আত্মহত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আত্মহত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মানুষের জীবনের চরমতম সত্যগুলোর মাঝে ‘মৃত্যু’ একটি। মানুষকে মরতে হয়, যেমনটা জন্মেছিলো সে। প্রত্যেক মানুষই জানে, তাকে একদিন মরতে হবে, সেটা যেভাবেই হোক না কেন, মরতে হবেই। খুব সাধারণত এই মৃত্যু-প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। রোগে, দুর্ঘটনায় কিংবা সহজাত বার্ধক্যজনিত কারণে। কিন্তু, যখন মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়, তখন তাকে ‘মৃত্যু’ না বলে আমরা বলি ‘সুইসাইড’। সোজা বাংলায় যাকে বলা চলে ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘আত্মহনন’। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক—এই দুইয়ের আদলে মৃত্যুকে দেখতে গেলে এই ‘আত্মহত্যা’ ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র প্রকারে পড়ে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়–দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এইখানকার ছাত্রদের মাঝে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে অঢেল স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই ছয়শো একরে পা রাখে নি। অনেক পড়াশোনা করে ঢাবিতে পড়তে আসা এই স্বপ্নাতুর ছেলে-মেয়েগুলোই আজকাল আত্মহত্যা করছে খুব। এই যে, এই বছরটার দিকে তাকালেই চলে। একটা ছোট্ট বর্ণনা দিই…

গত ১৫ই আগস্ট আত্মহননের পথ বেছে নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। আত্মহননের আগে স্বাধীনচেতা মুশফিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখে গেছেন ‘আই ওয়ান্ট ফ্রিডম অ্যাজ এ বাংলাদেশি ইভেন ইফ ইট কিলস মি ফর দ্য রিজন’ তার বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ী, ডিপ্রেশনে কাউকে ভুগতে দেখলে মুশফিক নিজেই সান্ত্বনা দিতো। প্রাণবন্ত এই মুশফিকই শেষে এসে আত্মহত্যা করে বসলো! ঠিক কেমন ঠেকে না ব্যাপারটা?

গত ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে আত্মহত্যা করে ঢাবির ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তরুন হাসান। কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের সবচে বড় রোগ ‘হতাশা’।  আর্থিক সংকটে জর্জরিত বেঁটেখাটো কৃষ্ণরঙা তরুন হোসেন ২০১৫-২০১৬ সেশনে ঢাবিতে ভর্তি হন ফিন্যান্স বিভাগে।

ফিন্যান্সের মতো সাবজেক্টে পড়ে  আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার কারণটা শুধু ‘হতাশা’ বলেই ক্ষেমা দেয়ার মতোন না। জানা যায়, শারিরীক অসঙ্গতি, সাদাসিধে আচরণ আর কালো গাত্রবর্ণের কারণে তরুনকে বিভিন্ন রকমফের নিগ্রহের শিকার হতে হতো । মোদ্দা কথা, তার প্রতি চলতে থাকা বিরূপ আচরণ এবং অসঙ্গত বাস্তবতা সহ্য করতে না পেরে তরুন হোসেন শেষপর্যন্ত মসজিদের ছাদ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

ত্রিশ বছর বয়সী তানভীর রহমান নিজেকে হত্যা করছে সরকারি চাকুরি না পাওয়ার দুঃখে। এই বছরের মার্চ মাসের শেষ দিনে ঢাবির বিজনেস ফ্যাকাল্টির নবম তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাস্টার্সের এই শিক্ষার্থী।

মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই সে তার খালাকে বলেছিলো, “খালা, আমি বেসরকারি চাকরি চাইনি, আমি সরকারি চাকরির জীবন চেয়েছি। চাকরির বয়সও প্রায় শেষ। এখন কী করব?”

খালার কাছে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিয়েলেন, খালা বলেছিলেন ধৈর্য্য ধরতে। তানভীর রহমানের কাছে উত্তরটা হয়তো পছন্দ হয়নি। শেষপর্যন্ত নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নিয়েছিলেন আত্মহননের মধ্য দিয়ে।

গত ১৫ই অক্টোবর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র জাকির হোসেন আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার সহজতম নিয়মের একটি গলায় ফাঁস লাগানোর মধ্য দিয়েই তিনি নিজেকে ভারমুক্ত করেন।

আফিয়া সারিকা। ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী। সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকেলে বাবাকে পাশের রুমে রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি।

সর্বশেষ গত সোমবার আত্মহত্যা করে বসেন ঢাবির বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা রেজা সিলভি।

আমার এই লেখাটি ঢাবিকেই কেন্দ্র করে। একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায়, এইসব ছাত্রদের আত্মহত্যার কারণগুলোর মাঝে ব্যাপক ডাইভার্সিটি আছে। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও  হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। যেসব শিক্ষার্থীদের কথা বললাম, স্পষ্টতই, তাদের আত্মহনন প্রক্রিয়ার পেছনেও ঠিক এই কারণগুলোই কাজ করেছে। জাকিরের অভাব অনটন কিংবা তরুনের হেনস্তার শিকার হওয়া—সবই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাচ্ছে।

একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ  বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।

ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%), পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

আত্মহত্যার প্রবণতা একটি রোগ। তবে দুরারোগ্য কখনোই নয়। দিনদিন এই আত্মহত্যার প্রবণতা মানু্ষের মননে-মস্তিষ্কে জেঁকে বসছে শক্ত হয়ে। আমার ঘরের ছোটো ভাইটি, স্কুল ফেরত কান্নামুখো বোনটি, একসাথে ক্লাস করা বন্ধুটি, মুখে রাজ্যের অন্ধকার নিয়ে এককোণে বসে থাকা ক্লাসের অপরিচিত ছেলেটি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াই ‘সবার থেকে ক্ষমা চাই’, ‘বিদায় চাই’ বলিয়ে-লিখিয়ে বন্ধুটির মাথায় কী ঘুরছে, চলুন, একটু জানতে চাই। বুঝতে চাই সমস্যাটা। কী চায় সে, কেন চায়; অযৌক্তিক হলেও অন্তত শুনি, বুঝি। অন্তত আমার চেষ্টার আগেই যেন সে আত্মহত্যা নামক সমুদ্রের অতলে তলিয়ে না যায়, সেদিকটা খেয়াল রাখি। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিই। এভাবেই কমতে পারে এই আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ছাত্রদের জন্য তৃতীয় তলায় আছে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা। এইটা একটা ভালো দিক বলা যায়। তবে প্রশ্নটা বাঁধে এখানেই যে, এই যে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা আছে, এর খবর ক’জন জানে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ঢাবি প্রশাসন এই কাউন্সিলিং-এর অস্তিত্ব ঠিকঠাক শিক্ষার্থীদের নলেজে দিতে পারছে কি না? এত এত হতাশাজনিত, অভাবজনিত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটবার পরও কেন কোনও নীরব-সরব মাথাচাড়া নাই? পক্ষে বিপক্ষে এইসব প্রশ্ন-উত্তর কিংবা তর্ক-বিতর্ক করতে করতে হয়তো আবার শুনতে পাবো, ‘অমুক বিভাগের অমুকজন আত্মহত্যা করে সেরেছে…’। উত্তরে “ও-তাই…আফসোস” বলেই হয়তো কাটিয়ে দিতে হবে আগের মতো, আবার, বারবার…