বনের শাল গাছ কাটতে বনে ঢুকে কিছু চোরাকারবারি। গাছে কয়েক কোপ দিতেই কাচি ও লাঠি-সোটা নিয়ে তেড়ে আসে কিছু মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ নারী। বাধা দেয় বনসন্ত্রাসীদের। তারাও হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। বলে, “তোমরা তো আর গাছগুলোর মা না যে আগলে রাখতে পারবে”। প্রত্যুত্তরে জবাব আসে “নিজের মাকে কিভাবে রক্ষা করতে হয় আমরা জানি”।
লড়াইয়ের এই দৃশ্য দেখা গেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাকুরা জেলার হাকিম সিনান রানিবন্ধ ব্লকের বনাঞ্চলে বাস করা সাঁওতাল নারীরাই এই লড়াইয়ের যোদ্ধা। আদিকাল থেকেই এই সম্প্রদায়ের বাস বনভূমির সীমানায়। তাদের সংস্কৃতিতেই গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এই বনাঞ্চল। যুগযুগ ধরে এই জঙ্গলের সাথে তাদের সম্পর্ক সন্মান ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আছে। এই বন থেকে চলে তাদের জীবন-জীবিকা। বনের পাতা, জ্বালানি কাঠ, মধু সংগ্রহ করেই চলতে হয় তাদের। তাছাড়া তাদের বিশ্বাস মতে, এই বন তাদের অনেক দেব-দেবীর আবাসস্থল। আর সাওতালরা সেখানে গর্বের সাথেই নিজেদের জংলি হিসেবে দাবি করে। নারীদের সাথে এই বনের বন্ধন আরো শক্তিশালী। এই বন মায়ের মত তাদের লালন করেছে, করছে।
তাদের বনরক্ষার আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। রাত জেগে পাহারা দিতো নারীরা। এক রাতে হামলা হল তাদের উপর। চোরাকারবারিরা গলা কেটে হত্যা করলো লক্ষিনি সড়েন নামের একজন নারীকে। খবর পাওয়ার পরেই শত শত শাওতাল নারী কাচি-ছুরি, লাঠি-সোটা নিয়ে হামলে পড়ে ওই সন্ত্রাসীদের উপর। তারা সবাই রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল। এভাবেই বনদস্যুদের ভাগিয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। তাদের লড়াই বিচ্ছিন্ন ছিল, ততটা সংগঠিতও ছিল না। তবে এর পরেই নানা এনজিও আর বন অধিদপ্তর তাদের সাহায্যে এবং বন রক্ষায় এগিয়ে আসে। এভাবেই লড়াইয়ের সাফল্য এসেছে তাদের জীবনে।
বনাঞ্চল রক্ষায় সকল দেশই সোচ্চার হচ্ছে। বন রক্ষাই না অনেক দেশে শুরু হয়েছে বনায়ন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। তার পরপরই ভৌগলিক কারণে ক্ষতি হবে পশ্চিমবঙ্গে। তাদের প্রশাসন, জনগণ ব্যপারটা নিয়ে যথেষ্ঠই ওয়াকিবহাল। বাকুরার সাঁওতাল জনগোষ্ঠির লড়াইয়ের মাধ্যমেই তা লক্ষ্য করা যায়। তবে বন ও বনাঞ্চল রক্ষায় পিছিয়ে আছি আমরা। উজাড় হচ্ছে বন। গাজীপুর ভাওয়াল আর ঢাকার আশেপাশে কথা বলাই বাহুল্য। তবে সুন্দরবনও আজ ধ্বংসের মুখে। হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র! কয়লা মানেই পরিবেশ ধ্বংস। সারাবিশ্ব তা জানে। জানে না শুধু বাংলাদেশ সরকার। আন্দোলন হচ্ছে তবে কারো কোন যায় আসে না। যায় আসে না জনগণের। সুন্দরবনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি, তাদের রাজত্বে হচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র। ধ্বংস হচ্ছে বন, উজার হচ্ছে আদিবাসীদের ঘর-পরিবার। বাকুরা থেকে বান্দরবন সেখান থেকে সুন্দর বন, প্রাণ- প্রকৃতি- বৃক্ষ- মায়ের জন্য লড়াই চলুক সব খানে। জীবন্ত হয়ে উঠুক সবুজ এই পৃথিবী।