ভারতভূমিতে জাতীয়তাবাদী মুখরোচকতায় ধর্মের অনুপান কীভাবে মৌতাতসিদ্ধ হয়েছে, তা আরশিস্বচ্ছতায় স্পষ্ট। বুলন্দশহরের হিংসা নিয়ে মন্তব্য করার প্রেক্ষিতে অভিনেতা নাসিরুদ্দিনের জন্য পাকিস্তানের বিমানের টিকিট বুক করার ঘোষণা করেছে নবনির্মাণ সেনা। তারা চায় আগামী ১৪ অগাস্টের মধ্যে যেন নাসিরুদ্দিন পাকিস্তানে পৌঁছে যায় এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। এ শুধু কথার কথা নয়, ইতিমধ্যে আজমীর শহরে অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ যে-বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেই সেন্ট আনসেলম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে যে সাহিত্যসভার সূচনা হওয়ার কথা ছিল, সেই সভা পণ্ড করে দিয়েছে তারা। এই সাহিত্যসভায় বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। কন্ঠরোধ করা হল শিল্পীর, ফলত শ্বাসরুদ্ধ হল গণতন্ত্র!
ধর্মাশ্রিত জাতীয়তাবাদ বুঝিয়ে দিচ্ছে, মানুষ কিছু বলতে চাইলে তাকে হিন্দু অথবা মুসলমান হিসেবেই বলতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের জীবনে মানবাধিকারের চেয়েও অপরিহার্য তার ধর্মীয় অধিকার। একটি রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ডের সংখ্যাধিক্যের কর্তৃত্বকারী ধর্মীয় প্রবণতাকে রাষ্ট্রের অভিমুখী প্রবণতা মেনেই বাকিদের বাধ্যতামূলক আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। সেই কারণেই বুলন্দশহরের ঘটনা মানবতার পক্ষে চরম লজ্জাজনক হলেও তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। প্রশ্ন তুললেই তুমি রাষ্ট্রদ্রোহী এবং পাকিস্তানের চর। বুলন্দশহরে যে-নির্ভীক কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসারকে হিমসহনীয় অভ্যস্ত নিষ্ঠুরতায় খুন করা হল, সেই পুলিশ অফিসারও কি পাকিস্তানের দালাল ছিলেন? কেন না তিনি তো উত্তরপ্রদেশের দাদরি গ্রামের মুহাম্মদ আখলাক হত্যার তদন্তে যুক্ত থেকে যে-রহস্য উন্মোচন করে দিচ্ছিলেন, তাতে গোরক্ষাকারীদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছিল না। নাম-পরিচয়ে এই পুলিশ অফিসার মুসলমান ছিলেন না। তাই কি পাকিস্তানের টিকিট কেটে সীমান্ত পার না করে একেবারে পৃথিবীর সীমা পার করে দেওয়া হল? বুলন্দশহরে অনতিদূরে আখের ক্ষেতে গোমাংস ছড়িয়ে থাকার গুজব ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যার ছক। শুধু গুজব ছড়িয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে পুলিশ কর্মকর্তাকে কব্জায় আনতে সফল হয়েছিল গোরক্ষক বাহিনী। ইন্সপেক্টর সুবোধকুমার সিং জাতীয় সড়কের অবরোধ তুলতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। প্রথমে তাকে পাথর ছুড়ে আঘাত করা হল। তারপর তারই সার্ভিস রিভলভার ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হল। এটা যদি সুপরিকল্পিত হত্যার ছক না হয় তবে আর কাকে হননচাতুর্য বলা যাবে আমার জানা নেই!
অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ সঙ্গত কারণেই শঙ্কিত। তিনি হচ্ছেন সেই বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধি যারা নিজেদের সন্ততিদের ধর্মীয় পরিচয়ে বড় করে তুলতে চাননি। কোনও রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ডের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্য যদি বিশেষ ধর্মীয় প্রবণতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে থাকবে সেই প্রজন্ম যারা কোন ধর্মীয় পরিচয়ে বড় হয়নি। বর্তমান ভারতে এই সংখ্যাটিও কম নয়। আশঙ্কার আবছায়ায় সন্তানসন্ততিদের লুকিয়ে রাখতে সত্যিই তো দমবন্ধ হয়ে আসার ব্যাপার! জীঘাংসার নামতাপাঠ শেষে হৃদয়ে যদি সত্যিই অবসাদ নেমে আসে তবে তা উদগীরণ না করে চেপে রাখব কীভাবে? অন্ধকারের সারাৎসারে নিক্ষিপ্ত লাশের ভিড়ে এখনও মিশে যাইনি, তাই তো মানবিক কণ্ঠেই কণ্ঠ মেলাতে চাই। ভোরের প্রভাকে পৃথিবীর মূর্খ উচ্ছ্বাস ভাবিনি, তাই প্রতিবাদে সোচ্চার থাকতে চাই। আসুন, আমরা শুভবাদী মানুষেরা একটি বাসযোগ্য মানবিক পৃথিবী গঠন করার শপথ নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হই!