ধর্ষণের মূল কারণ যৌনতা না, ক্ষমতা ?

ধর্ষণের মূল কারণ যৌনতা না, ক্ষমতা ?

জবান এখনও পর্যন্ত ‘ধর্ষণ’ বিষয়ে দু’টি মৌলিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একটির শিরোনাম, ‘ধর্ষণ নারীবাদ ও ক্ষমতা’; অন্যটি মার্কিন লেখিকা সান্ড্রা নিউম্যান’র ‘হোয়াই ম্যান রেপ’র অনুবাদ; যার শিরোনাম ‘পুরুষ’ ধর্ষণ করে কেন?’। নিবন্ধ দু’টির মধ্যে ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং কারণ সম্পর্কিত বিস্তর আলোচনা রয়েছে। যা থেকে এটি স্পষ্ট যে ধর্ষণের সাথে যৌনতার চেয়ে ক্ষমতার বিষয়টিই বেশি জড়িত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এখন একই সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ তাদের সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন। যেখানে দেখা যায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ১৮২ জন নারী গণধর্ষণ, ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৮৯৭টি ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। ২০১৭ সালে এই সর্বসাকুল্যে এই ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন; যার মধ্যে ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে ধর্ষণের সংখ্যা এবং ধর্ষণজনিত হত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ২০১৭ সালেই যখন ধর্ষণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছিল সরকারের উচিত ছিল তা নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নেয়া। এগুলো প্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন। ধারণা করা যায় প্রায় এর দ্বিগুন ঘটনা তেকে যাচ্ছে মিডিয়া ও জননজরদারির আওতার বাইরে। ফলে সব মিলিয়ে বিবেজনা করলে পরিস্থিতিতে কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একদিন পরই আমরা ক্ষমতার সেই আস্ফালন দেখতে পেয়েছিলাম। প্রতিপক্ষের প্রতীকে (ধানের শীষ) ভোট দেয়ায় গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল তিন সন্তানের জননীকে। আর প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের লিপ্সার শিকার হতে দেখা অসহায় জনগণকে। রেললাইনে আত্মহত্যা করতেও দেখা গেছে বিচার না পাওয়া পিতা-কন্যাকে। তনুর হত্যার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ’২০ হাজার’ টাকা! লাগামহীন এই প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে যেখানে পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেখানে বহুব্যক্তিই সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং তাদের ছত্রছায়ায় থেকে এই সমস্ত অপরাধ করছে । যার কারণে সুবিচার থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

প্রতিপক্ষের প্রতীকে (ধানের শীষ) ভোট দেয়ায় গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল তিন সন্তানের জননীকে। আর প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের লিপ্সার শিকার হতে দেখা অসহায় জনগণকে। রেললাইনে আত্মহত্যা করতেও দেখা গেছে বিচার না পাওয়া পিতা-কন্যাকে। তনুর হত্যার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ’২০ হাজার’ টাকা! লাগামহীন এই প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে যেখানে পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেখানে বহুব্যক্তিই সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং তাদের ছত্রছায়ায় থেকে এই সমস্ত অপরাধ করছে ।

 

ধর্ষণের এই হার যে ২০১৯ সালে মহামারি আকার ধারণ করবে না তার নিয়শ্চয়তা কোথায়। বছরের প্রথম মাসের দিকে তাকালেই সে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। শ্রেফ জানুয়ারি মাসেই দেশে ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২টি; যার মধ্যে ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।

এসব ঘটনা চাপা দেয়ার বিষয়টি মোটামুটি আমাদের জানা। এর পিছনে কাজ করে রাজনৈতিক প্রভাব, সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি পৃথক  ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ৩ জন আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যা। যাতে তার ধর্ষণের আসামি স্বীকারোক্তি সম্বলিত চিরকুট ছিল। ধারণা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই এই ঘটনার সাথে যুক্ত। বিষয়টি বাহবা পেলেও এর পিছনে কাজ করে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’। কোন ক্ষেত্রেই এই ধরণের হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা। এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদের শাস্তি বিধান করা।

ধর্ষকদের শাস্তি বিধান করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। পাকিস্তানের ছয় বছরের কন্যাশিশু জয়নাব আনসারি’র ধর্ষক ইমরান আলী’র (২৪) শাস্তি উদাহরণ হয়ে আছে। যাকে জয়নাব আনসারির পিতার সম্মুখে ফাঁসি দেয়া হয়। সরকার চাইলে যেমন ধর্ষককে আশ্রয় দিতে পারে, তেমন তাদের শাস্তির বিধানও করতে পারে। প্রয়োজন সদিচ্ছার।

রাজনৈতিক আধিপত্য ও স্থানীয় মিটমাটের বাইরে এসে যখন মামলা হয়; সে ক্ষেত্রেও দেখা গেছে জটিলতা। দেখা গেছে, যে পরিমাণ মামলা হয় চার ভাগের এক ভাগের বিচার সম্পন্ন হয়। এবং বিচার হওয়া মামলার ১০ ভাগের ১ ভাগ সাজাপ্রাপ্ত হয়। ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’র এক হিসাব মতে, ২০০১-২০১৭ (মার্চ) পর্যন্ত মোট ধর্ষণের মামলা হয় ৪৩৬১টি, বিচার সম্পন্ন হয় ৫৭৮টির এবং সাজা হয় মাত্র ৬৪টি মামলায়।প্রায়ই ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয় ধর্ষণের ভিকটিম। ঝুলিয়ে রাখা হয় মামলা, কোন কোন মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে লেগে যায় ২০ বছরও।আলোচিত তনু হত্যা মামলায় ঝুলে রয়েছে প্রায় ৩ বছর।

জানুয়ারি মাসেই দেশে ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২টি; যার মধ্যে ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।

 

মূলত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে আসতে না পারলে ধর্ষণের শাস্তি বিধান করা সম্ভব না। আর শাস্তি দেয়া সম্ভব না হলে, ধর্ষণও ক্রমাগত সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এবং একটা সময় তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করবে।

তাই মুখরোচক গল্প দিয়ে ধর্ষকদের বিনা বিচারে হত্যা করে আরও একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বৈধতা উৎপাদনের যে কু-কৌশল তা আমাদের আরও বিপদের দিয়ে নিয়ে যাবে। দেখা যাবে টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক শত্রুকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। ফলে এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আরও একটি অপরাধ সংগঠনের জনসম্মতি আদায়ের কু-কৌশলকে প্রশয় দেয়া ঠিক হবে না। এখনই সময় নগরিকদের সচেতন হওয়ার। এবং ধর্ষণের সাথে যে মূলত ক্ষমতার সম্পর্ক তা পরিস্কার করার। এবং এই ক্ষমতার বৈধতা না আসলে এই ধরণের অপরাধের বিস্তার রোধ করা যাবে না। কাজেই মূল জায়গায় ফোকাস না করে মিডিয়ার গৎবাধা খবর থেকে কোন সমধান আসতে পারে না। দরকার নাগরিক প্রতিরোধ।