ঐক্যফ্রন্ট মূলত একটি ভাল সুযোগ ছিল এই দানবীয় ক্ষমতার পাগলা বাঘের পিঠ থেকে নেমে রাজনীতির মাঠে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য।
সরকারের মনে এই ধারণা কি করে তৈরি হল তা সহজেই বুঝা যায়। সরকার মনে করে, নিরপেক্ষ নির্বাচন আর লীগের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া দুটো একই জিনিস। তার মানে এই ফ্যাসিবাদ এতো দিন মিথ্যার উপর ভর করে চললেও এখন প্রকাশ্যে জনগেণের সাথে যুদ্ধে নামতে হবে।
১.
পরপর দু’টি সংলাপ ব্যর্থ হওয়া ও জনগণের সামনে বোকার মত নাটক করে দেশকে নিজেদের হাতে জিম্মি করে রাখার যে আয়োজন তা যে কোন মূল্যে জারি রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। আর এই ফ্যাসিবাদের সমর্থন যোগাতে আছে পোষ্য মিডিয়া, বিবেকহীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। আছে দলীয় ক্যাডার রূপে হাজির হওয়া পুলিশ। এটাই সরকারের শক্তির উৎস দেশের ভেতরে। আর বাইরের উৎস বলতে ভারত। তবে ভারত আর এই সব হাঙ্গামায় সরাসরি আসবে না। আসার দরকার ফুরিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অবৈধ ক্ষমতার এক মধুর বিড়ম্বনায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। তারা যেহেতু মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, নিরপেক্ষ নির্বাচন মানেই ক্ষমতা হারানো। ফলে ডিজিটাল উপায়ে, সিলমারার কষ্ট কমিয়ে বিতর্কিত ইভিএম ব্যবহার করার আয়োজন করা হয়েছে। দেশে সরকারি নেতাদের পোস্টার ও একতরফা নির্বাচনী প্রচারণা জনগণকে ভীত ও আতঙ্কিত করে রেখেছে। এর মধ্যে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে সরব হওয়ায় জনগণের মনে আশার আলো দেখা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদ যুদ্ধ ছাড়া টিকতে পারে না। এবং যুদ্ধ করেই টিকতে হয়। সেই পথেই থেকে গেল এই অবৈধ সরকার। কিন্তু জনগণের যে জোয়ার জেগেছে তা এই ফ্যাসিবাদের নির্মম পরাজয় ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। সব সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পরে এখন বাকি রইল কেবল আন্দোলনের পথ। এত দিন আন্দোলন অনলাইনে বেশি হয়েছে রাস্তায় কম। এবার উল্টোটা হবে মনে হচ্ছে। গতকালের সমাবেশের চিত্র তাই বলে। সেই পথেই হাটছে বাংলাদেশের রাজনীতি।
২.
কিন্তু এই আন্দোলনের পথে একাধিক বিপদ আওয়ামী লীগের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমত আন্দোলন লম্বা হলে দেশ অচল হয়ে পড়তে পারে। তৃতীয় পক্ষ, ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে। আর সেটা হলে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। লীগের সামনে দুইটা পথ খোলা। এক. সাগরে ঝাঁপ দেয়া, দুই. নদীতে ঝাঁপ দেয়া।
যদি আন্দোলনের দিকে সমস্ত বিরোধীদলকে ঠেলে দেয় তাহলে এরশাদ সরকারের চেয়ে খারাপ পরিণতি হবে আওয়ামী লীগের। লীগের এই বিশাল সাংগঠনিক বিস্তার। রাজনৈতিক পরিসর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণ-আন্দোলনের পরে যে কোন ফ্যাসিবাদি সংগঠনের যা হয় তাই হবে। অন্যদিকে তৃতীয় পক্ষ বলতে সেনা সমর্থিত সরকার বুঝায়। আর এই সেনা ক্ষমতায় এসে এক বিডিআর বিদ্রোহের বিচার শুরু করলেই আওয়ামী লীগ নির্মূল হতে শুরু করবে। এই বিপদের দিকে লীগের যে হুশ নাই তা না। তাই তারা সরাসরি সংলাপ বা ঐক্যফ্রন্টকে মোকাবেলা না করে নানান নাটক ও চাতুরি করে এই সময়টা কোন মতে পার করে নির্বাচন করে ফেলতে চায় সবাইকে বাগে রেখে। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগকে একটা দুধের শিশুও বিশ্বাস করে নাই তাই এই সুযোগ আর এবার পাবে বলে মনে হচ্ছে না। আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়া হল সাগরে ঝাঁপ দেয়া।
৩.
আর নদীতে ঝাঁপ দেয়া মানে হল, ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে একটা সমাধানের পথে হাটা। এতে লীগ লাভবান হবে। এককভাবে ক্ষমতায় না আসতে পারলেও নদী সাতরে তীরে ওঠার পথ খোলা থাকবে। ঐক্যফ্রন্ট বলতে এটার বড় বড় নেতারা মিডিয়ার মনযোগে আছেন। কিন্তু মাঠের শক্তি বলতে পুরোটাই বিএনপির। এই শক্তি ও ইমেজ মিলে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে সরকারের পক্ষে সহিংসতার বয়ানের ভিতর দিয়ে ২০১৪ সালের মতো উৎরে যাওয়ার পথ এবার দেখা যাচ্ছে না। আড়ালে বিএনপি থাকলেও বিএনপি লীগের রাজনৈতিক পরিসর বন্ধ করবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে দুই দল মারামরি করে দুইদলই জখম ও ক্লান্ত হলে তৃতীয় দল ক্ষমতা নিতে বাধ্য হবে। আর ক্ষমতা কারো আনুগত্য মানে না। ফলে লীগ যেহেতু সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকা দল লুটপাট, সন্ত্রাস এই সবের বিচার দরকার হবে আর এতে আসল মাইরটা খাবে লীগ। বিএনপির আর হারানোর কিছু নাই। তাই এটা নিয়ে আজ কথা বলব না।
সেনা টাইপের কোন কিছুর কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়া হবে সাগরে ঝাঁপ। আর বিএনপির মাধ্যমে (যদি ধরে নেই এরাই ক্ষমতায় আসছে) ক্ষমতা ছাড়া হবে নদীতে ঝাঁপ। যেখান থেকে উত্তরণের সুযোগ থাকবে। নইলে দেশের জন্য যেমন রক্তপাত অপেক্ষা করছে তেমনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার লোভ তার রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকে লীগ সারা দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে আর না হলে গোটা দেশের মানুষ জিম্মি হবে। হয় লীগ করতে হবে না হলে জেল বা অত্যাচার। ভিন্নমত বলে কিছু থাকবে না। কি হবে তা আমরা সবাই জানি।
ফলে, সবার জন্যই এটা জান রক্ষার লড়াই। এই অবস্থায় জনগণের আন্দোলনের বিকল্প যেমন নাই। তেমনি লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কোন পথ বেছে নিবে। এই বেয়াহা সংসদ, নির্বাচন কমিশন ও গুণ্ডাতন্ত্র দিয়ে ক্ষমতা রাখা গেলেও রাজনীতি টিকিয়ে রাখা যায় না।
ক্ষমতা বিড়ম্বনা আওয়ামী লীগ কীভাবে সমাধান করে তার উপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে।