হিরো আলম। ইউটিউব এবং ফেসবুকের কল্যানে বহুল পরিচিত একটি মুখ। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গুগল অনুসন্ধানে বলিউড তারকা সালমান খানের চেয়ে বেশি বার খোঁজা হয়েছে হিরো আলমকে। আলোচিত-সমালোচিত হিরো আলম এবার ঝড় তুলেছিলেন নির্বাচনের ময়দানে। তার নির্বাচনে প্রার্থীতা ঘোষণার পর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কিছু নগ্ন সত্য তুলে এনেছেন সবার সামনে। যেটি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।
হিরো আলম নির্বাচনে প্রার্থী হবার ঘোষণা দেয়ার পর তিনটি শ্রেণির নগ্ন চিত্র নিজের অজান্তেই হয়তো প্রকাশ করেছেন আমাদের সামনে। নিয়মিত যাকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রল করা হয় তার দ্বারা উন্মোচিত সত্যগুলো হয়ত অনেকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়া যে কতটা দেওলিয়া তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন হিরো আলম। এরপর তিনি দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষকে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তারা কতটা নিচ চোখে দেখে সেটা। এবং নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় দেখিয়ে দিয়েছেন শাসক দল কতটা ভীত সেটা।
হিরো আলম নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন এটি প্রকাশের পর বহুল সমালোচিত এক বেসরকারি টেলিভিশনের উপস্থাপিকা হিরো আলমকে যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেগুলো ছিল হেয়কর, এবং চূড়ান্ত অবজ্ঞা সূলভ। হিরো আলম প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন খুব সরাসরি। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে একই গোষ্ঠির অন্য চ্যানেলগুলোও একই প্রচেষ্টা করেছে একাধিকবার। প্রত্যেকবারই দাতভাঙা জবাব দিয়েছেন হিরো আলম। কোনো মিডিয়া একজন ব্যক্তিকে এমন নির্লজ্জ্বের মতন আক্রমণ করতে পারে সেইটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অথচ যে কারণে হিরো আলমকে নিয়ে তাদের সমস্যা, সেই একই পথের পথিক হবার পরেও মমতাজকে এমন কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। তিনি শাসক দলের সমর্থক বলে?
রিটার্নিং অফিসার তুচ্ছ কারণে হিরো আলমের প্রার্থীতা বাতিলের পর তিনি ইসিতে আপিল করেন। সেখানে আপিল খারিজ হবার পরে দ্বারস্থ হন হাইকোর্টের। সেখান থেকে প্রার্থীতা ফিরে পেয়ে প্রচারণায় নামেন হিরো আলম। এবং এরপর তিনি বলেছিলেন ইসিকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলাম। তার জবাব যে ইসি সচিব দিবেন এটা কেউ আশা করেনি। এমন অবস্থায় সাধারণত সরকারি কর্মকর্তারা জবাবদানে বিরত থাকেন। এটি পুরোনো রেওয়াজ ছিল। কিন্তু দম্ভ যে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর কতটা ভর করেছে সেটি সবাই দেখেছে যখন ইসি সচিব মহোদয় হিরো আলমকে কটাক্ষ করে বলেন, সেও ইসিকে হাইকোর্ট দেখায়! ‘সে’ তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হিরো আলম একজন নাগরিক, যিনি সে সময় এমপি পদপ্রার্থী। তাকে তুচ্ছ করে কথা বলার অধিকার সচিব মহোদয় রাখেন কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এটুকুই না, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হয় সাধারণ জনগণের করের টাকায়। সে জনগণের সাথে এমন ব্যবহার করার অধিকার তিনি রাখেন কি না?
সবশেষ নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে হিরো আলম যে কথাটা বলেছেন তার তাৎপর্য বিশাল। তিনি সরাসরি বলেছেন যে তার মত স্বতন্ত্র একজন প্রার্থীকে যদি এত ভয় পায় নৌকা তাহলে তাদের পঁচে মরে যাওয়া উচিত। এবং তাকে মারধরের ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। যেখানে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে এক ব্যক্তি নিজেকে নৌকার লোক দাবি করে হিরো আলমকে মারধর করছেন! একজন স্বতন্ত্র হিরো আলমের ওপর যখন এমন আচরণ হয়েছে তখন মূল প্রতিদ্বন্দীদের সমর্থক, এজেন্টদের সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছে তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। ভোটের নামে আওয়ামী লীগ যে কতটা ভীত ছিল তা হিরো আলমের বিবৃতিতেই স্পষ্ট।
একটা কথা সত্য যে, সংসদের যে মর্যাদা তাতে অনেকেই হিরো আলমকে সেখানে কল্পনা করতে পারেননা। কিন্তু এর দায় কি হিরো আলমের? সাংসদদের কাজ আইন প্রণয়ন করা হলেও সংসদে আইন বিষয়ক আলোচনা কতটুকু হয় সেটা সকলেরই জানা। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও এখানে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। বাস্তবতা হচ্ছে এক কক্ষের সংসদ হওয়ায় একজন সাংসদ যদি শুধু আইন প্রণয়ন বা আইন বিষয়ে অভিজ্ঞতার জোরে নির্বাচন করতে যান তিনি জামানতসহ ফিরে আসতে পারবেন না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ভাবনাটা প্রবল যে এমপির কাজ এলাকার উন্নয়ন করা।
এই যে সংসদ এবং সাংসদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজ, এটি তো হিরো আলম করেননি। রাজনীতিবিদরা করেছেন, এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবিরা তা সমর্থন করেছেন, এবং মিডিয়া সেটিকে হালাল করেছে। আপনি বাংলাদেশের বড় দলগুলোর দিকে তাকান, দেখবেন নূন্যতম যোগ্যতা ছাড়া তাদের টিকিটে অনেকেই এমপি হয়েছেন, হচ্ছেন। সেটি এলাকায় তাদের জনপ্রিয়তা বা প্রভাবের কথা বিবেচনা করে। যেমন আব্দুর রহমান বদি কিংবা মমতাজ বেগম। সে হিসাবে নির্বাচনে হিরো আলমের আত্মবিশ্বাসের সাথে অংশ নেয়াটা কোনো আচমকা ঘটনা না।
হিরো আলমের গান, অভিনয় এগুলো নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। অভিজাত শ্রেণি স্বভাবতই তার ভক্ত হবেন না। কিন্তু, নির্বাচনের এই সময়টায় হিরো আলম যে বাস্তবতাগুলো দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তা ধাক্কা লাগার মত। তিনি প্রত্যেকটা বিষয়ে যেরকম স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন তা থেকে রাজনীতিবিদদের বরং শেখা উচিত। শুরু থেকেই তিনি বলছিলেন এ দেশের রাজারা প্রজাদের উপরে উঠা সহ্য করতে পারে না। সেটি যে কতটা নগ্ন সত্য তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। সুষ্ঠু ভোট হলে হয়ত তিনি পাশ করতে না, কারণ দু’দলেরই ঐ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী ছিল। তারপরেও যে আওয়ামী লীগ কতটা ভীত এবং কতটা অক্ষম তার প্রমাণ হিরো আলমের ওপর হামলা।
সামনে তিনি কখনো নির্বাচন করবেন কিনা সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু একবার অংশ নিয়েই সরকারের ভীতির চিত্র তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা বিরোধী দলের ঝানু কোনো রাজনীতিবিদরাও পারেননি। সমস্যাটা বোধহয় রাজনীতি শব্দটাতে, রাজ শব্দটা আগে থাকায় তারা সাধারণ জনগণের কথা জনগণের ভাষায় বলতে পারেননা। হিরো আলম সেটি করে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন।