ইউনাইটেড ইন্ডিয়া। ঐক্যবদ্ধ ভারত। সমস্ত বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে এক স্লোগানে এক সূত্রে বাঁধতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উদ্দেশ্যে ১৯ জানুয়ারি তার ডাকে আয়োজিত কলকাতার ব্রিগেড ময়দানের জনসভায় তেইশ কণ্ঠের অভিন্ন সুর সমগ্র ভারতকে শক্তিশালী বার্তা দিল- সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারকে উৎখাত করতেই হবে! কলকাতার বুকেই গত বছরের ২১ জুলাই সমাবেশে মমতা আঞ্চলিক দলগুলিকে সম্মিলিত করে ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ গঠন করার আবেদন জানান। তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দল যেখানে শক্তিশালী, সেই দল নিজ এলাকায় লড়াই করুক বিজেপির বিরুদ্ধে, অপরাপর রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থন করুক। যদি জোটবদ্ধ না-হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলি আলাদা লড়াই করে, ভোট ভাগ হবে; ফলস্বরূপ লাভবান হবে বিজেপি। ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলা যদি কার্যকর করতে পারে মহাজোট, তবে বিজেপিকে হারানো সম্ভব। ব্রিগেড সমাবেশে মমতার এই ফর্মুলা সিলমোহর অর্জন করল ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে আগত সকল নেতার বক্তব্যে। ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াইয়ের তত্ত্বে স্বীকৃতি দিয়ে প্রাক্তন বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহা বলেন, “বিরোধী মহাজোট সর্বত্র বিজেপির বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে সমর্থ হলে বিজেপি সাফ হয়ে যাবে!” প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইড ডি দেবগৌড়া বলেন, “লোকসভা নির্বাচন মাত্র দুই মাস পর। জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীদের বলব, একটা ইস্তাহার তৈরি করুন- ন্যুনতম সাধারণ কর্মসূচি। আঞ্চলিক দলগুলি আসন রফা নিয়েও কথাবার্তা শুরু করে দিক।” প্রবীণ নেতা ফারুক আব্দুল্লা বলেন, “ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতেই হবে। দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে মহাজোট তৈরি করতে পারলে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে।” আরও এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অরুণ শৌরিও বলেন, “বিজেপিকে হারাতে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী করতেই হবে। আঞ্চলিক দলগুলো যেন বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে অঙ্ক না কষে।” বিজেপি সরকারকে হঠাতে যে মহাজোট পণবদ্ধ, কলকাতার ব্রিগেড মঞ্চে কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী- ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীর অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি তা প্রমাণ করল। পাশাপাশি, বিজেপি-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল অবস্থান স্পষ্ট করল এই মুহূর্তে মহাজোট শিবিরের জন্য ‘অবান্তর’ একটি প্রশ্নের। মহাজোট জয়লাভ করলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- রাজনৈতিক অলিন্দে ঘুরপাক খাওয়া এই প্রশ্নের উত্তরে মমতা ব্রিগেড মঞ্চে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, “এই জোটে আমরা সকলেই প্রজা। কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা এখন ভাবার দরকার নেই। সেটা আমরা সকলে মিলে পরে ঠিক করব। বিজেপির বিরুদ্ধে এখন লড়াই হবে যৌথ নেতৃত্বে।” কাশ্মির থেকে আগত ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আব্দুল্লা সমাবেশে বলেন, “কেউ যেন না ভাবেন আমি প্রধানমন্ত্রী হব! ওটা পরে দেখা যাবে। এখন একজোট হয়ে দেখাতে হবে।” প্রাক্তন বিজেপি অরুণ শৌরিও সতর্কবার্তা দিয়েছেন, “আত্মত্যাগের ভাবনা মাথায় রেখে এগোতে হবে। যদি কেউ মনে করে, ওরা ৪০টি আসন পেয়েছে এবং আমরা ৪৫টি আসন পেয়েছি, অতএব আমাদের দলের প্রধানমন্ত্রী হোক- এমন মানসিকতা নিয়ে চলা যাবে না।” এনসিপি দলের নেতা শরদ পাওয়ার বলেন, “কাউকে প্রধানমন্ত্রী করার সুপারিশ নিয়ে এই ব্রিগেড মঞ্চে আসিনি।”
উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম- ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এক মঞ্চে শপথ গ্রহণ করছে এক লক্ষ্যে- বিজেপি সরকারকে হঠাতে হবে। এবং এই মহাজোট জনমানসে আগ্রহ তৈরি করতে ও প্রভাব রাখতে সমর্থ হচ্ছে, তা প্রমাণ করল ব্রিগেড ময়দানের জনপ্লাবন! পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা থেকে আগত অগণিত জনসাধারণের জমায়েত কড়া বার্তা দিল, বিজেপি সরকারের অপশাসনে তারা অতিষ্ঠ, নিপাত যাক বিজেপি সরকার। এই বার্তা যে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বকে বড়সড় অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তেইশ কন্ঠের এক সুর চব্বিশ ঘন্টা পরও অস্বস্তিতে রেখেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। তেইশ দলের যৌথসভা প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি এমন ভাব দেখাতে শুরু করেন যেন পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অনায়াসে জিতবে, বিরোধী শক্তি কোনও আঁচড় কাটতে পারবে না! কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মোদি উপেক্ষা করতে পারছেন না জোটের চাপকে। এই মহাজোট প্রসঙ্গে কটাক্ষ, তাচ্ছিল্য করতে নিজে তো আসরে নেমেছেন; পাশাপাশি নামিয়ে দিয়েছেন সমস্ত বিজেপি নেতানেত্রীদের। নরেন্দ্র মোদির ‘কৃত্রিম তথা বাহ্যিক সাহস’ এবং ‘অন্তরে’ ভয় দেখে উপহাস করতে ছাড়েনি বিরোধী শিবির। কংগ্রেস সুপ্রিমো রাহুল গাঁধী ২০ জানুয়ারি টুইট বার্তায় লেখেন, “ইওর হাইনেস, সাহায্যের এই আর্তনাদ দেশের লক্ষ-লক্ষ বেকার যুবক, দুর্দশায় থাকা কৃষক, অবদমিত দলিত-আদিবাসী, নিগৃহীত সংখ্যালঘু, বিপর্যস্ত ছোট ব্যবসায়ীদের। তারা আপনার স্বৈরতন্ত্র এবং অযোগ্যতা থেকে মুক্তির ভিক্ষা চাইছেন। আর একশো দিন পর তারা মুক্তিলাভ করবেন।”
তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রিগেড ময়দানে যে ২৩টি আঞ্চলিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে এক মঞ্চে হাজির করে ‘মিত্রশক্তি’ দেখালেন, সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল আদর্শগত বিষয়ে সমমনস্ক নয়। বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আদর্শগত মতানৈক্য থাকলেও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে যেন কোনও রাজনৈতিক শিবির পারস্পরিক মতভেদ প্রকাশ না করে। বিরোধী শিবির এই কৌশল দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পারলে জনগণ আস্থা রাখবে ‘মিত্রশক্তি’ বিজেপিকে উৎখাত করার যে স্বপ্ন দেখাচ্ছে সেই স্বপ্নের প্রতি। বহু নেতার সমাগমে আপ্লুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, “প্রায় ২০ থেকে ২৪টি দলের প্রতিনিধি এসেছেন। আমরা কিন্তু সকলে একসঙ্গে কাজ করব। এটাই আমাদের শপথ। আজ থেকেই বিজেপির শেষের দিন শুরু হল। আপনারা সকলে এগিয়ে চলুন। জাগুন। আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধ ভারত তৈরি করতে হবে।” আগামী মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ভারতে শুরু হয়ে যাবে ভোটযুদ্ধ। ‘মহাজোট’ গঠন করার প্রক্রিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কলকাতার ব্রিগেড মঞ্চ থেকেই শুরু করে দিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নয়াদিল্লির মসনদে বদলের প্রধান মুখ যে মমতা, মেনে নিচ্ছে অন্যান্য অ-বিজেপি রাজনৈতিক শিবির।
ব্রিগেড মঞ্চে বেশ কয়েকটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিতে একশো শতাংশ সফল হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দিদি’র নির্দেশ মান্য করে সমাবেশ শুরুতে বক্তৃতা দেন তরুণ নেতা হার্দিক প্যাটেল এবং জিগ্নেশ মেবানী। যোগ্যতর, প্রবীণ নেতা থাকতে প্রারম্ভ ভাষণে ওরা কেন? কারণ, নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাতে প্রধান বিজেপি-বিরোধী মুখ দুই তরুণ নেতা হার্দিক ও জিগ্নেশ। মমতাময়ী মাস্টারস্ট্রোক! গত বছরের শেষে তিন রাজ্যে বিজেপি ভরাডুবি হওয়ার পর বিজেপির প্রধান ‘মাথা’ নরেন্দ্র মোদি এবং ‘সেনাপতি’ অমিত শাহের নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে। শরিক দলের পাশাপাশি কিছু বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা মুখ খুলেছেন দলের বর্তমান ‘উন্নাসিক’ নেতৃত্ব প্রসঙ্গে। বিজেপির টিকিটে জয়ী হওয়া নেতা থেকে বিজেপির বাঘা নেতা যারা বর্তমানে বিক্ষুব্ধ বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বের প্রতি, মমতার ডাকে তারা এসেছেন ব্রিগেড মঞ্চে। যশবন্ত সিনহা, অরুণ শৌরি, শত্রুঘ্ন সিনহা প্রমুখ প্রাক্তন বিজেপি নেতা মমতার সঙ্গে সমস্বরে তুলোধুনা করেছে বিজেপিকে। মমতা সুকৌশলে বিজেপির অভ্যন্তরের অসন্তোষ ব্রিগেড মঞ্চে উস্কে দিয়ে বলেন, “বিজেপির কাছে জানতে চাই, তারা কি দলের কোনও নেতাকে আদৌ সম্মান দেয়? যেমন: রাজনাথ সিংহ, নীতিন গডকড়ী, শত্রুঘ্ন সিনহা, যশবন্ত সিনহা, অরুণ শৌরি? নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তাই এখন সম্মিলিত নেতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, নির্বাচনের পর সব ভুলে গিয়ে অন্য নেতাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে!” মমতার সুরেই মুখর হন বিক্ষুব্ধ বিজেপি সাংসদ ‘বিহারিবাবু’ শত্রুঘ্ন সিনহা। তিনি বলেন, “নোট বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা জানতেন না মুরলীমনোহর জোশী, লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো বর্ষীয়ান নেতারা। পরে তো শুনেছি, খোদ অর্থমন্ত্রী এই বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন।”
সমস্ত বিরোধী শিবির এক মঞ্চে হাজির যার মমতাময়ী আহ্বানে, তাকে প্রশংসা করতে ভুলে যাননি কেউ। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী বলেন, “মমতাদি সকলকে এক মঞ্চে এনেছেন। এই লড়াইয়ে থাকছি।” লালুপ্রসাদ যাদবের পুত্র তথা বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব বলেন, “মমতাজির উদ্যোগে সকলে এই মঞ্চে এসেছি।” অখিলেশ যাদব বলেন, “যে-পথ বাংলা দেখাবে, সেই পথে দেশ চলবে”। ‘মিত্রশক্তি’ গঠনের নেপথ্যে মমতার উদ্যোগ এবং প্রয়াসকে কুর্নিশ করার পাশাপাশি বিজেপির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিলেন প্রথম থেকে শেষ সমস্ত বক্তা। প্রারম্ভ ভাষণে হার্দিক প্যাটেল বলেন, “সুভাষ লড়ে হ্যায় গোরোঁ সে, হমে লড়না হ্যায় চোরো সে!” (সুভাষ লড়াই করেছেন শ্বেতাঙ্গ মানুষদের সঙ্গে, আমরা লড়াই করব চোরদের সঙ্গে!) ভারতে যে লোকসভা ভোটের দামামা আগামী মার্চে বেজে উঠবে, তার আগেই বিজেপিকে লড়াইয়ে টক্কর দিতে তৈরি বিরোধী শিবির, দেখিয়ে দিল কলকাতার ব্রিগেড মঞ্চ।