মাশরাফি : রাজনীতি ও অনিশ্চতার বিশ্বকাপ

মাশরাফি : রাজনীতি ও অনিশ্চতার বিশ্বকাপ

ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্রই দারুণ এক সিরিজ কাটিয়েছে টাইগাররা। ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জয় ও টেস্ট সিরিজ ১-১ সমতায় ড্র করেছে বাংলাদেশ।

চলতি মাসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবারও মাঠে নামতে হবে রিয়াদ-মুশফিকদের। প্রতিপক্ষ কাগজে কলমে অনেক শক্তিশালী। তাই পরিকল্পনা করার আগে বিবেচনায় থাকবে শক্তি কিংবা দুর্বলতার জায়গাগুলো। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামার অনিশ্চয়তা। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মৃদু হেসে বলেন, “ইনশাআল্লাহ, মাশরাফি ভাইকে পাবো।”

মাশরাফি বাংলাদেশের সফল একজন অধিনায়ক। দলকে সামনে থেকে দারুণভাবে নেতৃত্বও দিচ্ছেন। তিনি খেলবেন সেটাইতো স্বাভাবিক। এটা নিয়ে প্রশ্ন করার কি আছে?  কিন্তু সংশয়টা অন্য জায়গায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য গত রবিবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়ন পত্র নেন মাশরাফি। নির্বাচনী প্রচারণা নাকি খেলা- দুটো সম্পুর্ণ আলাদা জায়গা সমানতালে সামলাতে পারবেন তো তিনি? একই সঙ্গে রাজনীতি আর ক্রিকেট। দু’টো সমান তালে চালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? প্রভাব পড়বে না ২২ গজের ক্রিকেট মাঠে?

সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় স্পষ্ট জবাব দিলেন, “প্রভাব পড়বেই। দুটো সমানতালে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। কারণ এমপিদের অনেক কাজ। যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে।”

সামনে উইন্ডিজ সিরিজ। তারচেয়েও বড় ব্যাপার, ২০১৯ সালেই শুরু হবে বিশ্বকাপের আসর। এমন আসরকে সামনে রেখে রাজনীতিতে প্রবেশ- মাশরাফি কি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেললেন না?

এমন গুরুত্বপূর্ণ আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মাশরাফির বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন যা বললেন, তাতে বেড়ে গেলো সংশয়। পাপন জানিয়েছেন, “আমি যতটুকু জানি, বিশ্বকাপে তাকে (মাশরাফি) পাওয়া যাবে। ও একদিনের জন্য সুযোগ পেলে অবশ্যই সে খেলবে। কারণ খেলাটাকে আগে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আর যদি সুযোগ না পান? তবে কি মাশরাফিকে ছাড়াই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আসর খেলতে হবে টাইগার বাহিনীকে? ফিট থাকার পরেও কেবল রাজনীতির কারণে মাশরাফির অনুপস্থিতি এদেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারবে তো?

হঠাৎ করেই ঘোষণা আসলো মাশরাফি এবং টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আগামী নির্বাচনে এমপি পদে লড়বেন। এই ঘোষণার পর ইতিবাচক মনোভাবের চেয়ে নেতিবাচক মনোভাবই বেশি পাওয়া গেছে জনগণের মাঝে। বেশিরভাগ মানুষের এই ঘটনা অপছন্দ করা দিয়েই বোঝা যায় যে সাকিব-মাশরাফির রাজনীতি করার পরিবেশ আমাদের দেশে নাই। কারণ একজন খেলোয়াড় দেশের সকল মানুষের কাছে সমান কিন্তু রাজনীতিবিদদের সমর্থন কিন্তু দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কারণ তাকে তো একটা দলের হয়ে কাজ করতে হবে। অন্য দলগুলো তার দোষ খোঁজার জন্য ব্যস্ত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও মানতে হবে ভালো মানুষের রাজনীতিতে আসা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতিও হয়ে যায়নি যে মাশরাফি আর সাকিব রাজনীতিতে আসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বরং রাজনীতির অনেক সীমাবদ্ধতায় তারা নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে পারেন।

শেষ পর্যন্ত সাকিব খেলার কারণ দেখিয়েই নিজের অবস্থান থেকে সরে গেলেও মাশরাফি রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করেছেন। নেতা মাশরাফি আর খেলোয়াড় মাশরাফি এই দুইটা চরিত্র তো অবশ্যই মানুষ আলাদা করেই দেখবে। দুটি চরিত্র একসাথে ধারণ না করে মাশরাফির উচিত ছিল অন্তত জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করা।

মাশরাফির হাত ধরেই এ দেশের ক্রিকেট বলতে গেলে সোনালি জগতে প্রবেশ করেছে। একে একে ক্রিকেটের পরাশক্তিরা ধরাশায়ী হয়েছে, আমরা পেয়েছি চূড়ান্ত সাফল্য। মাশরাফিকে দিয়েছি ‘হিরোর’ মর্যাদা। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পেলেও অধিনায়ক হিসেবে খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি মাশরাফি বিন মুর্তজা। ইনজুরির কারণে অনেক সময়ই তাঁকে থাকতে হয়েছে মাঠের বাইরে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে দেখা গেছে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমকে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের আগে আবার নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয় মাশরাফির কাঁধে। তার পর থেকে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয় যেন নিয়মিত ঘটনা। টাইগাররা টানা দু’বার খেলেছে এশিয়া কাপের ফাইনাল, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও প্রথমবারের মতো গেছে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ সামনে আর তার আগে নির্বাচন, সে ক্ষেত্রে মাশরাফির উচিৎ ছিল অন্তত কী করে সেমিফাইনালে খেলা যায় তা চিন্তা করা। অন্য সব চিন্তা অবান্তর।

আমাদের দেশ ভয়ানকভাবে বিভক্ত। ক্রিকেটই ছিল সবার অভিন্ন ভালোবাসার জায়গা। টাইগারদের জয়ে ১৬ কোটি মানুষ একসাথে সব দ্বেষ ভুলে আনন্দে উদ্বেলিত হতো। রাজনীতির বাইরে থেকে ২২ গজের ‘নেতার’ কথায় সবার মাঝে যে প্রতিক্রিয়া ঘটতো ‘রাজনৈতিক নেতার’ কথায় কি সবার মাঝে একই প্রতিক্রিয়া ঘটবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমির বিচারে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি এবং সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। মাশরাফি রাজনীতিতে যোগ দেওয়া মানেই সেই ধারণা রাতারাতি বদলে যাবে না। সুতরাং বলাই বাহুল্য,  রাজনীতিতে যোগদান জনগণের কাছে মাশরাফির ভাবমূর্তি অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে রাজনীতেতে পদার্পণ ক্রিকেটে তার মনোযোগ ব্যাহত করবে।

যতই আলোচনা-সমালোচনা হোক না কেন, আমাদের মনে রাখা উচিত রাজনীতিতে যোগ দেয়া বা না দেয়া আসলে মাশরাফির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তবে সাতবার ছুরি-কাঁচির নিচে নিজেকে সঁপে দিয়েও যে হার মানেনি, ২২ গজে চালিয়ে গেছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ক্রিকেটীও যুদ্ধ- তার ভাবনায় বিশ্বকাপ নেই- এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। ক্রিকেটের সবুজ গালিচা কিংবা রাজনীতির তপ্ত আঙ্গিনায় নিজেকে সমানতালে কতটা মেলে ধরতে পারেন মাশরাফি- সময়ই বলে দেবে।