বিডিআর বিদ্রোহ’র পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থা

বিডিআর বিদ্রোহ’র পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থা

দেখতে দেখতে কেটে গেছে দশ বছর। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ শিরোনামে হত্যা করা হয় ৫৭জন উচ্চপদস্থ এবং প্রশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তাকে। এছাড়া মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৭৪। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে কয়েকবার বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলেও এটি ছিল সবচেয়ে নৃশংস।

বিডিআর বিদ্রোহের পরপরই বাহিনীটিকে ডিজব্যান্ড বা বিলুপ্ত করা হয় এবং ‘বিজিবি’ নাম দিয়ে বিডিআর’র অর্পিত দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। বিজিবি বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষার কাছ করছে। সেই সাথে শুরু হয় বিদ্রোহীদের বিচার কাজ। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মোট ১৫২ জনকে। পরবর্তীতে হাইকোর্ট ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যহতি দেয়। যার মধ্যে ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়। এই মামলায় মোট ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

তৎকালীন সময়ে বিডিআর এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, মূলত বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ থেকে বিদ্রোহের শুরু হলেও মূহুর্তে তা নৃশংস হত্যাকাণ্ডে পরিণত হয়। সে সময়ে বাহিনীতে পরিচালিত ‘ডালভাত’ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে জওয়ানরা। এই নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিদ্রোহের দ্বিতীয় দিনে কর্মকর্তাদের স্বজনদের ছেড়ে দেয়া হয় এবং একের পর এক কর্মকর্তাদের লাশ উদ্ধার হতে থাকে। তখনই সন্দেহের সূত্রপাত ঘটে। হামলার পরপরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে বিবৃতি আসে যে, ঐ বিদ্রোহ ছিল শ্রেফ তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। তাদের ক্ষমতায় আসার ৪০ দিন পরেই তাদের সরকার হটাতেই করা হয় ঐ ষড়যন্ত্র। ওই বিদ্রোহের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রণব মুখার্জীর কাছে ফোন করেছিলেন। ভারতের কাছে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সাহায্য! এতে বিডিআর বিদ্রোহের রহস্য আরো ঘোলাটে হতে থাকে। যদিও সেই রহস্য সময়ের পাতায় এখন সম্পূর্ণ মলিন।

বিডিআর বিদ্রোহ ছিল একটি দীর্ঘ সময়কার পরিকল্পনার ফসল। জওয়ানদের উত্তেজিত করার জন্য অনেক আগে থেকেই লিফলেট বিতরণ করা হয় বলে জানা যায়। সংবাদ বিবিসি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিডিআর’র সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম বলেন “লিফলেটের ভাষা ছিল খুবই কঠোর। কুকুরের মত গুলি করে মারা হবে। এই লিফলেট কে কেন এত আন্ডার প্লে করা হল?” তার এই ভাষ্য থেকেই বোঝা যায় পিলখানার ঐ হত্যাকাণ্ড আর যাই হোক এর পেছনে গভীর কোন ষড়যন্ত্র ছিল যা শুধুই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোন বিষয় নয়। হামলা চলাকালীন অবস্থায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে যেভাবে প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে দেখা যায় এরপর কোন অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আর কোনরকম মুখ খুলতে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগপন্থী অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এভাবেও বলার চেষ্টা করেছে যে এই বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের সকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তবে সময় গড়ানোর পর দেখা গিয়েছে তেমনটা নয়। বরং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই এখন সরকারের এক নিরব কিন্তু একনিষ্ঠ সমর্থক। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা নিয়ে অনেকেই হতাশ। তবুও বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তাদের একটি কেন্দ্রীয় তদন্ত জনগণের সম্মুখে প্রকাশ করার দরকারবোধ করেছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ক্ষোধ সাধারণ জনগণ। সে সময় ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব শিব শংকর মেনন বলেন “এই ঘটনায় শেখ হাসিনার সাথে সেনাবাহিনীর একটি ঝামেলা তৈরি হবে।” যদিও সময়ের পরিক্রমায় তেমন কিছুই ঘটেনি যা খুবই সুখকর বিষয়। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই বিষয়টি লক্ষ্যকরা উচিৎ ছিল যে ঐ বিদ্রোহের অনেক আগে থেকেই যখন জওয়ানদের কাছে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছিল তখন সশস্ত্রবাহিনীর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ আভ্যন্তরীণ বাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছু আন্দাজ করতে কেন পারে নাই। এই ব্যাপারগুলো কি আদৌ ব্যর্থতা নাকি নিরবে থেকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠিত, নিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খল বাহিনী। এই বাহিনী শুধুই বাহিরের দেশগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতেই না বরঞ্চ দেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ও গর্বিত। কোন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গুঁটি হয়ে নয় বরং নিজেদের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর উচিত বিডিআর বিদ্রোহের নিরপেক্ষ তদন্ত উপস্থান করা উচিত। কেবল একটি আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এত বড় নৃশংসতায় রূপ নিতে পারে না।

প্রশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তাদের এমন নিহত হওয়াটা যে কোন দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য বিপদজ্জনক যা ওই বাহিনীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য কৌশলগতভাবে পিছিয়ে পড়তে হয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রের একই রকম ঘটনা ঘটেছে। দেশের চরম রাজনৈতিক সংকটেও তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোলাচলে ভুগছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দিকেও ঝুঁকে পড়ছে।