বছরের শুরুতে মানুষ যখন নতুন বছরের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত, তখন শ্রমিকরা রাস্তায় মার খাচ্ছে বেতন বাড়ানোর দাবিতে। ন্যায্য এ দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে পুলিশের মার, নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার এবং মামলার সাথে এবার যোগ হয়েছে মালিক পক্ষের হুমকি। ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বেতনের সমন্বয় করা হয়েছে বটে, তবে বাস্তব চিত্রটা কি গার্মেন্টস শ্রমিকদের?
বেশ কিছুদিন ধরেই সরকার দাবি করে আসছে যে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। এটা সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে তাকাটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে পুরো সত্যটা সজ্ঞানেই চেপে যাচ্ছেন সরকারের নেতা, মন্ত্রীরা। যাই হোক, এই দাবিটা করার সুযোগ করে দিয়েছেন কিন্তু এই শ্রমিকেরাই। আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প। সে শিল্পের যারা মূল কারিগর বছরের শুরুতেই তাদের কেন মাঠে নামতে হলো?
আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প। সে শিল্পের যারা মূল কারিগর বছরের শুরুতেই তাদের কেন মাঠে নামতে হলো?
কিছু গ্রেডে বেতন যতটুকু বাড়ানো হয়েছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক তা বিশেষজ্ঞরাই বলবেন। আমরা একটু দেখতে চাই শ্রমিকদের জীবনের লুকানো কিছু সত্যকে; যা কখনো প্রকাশ্যে আসে না, যা নিয়ে আলোচনাও তেমন হয় না। তাই বেতন প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে একটু দেখা যাক কি পরিমাণ ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা কাজ করেন সেটি।
বাংলাদেশে বড় কিছু গার্মেন্টস বাদ দিলে মাঝারি মানের গার্মেন্টসগুলোতে যে শ্রমিকরা কাজ করেন তারা কি পরিমাণ মানবেতর জীবনযাপন করেন, তার সত্যকারের চিত্রটা কখনোই তুলে ধরা হয় না। রানা প্লাজা বা তাজরিন ফ্যাশনের কথা আমরা ভুলে যাই নি। সেখানে যারা জীবন হাতে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, তাদের খোঁজ কে নেয় এখন? দুটো ঘটনাতেই আমরা দেখেছিলাম মালিকদের অমানুষের মতন আচরণ। যেখানে শ্রমিকদের এক প্রকার বাধ্য করা হয়েছিল মৃত্যুকূপে ঝাপিয়ে পড়তে।
তাজরিনের কথা ধরেই এগোই। গার্মেন্টসগুলোতে যে সব জিনিস থাকে তার প্রায় সবই দাহ্য পদার্থ। এ কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেক ফ্লোরে ফায়ার এক্সটিংগুইসার রাখার জন্য আইন রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর শ্রমিকদের এ বিষয়ে ট্রেনিং এর বিধান রয়েছে। প্রত্যেকটি ফ্লোরে ইমার্জেন্সি গেট সার্বক্ষণিক খোলা রাখার নির্দেশও রয়েছে। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, কিছু গার্মেন্টস রয়েছে যারা এসকল বিষয়ে যত্নবান। কিন্তু অধিকাংশ গার্মেন্টসই এ বিষয়ে চরম উদাস। আপনি যদি আচমকা কোনো মাঝারি মানের গার্মেন্টস এ গিয়ে হাজির হন, দেখবেন ইমার্জেন্সি গেট তালা বন্ধ! শ্রমিকেরা এক্সটিংগুইশারের ব্যবহারও ঠিক মতন জানেন না। এবং যে এক্সটিংগুইশার রয়েছে তা হয় খালি নতুবা মেয়াদ উত্তীর্ণ!
প্রতিনিয়ত এ ঝুঁকি মাথায় নিয়েই শ্রমিকেরা কাজ করেন। শুধু এটুকুই না; গার্মেন্টস এর কাজে যে ঝুকি রয়েছে তা বিবেচনায় প্রত্যেক ফ্লোরেই মেডিসিন বক্স রাখার আইনও রয়েছে। এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সে বক্সে কী কী থাকবে তার নির্দেশনাও রয়েছে। এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক ফ্লোরেই একজন ব্যক্তিকে ট্রেনিং দেয়ার নির্দেশও রয়েছে। হঠাৎ করে যদি আপনি এসব গার্মেন্টস এ যান; মেডিসিন বক্স পাবেন খালি অবস্থায় অথবা যা পাবেন তা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য অপ্রতুল। এবং কোনো ফ্লোরেই এমন কাউকে পাবেন না, যিনি প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জ্ঞান রাখেন।
শ্রমিকদের বাড়তি আয়ের মূল উৎস ওভার টাইম। সেটি নিয়েও শ্রমিকেরা হেনস্তার শিকার হয়ে থাকেন। ওভার টাইমের টাকাটা ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন পদস্থ ব্যক্তিদের মাঝে। সবাইকে ভাগ দেয়ার পর একজন শ্রমিক যা পান, তা তার শ্রম্যের ন্যায্য মূল তো দূর কাছাকাছিও না। যারা এর প্রতিবাদ করেন, তাদের নসিবে ওভার টাইম জুটে না।
প্রত্যেক শ্রমিকের জন্যই বাৎসিক একটি নির্ধারিত ছুটি রয়েছে। সেটিও তারা কখনো কাটাতে পারেন না। আইনের কথা যদি কর্তাদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে সে শ্রমিককে মুখোমুখি হতে হয় তাৎক্ষণিক ছাঁটাইয়ের। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য শ্রমিক ফেডারেশনের বিধান থাকলেও তার বাস্তব অস্তিত্ব খুব কম জায়গাতেই রয়েছে। এমন কি কেউ যদি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যান, তিনি ভয়ে থাকেন যে ফিরে এসে তিনি চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন কি না!
এসব অনিয়ম যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক বছরেই গার্মেন্টসগুলোকে অডিটের মুখোমুখি হতে হয়। সেখানে অডিটরদের হাত পা থাকে বাধা। কারণ, কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে অডিটরদের ভরসা করতে হয় কাগজ অথবা সাক্ষ্যের ওপর। জাল কাগজ দেখে সন্দেহ হলেও অডিটররা কিছুই করতে পারেন না উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে। চাকরির ভয়ে শ্রমিকরা কখনোই অডিটরদের সামনে মুখ খোলার সাহস পান না। এখানে যে শুধু কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সার্বিক চিত্রটা আরো ভয়াবহ।
রানা প্লাজা বা তাজরিন ফ্যাশনের কথা আমরা ভুলে যাই নি। সেখানে যারা জীবন হাতে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, তাদের খোঁজ কে নেয় এখন? দুটো ঘটনাতেই আমরা দেখেছিলাম মালিকদের অমানুষের মতন আচরণ। যেখানে শ্রমিকদের এক প্রকার বাধ্য করা হয়েছিল মৃত্যুকূপে ঝাপিয়ে পড়তে।
এবার আসা যাক বেতন প্রসঙ্গে। আমরা দেখছি যে শ্রমিকদের বেতন সমন্বয়ের সময় মূল বেতন খুব একটা না বাড়িয়ে বাড়ানো হচ্ছে অন্য সব ভাতা। অথচ, ওভার টাইম বা অন্যান্য যে সকল সুযোগ সুবিধা শ্রমিকদের অবসরের পর পাবার কথা তা মূল বেতনের উপরই নির্ভর করে। এ বিষয়টি মালিকপক্ষ খুব চাতুরতার সাথে এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।
মূল যে বেতন স্কেল সেই স্কেল অনুযায়ী শ্রমিকেরা কয়টি গার্মেন্টসে বেতন পান সেইটাও দেখার বিষয়। যে সকল গার্মেন্টস নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তাতে শ্রমিকেরা মূল স্কেল অনুযায়ী তো দুর, কাছাকাছি বেতনও পাননা। বেতন বইতে মূল স্কেল অনুযায়ী বেতন দেয়ার যে হিসাবটা দেখানো হয় তা শুধু মাত্র অডিটরদের জন্য। এই অবস্থায় বেতন স্কেল যাই হোক শ্রমিকেরা কখনোই তার সুফল ভোগ করতে পারেন না।
আমরা শ্রমিকদের আন্দোলনে অনেক সময়ই ক্ষুদ্ধ হই। তাদের রাস্তা অবরোধ আমাদের ভোগান্তিতে ফেলে, এটাও সত্য। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তারা কি পরিমান বঞ্চনার শিকার হন তা আমরা কখনো খোঁজ নিয়ে দেখি না। এত কিছুর পরেও শ্রমিকেরা যে নিয়মিত উৎপাদন অব্যাহত রেখে আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছেন এটাই আশ্চর্যের বিষয়।
বিজেএমইএ, বিকেএমইএ বা সরকারের তরফ থেকে নানা সময়ে শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় না। শ্রমিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য সরকার বিশেষ আদালতের ব্যবস্থাও করেছে, কিন্তু ঐ পর্যন্ত শ্রমিকেরা খুব কম সময়েই যেতে পারে।
মালিকদের বিশাল সিন্ডিকেটের সামনে শ্রমিকেরা এক প্রকার অসহায়ই বলা যায়। এবং মালিকদের মানসিকতা কেমন তাও আমরা প্রায়ই দেখি। চলতি আন্দোলনের মাঝেই মালিকপক্ষ গার্মেন্টস বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এ অবস্থায় হয়তো শ্রমিকেরা কাজে ফিরেও যাবেন। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। স্কেল পরিবর্তন এর সুবিধা খুব কম শ্রমিকেরাই পেয়ে থাকেন। বাকিদের মাঝে বিরাজ করে চাপা ক্ষোভ।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যাদের শ্রমে আজকের অর্থনীতির এই উন্নতি তাদের বিষয়ে আমরা উদাস। বুদ্ধিজীবী মহল শুধু বেতন বাড়ানোর বিষয়ে কিছু তাত্ত্বিক বয়ান দিয়েই দায় শেষ করেন। বেতন স্কেলের সুবিধা শ্রমিকেরা ভোগ করতে পারেন কি না তা দেখার কেউ নেই। জীবনটাই সেকুলাস, যাদের কষ্টের বিনিময়ে এত উন্নয়ন তাদের দশ টাকা বেতন বাড়ানোর জন্য রাস্তায় নামতে হয়! তাদের উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে যে পুলিশের বেতন বাড়ে তাদের লাঠিপেটা সহ্য করতে হয়। দিন শেষে একজন শ্রমিক নিভৃতে শুধু চোখের জলই ফেলতে পারে। এইটাই এখন নির্মম সত্য। এই নিষ্ঠুর কৌতুকের শেষ কোথায় আমরা জানি না।