছে, এ দৃশ্য ভীষণ মর্মভেদী এবং বেদনাদায়ক! এরপরও আমরা নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন হতে না পারলে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার!