আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার ইতিবৃত্ত
আমরা পুরো পৃথিবীর মানুষ, মূলত যে বিষয়টির পিছনে জীবনের বিশাল একটি অংশ খরচ করি, তা হল “অর্থ (Money)”। অর্থ থেকেই জন্ম নেয় অর্থনীতি এবং তা থেকেই জন্ম নিয়েছে বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা। কিন্তু, কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, অর্থের মানে কি? তাহলে অনেকেই পরিস্কার করে বলতে পারবে না। আমাদের চোখে ডলার, টাকা, রূপি, রিয়াল ইত্যাদি প্রতিটি হল অর্থ (Money)। প্রথমে বলে রাখি, এসবের একটিও অর্থ নয়। এগুলো হল “কারেন্সি”, যা তৈরি হয় বাতাস থেকে। ২০০৮ সালে মাইকেল ম্যালোনি আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার ইতিহাস এবং তার বর্তমান চিত্র নিয়ে “গোল্ড অ্যান্ড সিলভার” নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তার এই বইটি ইতোমধ্যে ৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার অজানা বহু ইতিহাসকে একত্র তিনি এই বইটি প্রকাশ করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ ঘন্টা করে প্রায় আড়াই বছর একটানা গবেষণা করে তিনি এই বইটির কাজ সম্পন্ন করেন। এই লেখাকে বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখতে পারেন। সম্পূর্ণ লেখাটি পাঠ করার জন্যে পাঠকদের ধৈর্য ও মনযোগ উভয়ই কামনা করছি। প্রথমেই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু করব, যা আদর্শ অর্থের (Money) পরিচয় বহন করে।
১. গ্রহণযোগ্য বিনিময় মাধ্যম
এক সময় আমরা পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ব্যবহার করতাম (Barter Trade)। যেমন: চালের বিনিময়ে আটা, আপেলের বিনিময়ে খেজুর, দুধের বিনিময়ে ডিম ইত্যাদি। যেহেতু পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময় করা হত, সেহেতু মাঝে আর কোন বিনিময় মাধ্যম ছিল না। মাধ্যম বলতে একটি তৃতীয় পক্ষকে বুঝানো হচ্ছে, যা বিনিময় কাজে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবে।
Barter Trade এর বড় অসুবিধা হল, এ পদ্ধতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। তবে আমরা যাই ব্যবহার করি না কেন, তা উভয় পক্ষের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হবে, যা অর্থের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
২. হিসাবের একক
হিসাবের একক বলতে, এমন একটি সংখ্যা বা পরিমাপককে বুঝানো হচ্ছে, যার দ্বারা যেকোন পরিমাণ পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব। যেমন: দূরত্ব পরিমাপের এককগুলো হল মিটার, কিলোমিটার, ইঞ্চি, মাইল ইত্যাদি যা পৃথিবীর সর্বত্র একই ভাবে হিসাব করা হয়। কিন্তু টাকা, ডলার, রূপি ইত্যাদি পরিমাপের জন্যে এমন কোন সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য পরিমাপক নেই। অর্থাৎ, এক টাকা এবং এক ডলার কখনো সমান হয় না; আবার এক ডলার এবং এক রূপিও কখনো গ্রহণযোগ্য হয় না। যে বিনিময় হার ব্যবহার করে আজ আমরা অর্থের মূল্য নির্ধারণ করি, তাকেও আমরা কখনো অর্থ পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না, কারণ তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়।
কিন্তু “স্বর্ণ-রৌপ্য” ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায়, এই পরিমাপের একক সর্বদা সমান ছিল। যেমন: এক আউন্স স্বর্ণ বা এক কিলোগ্রাম স্বর্ণ, পৃথিবীর সর্বত্র সমান। একই ভাবে চাল, গম, তেল, লবণ ইত্যাদি পরিমাপের এককও পৃথিবীর সব দেশে সমান। অর্থাৎ, এক কেজি সমপরিমাণ গম বাংলাদেশে, ভারত, ইংল্যান্ড ইত্যাদি প্রতিটি দেশে সমান।
৩. দীর্ঘকাল ধরে এর মূল্য একই থাকবে
আপনি ১০ বছরের জন্যে ৪০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা রাখুন। দেখবেন, এই পরিমাণ টাকা দিয়ে আপনি আজ যা কিনতে পারছেন, তা আর দশ বছর পরে কিনতে পারছেন না। মনে করুন: ৪০ হাজার টাকা দিয়ে আজ আপনি ৪০০ কেজি চাল ক্রয় করতে পারছেন, কিন্তু ১০ বছর পর হয়ত আপনার চাল ক্রয় করার পরিমাণ ৩০০ কেজিতে নেমে আসছে। এই যে আপনার টাকার মূল্য হ্রাস পেল, তা কখনো ঘটতে পারবে না এবং দীর্ঘকাল ধরে এর মূল্য সমান থাকতে হবে। এটা ঠিক যে, টাকা-ডলার-রূপি ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এমনটা কখনোই সম্ভব নয়, কারণ নিয়মিত আমাদের বাজারে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে।
তবে, ‘স্বর্ণ-রৌপ্য’ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায়, এমনটা ঘটার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ, এক কেজি স্বর্ণ ১০ বছর আগেও যতটা মূল্যবান, ১০ বছর পরেও ততটা মূল্যবান। সামান্য যে পার্থক্য হতে পারে, তা কখনো টাকা-ডলার-রূপি ভিত্তিক অর্থ বাজারের মত নয়। এর মূল কারণ হল, স্বর্ণ বাজারে মুদ্রাস্ফিতি হবার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ তা চাইলেই তৈরি করা যায় না।
কিন্তু ভোগ্য পণ্যের বেলায়, প্রতিটি পণ্যের মূল্য দীর্ঘকাল ধরে একই রকম নাও থাকতে পারে। কারণ অনেক পণ্য আছে যা দ্রুত পচনশীল, আবার অনেক পণ্য আছে যা এক-দুই বছর সংরক্ষণ করা সম্ভব, যেমন: লবণ, মধু, খেজুর ইত্যাদি।
৪. বিভাজনযোগ্য
১ হাজার টাকার একটি নোটকে আপনি চাইলেই ৫০০, ১০০, ৫০, ২০ ইত্যাদি ছোট ছোট নোটে, বিভাজন করতে পারেন। আবার, ১ কেজি স্বর্ণকেও আপনি ৫০০, ১০০, ৫০ এবং ২০ গ্রামে, বিভাজন করতে পারেন। একই ভাবে যেকোন পরিমাণ ভোগ্য পণ্যকেও আপনি বিভিন্ন ওজনে বিভাজন করতে পারেন।
৫. সহজ পরিবহনযোগ্যতা
টাকা-ডলার-রূপি এবং স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে আপনি অতি সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে পারেন। কিন্তু ৫০ কেজি চাল, তেল বা গম নিয়ে আপনি চাইলেই সহজে অন্যত্র গমন করতে পারবেন না। অর্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, তা নিয়ে আপনি সহজে পরিবহন করতে পারবেন।
৬. অর্থের নিজস্ব মূল্য থাকবে
অর্থের সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নিজস্ব মূল্য থাকতে হবে। অর্থাৎ অর্থের নিজস্ব উপযোগ থাকতে হবে এবং তা কখনো কাল্পনিক হতে পারবে না। চাল, গম, আটা, চিনি, লবণ ইত্যাদি প্রতিটি ভোগ্য পণ্যের নিজস্ব উপযোগ আছে এবং তা হল আমাদের ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা। কখনো এমন নয় যে, সরকারের অধ্যাদেশে এই প্রতিটি ভোগ্য পণ্যের উপযোগ তৈরি হয়েছে। তাই পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন, এই প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের উপযোগ একই থাকে; অর্থাৎ, তাদের নিজস্ব একটি মূল্য থাকে।
কিন্তু টাকা-ডলার-রূপিভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় আসুন। এদের উপযোগ তখনই তৈরি হয়, যখন সরকার এই অর্থগুলোকে অনুমোদন করে। যদি ভারত রাষ্ট্র না থাকে, তাহলে আর কখনো রূপির উপযোগ থাকবে না। ধরুণ, আপনার একাউন্টে ৫ লক্ষ রূপি আছে এবং অন্য একজনের একাউন্টে মাত্র ১০ হাজার রুপি আছে। চীন এসে যদি ভারত দখল করে এবং ঘোষণা দেয়, আজ থেকে সকল রূপি বাজেয়াপ্ত করা হল, তাহলে সেই মুহুর্ত থেকে আপনাদের উভয়ের একাউন্ট (০০) শূন্য হয়ে যাবে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল যখন, আমেরিকা ইরাক দখল করে। সাদ্দাম সরকার পতনের যখন নতুন দিনার ইস্যু করা হয়, তখন আর পুরাতন দিনারের মূল্য ছিল না। মানুষ রাস্তায় তাদের দিনারের নোটগুলো ফেলে দেয়, কারণ এই দিনার দিয়ে আর কোন লেনদেন করা যাবে না। একই ভাবে মোদি সরকার যখন ৫০০ ও ১ হাজার রূপির নোট বন্ধ করল, মানুষ এগুলো দিয়ে আর কোন লেনদেন করতে পারেনি।
কিন্তু আপনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হউক বা যাই করা হউক না কেন, আপনার স্বর্ণ, রূপা এবং ভোগ্য পণ্যসমূহের মূল্য কখনো পরিবর্তিত হবে না। কারণ, এগুলোর নিজস্ব মূল্য ও উপযোগ আছে।
আসা করি অর্থের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এখন মোটামুটি পরিস্কার। এখানে অর্থ হিসেবে তিনটি উপকরণ উপস্থাপন করা হয়েছে, স্বর্ণ-রূপা, টাকা-ডলার-রূপি এবং ভোগ্যপণ্য। এবার খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন, এমন কোন উপকরণটি আছে যার মধ্যে অর্থের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অবশ্যই তা স্বর্ণ-রূপ, আর এ কারণেই হাজার হাজার বছর ধরে এটাই একমাত্র বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুতরাং, স্বর্ণ-রূপাই হল সত্যিকারের “অর্থ (Money)” এবং যে সকল কাগজের নোট আমরা ব্যবহার করি, তা হল Currency। ফলে লেখকের দাবিমতে, বর্তমান ডলারভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার পর আবারো স্বর্ণ-রৌপ্য ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা আবারো আমাদের ফিরে যেতে হবে।
বর্তমান অর্থ বাজারের কিছু খুঁত
দেখা গেল, স্বর্ণ-রূপা চাইলেই যখন ইচ্ছে মত তৈরি করা যায় না, তাই তাদের মূল্যও কখনো হ্রাস পায় না, যেখানে ব্যাংকারগণ ইচ্ছে মত নতুন নতুন নোট তৈরি করে বাজারে ছেড়ে দিতে পারে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, ব্যাংক চাইলেই নতুন নোট ইস্যু করতে পারে না। এর জন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য জমা রাখতে হয়, সরকারের কাছ থেকে এবং বিশ্বব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে হয়, আরো অনেক কিছু। এ সবগুলোই হল ভুল ধারণা, আর আমরা এমনটা ভাবি কারণ এভাবে আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে পড়ানো হয়েছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম একটি প্রাইভেট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং মার্কিন সরকার এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরকারই যদি হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তাহলে নতুন নতুন নোট ইস্যুতে সরকারের অনুমতিই বা কেন নিতে হবে!
এটা ঠিক যে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য জমা রেখে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম তাদের সর্বপ্রথম ডলার নোটটি বাজারে ইস্যু করে এবং এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ইস্যু করতে হয়। কিন্তু তারপর পরই ঘটনা পাল্টে যায়। ছোট্ট করে বলছি, ১৯১৩ সালের আগ পর্যন্ত আমেরিকার মানুষ স্বর্ণ-রৌপ্যভিত্তিক বিনিময় মাধ্যমে বিশ্বাসী ছিল। তাই সরকারের করা তারা কাগজের নোটের উপর বিশ্বাস আনতে পারেনি। এ কারণে Mr. Taft এর আমলে Federal Reserve System নিয়ে অনেক বিতর্কের জন্ম হয়। সেই আলোচনাগুলো এখানে আর বাড়াবো না।
তবে আমরা শুধু এটাই শুনে আসছি যে, স্বর্ণ-রৌপ্য জমা রাখার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নোট ইস্যু করে। কিন্তু কি পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে কতটুকু অর্থ ইস্যু করে তা আমরা জানি না। ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ঘোষণা দেয়, তার ১ আউন্স স্বর্ণের বিনিময়ে ২০ ডলার করে বাজারে ইস্যু করছে। ১৯১৩ সালের আগে বাজারে যে ব্যাংক চেক নোটগুলো ছিল, তার সাথে আমেরিকান ডলারের যথেষ্ট মিল ছিল। জনগণকে বুঝানো হল, এই প্রতিটি ডলারের নোট হল এক একটি চেক নোট এবং তার বিপরীতে সমপরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করা আছে। ঠিক যেমন, আপনার চেকের উপর লেখা আছে ১০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক একাউন্টেও জমা করা আছে সমপরিমাণ টাকা। আপনি যদি চেক নোটটি ব্যাংকে যেয়ে জমা দেন, তাহলে আপনাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। একইভাবে বলা হয়, ২০ ডলারের প্রতিটি নোট যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়, তাহলে বাহককেও ১ আউন্স করে স্বর্ণ দিয়ে দেওয়া হবে। এ কারণেই চেকের মত যেকোন নোটের উপর লেখা থাকে, “চাহিবা মাত্র গ্রাহককে প্রদান করিতে বাধ্য”। চেক নোটের উপর বাম পাশে যেমন কালো কালি দিয়ে একাউন্ট নাম্বার লেখা থাকে, তেমনি ডলার-টাকা-রূপি প্রতিটি নোটের উপরও কালো কালি দিয়ে একটি নাম্বার লেখা থাকে, যেমন: “খ ক ২ ৪ ০ ৪ ৭ ২ ২”। এ নম্বরের অর্থ হল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই একাউন্টটিতে ২০ ডলারের বিপরীতে ১ আউন্স স্বর্ণ জমা করা আছে এবং বাহক ডলার নোটটি জমা দেওয়া মাত্রই তাকে স্বর্ণ প্রদান করা হবে। কিন্তু এই স্বর্ণ আর কখনো প্রদান করা হয় নি।
এবার কিছু নতুন ব্যাপার জানি। যেমন, আমরা জানি যে, সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ গ্রহণ করে, তবে তা ঋণ হয় না। কিন্তু আমেরিকান ট্রেজারি বিভাগ এবং আমেরিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি আলাদা বিষয়। আমেরিকান সরকারের যদি কখনো ডলারের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে ফেডারেল রিজার্ভের কাছ বন্ড জমা রেখে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ গ্রহণ করে। ধরুণ, আজ ১৯১৪ সাল এবং আজকেই প্রথম ডলারের নোটটি বাজারে ইস্যু করা হবে এবং আমেরিকান সরকারকেও বন্ড জমা রেখেই সে অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ, প্রথমদিন থেকেই আমেরিকান সরকার তথা পুরো জাতি ইহুদী ব্যাংকারদের কাছে ঋণী হয়ে গেল। ধরুণ আমেরিকান সরকার, ১০ শতাংশ হার সুদে, ১০ বছরের জন্যে, ১০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিল। তাহলে ১০ বছরের পর, সুদে-আসলে, ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমকে প্রদান করতে হবে ২০ মিলিয়নের অধিক ডলার। প্রশ্ন হল, বাজারে মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারের অস্তিত্ব আছে এবং আমেরিকান সরকার কেবল ১০ মিলিয়ন ডলারই প্রদান করতে সক্ষম। সুদ থেকে যে বাকি ১০ মিলিয়ন ডলার জন্ম নিল, তা আমেরিকান সরকার কিভাবে প্রদান করবে? তিনি তো আর ডলার তৈরি করেন না। এভাবে আমেরিকান সরকার যত যত ডলার ঋণ নিবে, তত পরিমাণ জাতীয় দায় তৈরি হবে, যা কখনো সামগ্রিকভাবে প্রদান করা সম্ভব হবে না। এবার একটি বিষয় কল্পনা করুন, আমরা প্রায়ই শুনি আমেরিকার জাতীয় দায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলার, ইংল্যান্ডের জাতীয় তাদের তাদের মোট সম্পদের সাড়ে তিনগুণ, জাপানের ৬ গুণ, ফ্রান্সের ৪ গুণ এবং আরো অনেক। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ এখন জাতীয় দায়ের মাঝে আটকা পরে আছে। যা হতে কখনো বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। বাজারে যত টাকা-ডলার-দিনার-রিয়াল-রূপি যাই আছে না কেন, সব যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে দেওয়া হয়, তারপরও জাতীয় দায় কখনো মিটবে না। কারণ, সুদের অর্থ কিভাবে প্রদান করা সম্ভব! এ কারণে বলা হয়, সুদ হল সব অপকর্মের মূল এবং বৈশ্বিক দারিদ্রের প্রধান কারণ। ফলে এ বিষয়টি এখন পরিস্কার যে, ব্যাংক চাইলেই নতুন নতুন ডলার-টাকা-রূপি তৈরি করতে পারে, যদিও তা অদৃশ্য সুদ আকারে থাকে।
কমিউনিজমের একটি বৈশিষ্ট হল, মানুষ অর্থশূন্য হবে (Moneyless)।ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ঘোষণা দিল, ১৯১৪ সালের পর থেকে আর কোন লেনদেন স্বর্ণ বা রূপার বিনিময়ে হবে না, হবে ডলারের বিনিময়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা তখন পর্যন্ত মানতে চায়নি। ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দেন, সবাই যেন ১৯৩৪ এর মার্চের মধ্যে তাদের সকল স্বর্ণ-রৌপ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে সমপরিমাণ ডলার নিয়ে আসে। নতুবা, নতুন আইনের আওতায় তাদের সবার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। আমেরিকার অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কাছে জমা রেখে আসে। মাত্র তার কিছুদিন পর, ১৯৩৪ সালেই, ফেডারেল রিজার্ভ ঘোষণা দেয়, এখন থেকে ১ আউন্স স্বর্ণের মূল্য হল ৩৫ ডলার এবং আমেরিকান সরকারও এতে অনুমোদন দেয়। মাত্র একটি ঘোষণাতে ১ আউন্স স্বর্ণের বাজার মূল্য ২০ ডলার থেকে ৩৫ ডলারে নেমে আসল। অর্থাৎ, ডলার তার ৪০ শতাংশ মূল্য হারাল এবং আমেরিকার প্রতিটি সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হল। কিন্তু যাদের হাতে স্বর্ণ ছিল বা যারা তাদের স্বর্ণ লুকিয়ে রেখেছিল, তারা মুহুর্তের মধ্যে বড়লোক হয়ে গেল।
এরপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র ছয় মাস আগে আয়োজন করা হয় ব্রেট্টন উডস (Bretton Woods) সম্মেলন, যার মূল আসনগুলোতে আবারো নিউ ইয়র্ক তথা ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ইহুদী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আসন গ্রহণ করে। তারা নতুন এক অর্থব্যবস্থার প্রস্তাবনা করে, যেখানে ডলার হবে পৃথিবীর একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিনিময় মাধ্যম এবং পুরো পৃথিবীর যাবতীয় সকল প্রকার আন্তর্জাতিক লেনদেন ডলারে সংগঠিত হবে। কিন্তু কোন দেশ এই প্রস্তাব মেনে নিতে চায়নি, কারণ ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম চাইলেই ইচ্ছে মতো ডলার প্রিন্ট করতে পারবে এবং ডলার প্রিন্ট করার একক ক্ষমতা কেবল তাদেরই আছে। এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার কেউ থাকবে না।
ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম সেই পুরানো কথা আবারো বলল, তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্যের ভিত্তিতে ডলার প্রিন্ট করবে এবং ১ আউন্স স্বর্ণের ভিত্তিতে ৩৫ ডলার করে ইস্যু করা হবে। একই ভিত্তিতে প্রতিটি দেশ চাইলে আমেরিকা থেকে ডলার কিনে নিতে পারে। অর্থাৎ, প্রতিটি দেশ যেন তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো জমা করে রাখা স্বর্ণ-রৌপ্যগুলো ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমকে প্রদান করবে এবং প্রতি ১ আউন্স অনুপাতে ৩৫ ডলার করে তারা নিজ দেশে নিয়ে আসতে পারবে। এই বিষয়টি মনিটর করার জন্যে জন্ম নেয় “বিশ্ব ব্যাংক (World Bank)”। এছাড়াও, ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম বলে দেয়, যেহেতু প্রতিটি দেশ চাইলেই নতুন ডলার তৈরি করতে পারবে না, তারা নিজ নিজ দেশে, আভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সম্পাদনের জন্যে, নিজেদের মত করে, নতুন নতুন নোট (Currency) তৈরি করতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক লেনদেনে অংশগ্রহণ করার সময় তারা নিজেদের নোটগুলোকে বিনিময় হারের (Exchange Rate) ভিত্তিতে ডলারে পরিবর্তন করে নেবে। এই বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্বে থাকবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওপর।
পুরোনো কথা আবারো বলা হয়, যদি কোন দেশ তাদের ডলারগুলো নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কাছে আসে, তবে তারা ৩৫ ডলার অনুপাতে সমপরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। বিশ্বব্যাংক দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়: এক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে ইউরোপের প্রতিটি দেশকে সহযোগিতা করা; দুই, আন্তর্জাতিক শিল্প-বাণিজ্য তরান্ত্বিত করা। ফলে, প্রতিটি দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণগুলো ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এর কাছে জমা রাখতে শুরু করে। এভাবে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম প্রায় ১৪৪ টন স্বর্ণ সে সময়ে সংগ্রহ করে। ঔপনিবেশিক দেশগুলো তখন স্বাধীনতা লাভ করছিল। স্বাধীনতা লাভ করার পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়, তাদের প্রত্যেকটির একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকতে হবে এবং ‘ব্রেট্টন উডস’ সম্মেলনের এর সাথে সহমত প্রকাশ করে ডলার ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এভাবে, পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি চলে গেল ইহুদী ব্যাংকারদের হাতে।
এভাবে চলছিল অনেক বছর, মুদ্রাস্ফীতি, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি প্রতিটি দেশে বৃদ্ধি পেতে লাগল। ১৯৭০ সালে, আইএমএফ তার নিয়মিত কার্যক্রম নিয়ে ভয়ানকভাবে হিমশিম খেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড প্রায় ৩ বিলিয়নের অধিক ডলার নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কাছে হাজির হয় এবং বলে ৩৫ ডলার অনুপাতে সমপরিমাণ স্বর্ণ যেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এতদিনে ডলারের মূল্য তো আগের অবস্থায় নেই। তারা ইতোমধ্যে আরো অনেক নতুন নতুন ডলার তৈরি করেছে। যদি আজ ইংল্যান্ডকে শান্ত রাখার জন্যে তাদের দাবি অনুযায়ী স্বর্ণ দিয়ে দেয়, তাহলে কিছুদিন পর সৌদিআরব আসবে তাদের ডলার নিয়ে। যেহেতু আমেরিকা সৌদি আরবের কাছ থেকে ইচ্ছেমত তেল কিনেছে এবং তার বিনিময়ে কাগজের ডলার ধরিয়ে দিয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এই ঝুকি নিতে চায়নি, তাই তারা ইংল্যান্ডের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ১৫ আগষ্ট ১৯৭১, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণ-রৌপ্য ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, ডলারের পেছনে আর কোন স্বর্ণ থাকল না। তার কিছুদিন পর ডলারকে আবারো মূল্যায়িত করা হল, ১ আউন্স স্বর্ণ সমান ৪০ ডলার। কিন্তু ততক্ষণে ইউরোপের দেশগুলো তাদের স্বর্ণ ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। ডলার তার মূল্য হারালেও যেন পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি নিজ হাতে ধরে রাখা যায়, আমেরিকার ইহুদী ব্যাংকারগণ নতুন ফন্দি আটলো। তারা মধ্যপ্রাচ্যের তেল এককভাবে জব্দ করতে শুরু করল, যেন তারাই পৃথিবীর একমাত্র তেল রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে। ফলে মানুষ বাধ্য হবে ডলার ব্যবহার করে যেন আমেরিকার কাছ হতে তেল কিনতে হয়। ১৯৮০তে শুরু হল ইরান বিপ্লব, যার দরুণ ইরান আমেরিকার হাত ছাড়া হয়ে যায়। ফলে ডলারের মূল্য আবারো হ্রাস পায়। এর ১৯৮০ দশকে নামে অর্থনৈতিক ধ্বস, যেটা ২০০৮ সালে মহামারিতে রূপ নেয়।
ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়া প্রতিটি দেশ ডলার ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে সরে এসে স্বর্ণ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল, যার পরিণতি আমরা দেখছি। আমেরিকার সৈন্যরা ইরাক-লিবিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য আমেরিকান ইহুদীদের হাতে তুলে দিয়েছে, যা আমরা জানি না। তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র ছিল না, তারা যুদ্ধ করতে পাল্টা হামলা করতে পারেনি। কিন্তু এই ঘোষণা যদি কিছুদিন রাশিয়া বা চীন থেকে আসে, তাহলে ডলার মূহুর্তের মধ্যে মাটিতে পড়ে যাবে।
স্বর্ণ-রৌপ্য ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার গুরুত্ব
“সময় ও পরিশ্রম” মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। “অর্থ” (Money) হল আপনার সময় ও পরিশ্রমকে বিনিময় করার একটি মাধ্যম মাত্র। মনে করুন, আপনি কোন একটি প্রতিষ্ঠানে, প্রতিদিন আট ঘন্টা করে, এক মাসে প্রায় ২০০ ঘন্টা পরিশ্রম করলেন এবং এর বিনিময়ে আপনাকে ৪০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হল। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ যেকোন ভোগ্য দ্রব্য ক্রয় করতে পারেন। ধরুন, ৪০ হাজার টাকা দিয়ে আপনি আজ ৪ হাজার কেজি চাল কিনতে পারছেন। সমস্যা হল, এই একই পরিমাণ টাকা দিয়ে আপনি ১০ বছর পর আর ৪ হাজার কেজি চাল কিনতে পারছেন না। টাকা তার মূল্য ও ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে। এর কারণ হল, মুদ্রাস্ফীতি (Inflation), যার কথা আমরা সবাই জানি। এর ফলে আমাদের সঞ্চয় ভিত্তিক মনোভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
সুতরাং, আপনি চাইলেও স্বাভাবিক উপায়ে সৎ থেকে অর্থ সঞ্চয় করতে পারছেন না। এবার আপনি ভাবলেন, তাহলে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা যাক এবং এখান থেকে যে সুদ আসবে, তা দিয়ে ক্ষতি মোকাবিলা করা যাবে। তাহলে আপনি আরো ভুল করবেন। কারণ, আপনি ব্যাংককে আপনার অর্থ নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব দিচ্ছেন না; বরং, আপনি ব্যাংককে ব্যবসা করার জন্যে আপনার অর্থকে মূলধন হিসেবে প্রদান করছেন। ব্যাংক যখন দেউলিয়া হয়ে যাবে, তখন আপনার মত হাজার হাজার মানুষ পথে বসবে, যেমনটা হয়েছিল ২০০৮ সালে পুরো ইউরোপ জুড়ে। আপনারা হয়ত ভাবছেন, কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নতুন নোট ইস্যু করার ক্ষমতা আছে, অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেই। সত্যি বলতে, যখনই ব্যাংক অন্য কাউকে ঋণ প্রদান করে, তখনই সে নতুন নতুন টাকা তৈরি করছে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ সিস্টেম। খুব ভালো হত, যদি নিম্নোক্ত প্রতিটি ঘটনা এবং তা ঘটার কারণ নিয়ে এখানে পরিপূর্ণ ভাবে আলোচনা করা সম্ভব হত। তাহলে আমরা বুঝতাম, আমাদের বর্তমান অর্থনীতি কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,
- ১৯২২ সালের জার্মান অর্থনীতির Hyper-inflation
- ১৯৩০ এ আমেরিকার অর্থনীতির Great Depression
- ১৯৮৬ সালে আমেরিকান অর্থনীতির Great Crisi
- ২০০৮ সালে ইউরোপীয় অর্থনীতির Meltdown
এমন অনেক বিষয় আছে, যা নিয়ে অন্য কোন দিন হয়তো বিস্তারিত আলাপের সুযোগ হবে।