কি হচ্ছে মোদির ভারতে

বিশেষ প্রতিবেদন

কি হচ্ছে মোদির ভারতে

  • পরকীয়া বৈধ
  • সমকামিতা বৈধ
  • নামাজের জন্য মসজিদের দরকার নাই

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গনতন্ত্রের দেশ মোদির ভারত এখন কৌতুকের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে উঠেছে। দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ শুধু হুমকির মুখে তাই নয়। ভিন্নমতের লেখক-সমাজকর্মীদের জেলে দেয়া হচ্ছে। অজুহাত হিসেবে নতুন টার্ম ‘আরবান নকশালিস্ট’ চালু করেছেন। যাকে অপছন্দ তাকেই শহুরে শিক্ষিত নকশালিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে জেলে পুরছেন।

অন্যদিকে ভারতজুড়ে মুসলমানদের উপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। গরুর রাজনীতির শিকার হচ্ছেন নিরিহ ভারতীয় মুসলমানরা। পিটিয়ে হত্যা করা, জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা প্রতিনিয়ত সংবাদের শিরোনামে উঠে আসছে। আর অসংখ্য ঘটনা থেকে যাচ্ছে মিডিয়ার নজরের বাইরে। দলিত ও প্রান্তিক নাগরিকদের উপর অত্যাচারের উৎসব চলছে ভারতজুড়ে।

আর কাশ্মিরের জনগনের উপর চলছে গণহত্যাতো নতুন কিছু নয়। নতুন করে ‘জঙ্গিবাদের’ জিকির তুলে শুরু হয়েছে কাশ্মিরি মুক্তিকামী জনগনের উপর অত্যাচার। মোদির বড় বড় কথা ও বিজেপি-আরএসএস এর সন্ত্রাসকে আরও উস্কে দিচ্ছে। ভারত জুড়ে বেকারত্ব, কৃষকের অত্মহত্যা। শ্রমিকদের বড় বড় বিক্ষোভ সমাবেশ সবই মোদির মিথ্যাচারের কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় শাসকরা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে। এবং প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদকেও মদদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এইসব সাংবিধানিক ও গণতন্ত্রের আড়ালে ফ্যাসিবাদী তৎপরতাকে আড়াল করতে উগ্রবাদী ভারতীয় শাসক আদালতকে দিয়ে অতি আধুনিক ও প্রগতিবাদী কিছু আইন পাশ করে বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছেন তারাও পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে চলছেন। এখানেও অতি আধুনিকতা রাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছেন আদতে ফ্যাসিবাদের কৌশল হিসেবে এগুলো খুবই কাজের কাজ হয়ে উঠছে।

পরকীয়া বৈধ :

ব্রিটিশ আমলের আইন বাতিল করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, পরকীয়া কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে না। গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এ রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, পরকীয়াকে অপরাধ গণ্য করে ব্রিটিশ  আমলের যে আইন রয়েছে তা অসাংবিধানিক ও পক্ষপাতমূলক। সর্বসম্মতিক্রমে আদালত ঘোষণা করে যে, সংবিধানের ৪৯৭ ধারা প্রায় ১৫৮ বছর আগের। এটি নারীদের মর্যাদা  ও যৌন স্বাধীনতার পরিপন্থি।

এতে এক শ্রেণির আধুনিকতাবাদি ভারতীয় নাগরিকরা খুব উল্লসিত হয়েছেন। তাদের ধারণা এই রায়ের মাধ্যমে ভারত আধুনিক তার প্রমাণ দুনিয়ার কাছে তুলে ধরার সুযোগ হল।

কলকাতার লেখিকা  তিলোত্তমা মজুমদার লিখেছেন, “কিছু কাল আগেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা বিষয়ে শীর্ষ আদালতের বিবৃতি যে আশা জাগিয়েছিল, কালক্ষেপ না করে, সেই বিবৃতিকে রায়ে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে আবারও প্রমাণ হল, গণতান্ত্রিক ভারতে শীর্ষ আদালতের ভূমিকা সাধারণ জনগণের অন্তিম ও প্রধান ভরসাস্থল। ”

ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে প্রণয়ন করা আইন অনুযায়ী ভারতে একজন বিবাহিত নারী ও পুরুষের মধ্যে পরস্পরের সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এ আইন অনুযায়ী পরকীয়ার অপরাধ প্রমাণিত হলে একজন পুরুষকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হতো। এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের না করলে সংশ্লিষ্ট নারীকেও পরকীয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হতো।

একইসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, যদি স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে জীবনসঙ্গী আত্মহত্যা করে তবে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার যে সাধারণ আইন রয়েছে, সে আইনে বিচার করা হবে। ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০৬ ধারা অনুযায়ী আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়া অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো আত্মহত্যার পেছনে কারো প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হবে। একই সঙ্গে, জরিমানার বিধানও রয়েছে।

কিন্তু এখানে তো সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এই রায় নিয়ে এতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার কি আছে। আর এই ধরণের বিষয়ে রায় দিয়ে সমাধানও করা যায় না। এই ধারণার সমালোচনা করে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “যদি আমাদের স্বামী বা স্ত্রী আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অন্য কাউকে গমন করে আমাদের কাছে হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলে,‘‘ওগো, কই গেলে গো, আজ রানির সঙ্গে পরকীয়া করে এলাম,’’বা বলেন যে, ‘‘আজ রাজা তো ছাড়তেই চাইছিল না, আমি শুধু তোমার মায়ের কাল চোখ অপারেশন ভেবে ফিরে এলাম।’’তাহলে সেটা কি আমরা মেনে নিতে পারব? একই সঙ্গে বিয়ে আর একই সঙ্গে যৌন স্বাধীনতা— এই দুয়ের প্র্যাকটিস কি সম্ভব?”

সমকামিতা বৈধ :

গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সমকামিতাকে বৈধতা দিয়ে একটি রায় দেয় ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালত। ৩৭৭ ধারাকে খারিজ করার সময়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সমকামিতার সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি কোনও ব্যক্তির নিজস্ব যৌনরুচির বিষয়। তার সঙ্গে নৈতিক ধ্যানধারণার কোনও সম্পর্ক নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সমকামিতাকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বলছেন: “দ্য ন্যাচারাল আইডেন্টিটি অব অ্যান ইন্ডিভিজুয়াল শুড বি ট্রিটেড টু বি অ্যাবসলিউটলি এসেনশিয়াল টু হিজ় বিয়িং’, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির প্রকৃতিগত আইডেন্টিটি-কে তার অস্তিত্বের অত্যন্ত জরুরি অংশ হিসেবে মানতে হবে। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা বলেছিল, দেশের আইনের কাছে ব্যক্তিনাগরিকদের সবাইকে সমান বলে মানতে হবে। ১৫ নম্বর ধারা বলেছিল ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।”

অথচ ভারতে এখন বৈষম্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। আরএসএস ও বিজেপির সমর্থক ও ক্যাডাররা এক রকম নাগরিক আর বাকি আম-আদমি অন্যরকম নাগরিক। এমন একটি দেশে যেখানে দলিত ও মুসলমানদের জীবনের কোন দাম নাই। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি রক্ষণশীল, সেখানে এমন একটি আইন লোক দেখানোর আয়োজন ছাড়া আর কিছু না। জীবনের চেয়ে যৌন স্বাধীনতার কদর মোদির ভারতে বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে এই আইনের ফলে সমকামিতাকে জনসমাজে প্রকাশ্য করে দেয়ার ফলে সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে শঙ্কিত বোধ করছেন অনেক নাগরিক।

নামাজের জন্য মসজিদের দরকার নাই:

ইসলাম বিদ্বেষী আচরণ ভারতের একটি ঐতিহ্য। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির আমলে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিছুদিন আগে তাজমহল মসজিদে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেছে তারা।

নামাজের জন্য মসজিদ অত্যাবশ্যক নয়, সুপ্রিম কোর্টে বহাল আগের রায় । বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে ইসমাইল ফারুকি মামলায় ১৯৯৪-এ সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সরকার মন্দির, মসজিদ, গির্জা সবই অধিগ্রহণ করতে পারে, যদি না সংশ্লিষ্ট ধর্মে তার আলাদা কোনও তাৎপর্য থাকে। মসজিদ ইসলামের অপরিহার্য অংশ নয়। কারণ নমাজ যে কোনও জায়গাতেই পড়া যেতে পারে।

তিন বিচারপতি এ দিন অবশ্য একমত হতে পারেননি। প্রধান বিচারপতি মিশ্র ও বিচারপতি অশোক ভূষণ ওই রায় দিলেও উল্টো মত দিয়েছেন বিচারপতি এস আবদুল নাজির। তার মতে, মসজিদ ইসলামে আবশ্যিক কি না, মুসলিমদের বিশ্বাস, ধর্মাচরণ খতিয়ে দেখে তা নতুন করে সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচার হোক।

মুসলিম সংগঠনগুলির বক্তব্য ছিল, “ইসমাইল ফারুকি মামলায় শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, সরকার মন্দির, মসজিদ, গির্জা সবই অধিগ্রহণ করতে পারে, যদি না সংশ্লিষ্ট ধর্মে তার আলাদা কোনও তাৎপর্য থাকে। কিন্তু এভাবে ধর্মস্থানের গুরুত্বের তুলনামূলক বিচার চলে না।”

২৯ অক্টোবর থেকে ফের সেই মামলার শুনানি শুরু হবে। ২ অক্টোবর বর্তমান প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অবসর নেবেন। এত দিন তার বেঞ্চেই এই শুনানি চলছিল। নতুন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে নতুন বেঞ্চ গঠন করতে হবে।

রাজনীতিতে ধর্মকে নোংরা ভাবে ব্যবহার করে দেশটির সরকার একদিকে সেকুলারিজমের প্রচার ও অতি আধুনিক আইন পাশ করে অন্যদিকে মুসলিম ও দলিত নাগরিকদের উপর জুলুম, অত্যচার, হত্যা করে আসছে। নারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন সবই চলছে। এই যে দ্বিমূখি ভারতীয় নীতি মোদি সরকারের চরিত্র বোঝার জন্য যথেষ্ট।

এইসব বিষয়কে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করে সমাজের অন্ধকার অধপতন ও ক্ষমতার দ্বারা অত্যাচারিত মানুষের বয়ানকে আড়াল করা হচ্ছে। এভাবেই স্বপ্নের ভারতের গণতন্ত্রের ভেতর দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ভারত। আর এই কাজে আদালত আগ বাড়িয়ে নানা রায় দিয়ে জনগণকে নিরর্থক তুষ্টির আশায় রেখে ফ্যাসিবাদকেই সাহায্য করছে।