ঢাবি প্রশাসন কি আসলে ডাকসু চায়?

ডাকসু আশা জাগিয়ে হতাশ করলেন

ঢাবি প্রশাসন কি আসলে ডাকসু চায়?

একদিন বা দু’দিন না কিংবা এক বছর দু’বছর না। কেটে গেছে পুরো ২৮ বছর। তারপরও কোন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দেখা নেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। ১৯৯০ সালের পর থেকে ‘ডাকসু’ নিয়ে এই উদাসীনতার কারণ অনেক আগে থেকেই খুঁজে ফিরছিলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সময়ে তারা এ নিয়ে মুখ খুললেও গত আটাশ বছরের জাতীয় রাজনীতি এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর (বিশেষ করে বৃহত্তম দুই দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠন) কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে খুব সুকৌশলেই ছাত্র সংসদকে এড়িয়ে এসেছে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বড় দুই দল। কিন্তু কেন ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে বড় এই ভিত্তি, ছাত্র সংসদকেই এড়িয়ে চলা? উত্তরটা সাজিয়ে বলতে গেলে অনেক বড়! কিন্তু খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই বোঝা যাবে সব। আমরা জানি, নব্বইয়ে স্বৈরশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করে গণতন্ত্রের পুনঃজন্মের পেছনে এই দেশের ছাত্রদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাই এরশাদ পরবর্তী মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো, তখন ছাত্রদের শক্তি এবং নৈতিকতাকেই সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করতো। তারা নব্বইয়ের আন্দোলন থেকেই বুঝে গিয়েছিল যে গণতন্ত্রের আড়ালে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা কখনই সম্ভব না যদি ছাত্র সংসদগুলো ক্রিয়াশীল থাকে। আর এর জলন্ত উদাহরণ আমরা এই সরকার শাসনামলেই লক্ষ্য করি। যেখানে খুব সহজেই সরকার কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো গণজাগরণকে পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এটা আন্দোলন বিনাশ হওয়ার ইতিহাস সৃষ্টিকারী উদাহরণ।

বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলন, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টি’র ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সকল আন্দোলনের নেতৃত্বেই ছিল এই ডাকসু। তবে স্বাধীনতার পর এই মুক্ত কিন্তু বিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির আদর্শও ছিল এই ডাকসু। অনেক দিক থেকেই সদ্য স্বাধীন এই দেশের হাল ধরতে এগিয়ে এসেছে ডাকসুর নেতারা। বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতির মত অকেজো কিংবা উপেক্ষিত ছিলো না তখনকার ছাত্র রাজনীতি। ডাকসুর প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের যোগেন্দ্রনাথের নাম পাওয়া যায়। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। বর্তমান বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তৎকালীন সহসভাপতি (ভিপি) হিসাবে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে এই ৪৭ বছর পর্যন্ত মাত্র ৭ বার ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে আমান উল্লাহ আমান ও খাইরুল কবীর খোকন (আমান-খোকন) পরিষদ এই নির্বাচনে জয়লাভ করে। বিষ্ময়কর হলেও সত্য এরশাদের সেনা তথা স্বৈরশাসনামলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৯১ পর থেকে তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবার পরেও কোন ছাত্র সংসদ বসেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আর তখন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনছে ছাত্রসমাজ। নানা আন্দোলন থেকে ওয়ালিদ আশরাফ’র অনশন; নির্বাচনের জন্য সব কিছুই করেছে এই ছাত্ররা। তবুও আশ্বাস বিনা কিছুই মেলে নি। আটাশ বছরে প্রাণের ডাকসু’র মৃত আশা আর ‘ডাকসু ভবন’ নামের কনক্রিটের লাশ এখন শুধুই হতাশার প্রতিচ্ছবি।

এবার ডাকসু’র বর্তমানের দিকে একবার দৃষ্টি দেয়া যাক। ছয় বছর আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালের মার্চে ঢাবির ৩১ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পক্ষে আইনজীবী মুরাদ মনজিলের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাবি উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান আলোচনায় বসেন। এই আলোচনায় অংশ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় তেরোটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আলোচনায় ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনের দাবি এটা পরিস্কার করে যে ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন’ সবার প্রাণের দাবি। আলোচনা শেষেই উপাচার্য গণমাধ্যকে জানায় ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যেই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচন।

উপাচার্যের কথায় স্বস্তি ফিরেছিলো সাধারণ ছাত্রদের মনে। যদিও মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশের পরেও নির্বাচন না হওয়ার ঘটনা তাদেরকে শঙ্কায় রেখেছিল। তবে ছাত্ররা আনন্দিত ছিল উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই পদক্ষেপে। সকল ছাত্র সংগঠন সহাবস্থানের কথা বলেছিল, যাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রদলের সভাপতির আলিঙ্গন দিয়েই প্রমাণ করা যায়। আর সাধারণ ছাত্ররাও একটি শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের জন্য তৈরি ছিলো। আবার বলে রাখা ভালো, ঢাবি উপাচার্য ১৬ সেপ্টেম্বরই গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীকে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু একদিনের মাথায় কি এমন ঘটনা ঘটলো যে ঢাবি প্রশাসন উচ্চালাদতের  ‘নির্বাচন এর নির্দেশ’র বিরুদ্ধে কাউন্টার আপিল করলো? ঢাবি প্রশাসনের যুক্তি অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নাকি ডাক্সু নির্বাচন দেয়া সম্ভব না! তার মানে কি তাহলে এই যে, ইতিহাসে যত ডাকসু কমিটি ছিলো তারা সবই ক্যাম্পাসে অশান্তি করেছে? প্রশ্নটা বোধ হয় কিছুটা উদ্ভট! যাই হোক।

ঢাবি প্রশাসনের এই আপিলের কারণ উদ্ধারে সফল হতে পারেনি সাধারণ ছাত্ররা। তারা সবাইই জানতে চায় যে, ছাত্রলীগ যখন সহাবস্থান নিয়ে একমত তখন ক্যাম্পাসে অশান্তি-সহিংসতা’র যুক্তি আদালতকে ছুড়ে দেওয়াটা ঠিক কতটা যৌক্তিক? এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হয়নি কি? যেখানে নির্বাচনকালীন সহিংসতা আটকানোটা ঢাবি প্রশাসনের দায়িত্ব সেখানে ‘সহিংসতার আশঙ্কায় নির্বাচন দেয়া সম্ভব না’ এই মন্তব্য করাটা কি ঢাবি প্রশাসনের অপারগতা প্রকাশ করে না? আর এর নেপথ্যের কারণটাই বা কি? তবে কি আবার সেই প্রশ্নটাই আসছে, ছাত্রদের হাতে নৈতিক ক্ষমতা ও শক্তি চলে যাওয়ার ভয়টাই কি পাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা? অন্যদিকে সামনেই যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তখন ডাকসু নিয়ে উত্তেজনা অন্যকিছু প্রমাণ করে কি? তবে ছাত্রদের অধিকারের এই পবিত্র স্থান থেকে ঢাবি প্রশাসন যদি ছাত্রদের বঞ্চিতই করতে চায় তবে তা সরাসরি ঘোষণা দেয়াই শ্রেয়, বলে আক্ষেপ করে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। গত আটাশ বছরে ‘ছাত্র সংসদ’ নিয়ে যে টালবাহানা শুরু করেছে চুড়ান্ত ফলাফলের দিকে যাওয়াটাই উত্তম বলে মনে করে সাধারণ জনতা এবং ছাত্ররা। তাই সবাই আশায় বুক বেঁধে এই জানতে চায় যে “ডাকসু নির্বাচন কি আদৌ হহচ্ছে বা হবে?” বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীরা কি নতুন করে ইতিহাসের সাক্ষী হবে? নাকি নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েও আদালতের আশ্রয়ে সুকৌশলে এই ইস্যু থেকে আবার সরে এসে ঢাবি প্রশাসন আরো একটি বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করবে? প্রশ্ন অনেক তবে উত্তর আসবে- এই আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের হাজারো শিক্ষার্থী।