বেইল-আউট কি ব্যাংক রক্ষা করতে পারবে

বেইল-আউট কি ব্যাংক রক্ষা করতে পারবে

বেইল আউট কী?

সংক্ষেপে প্রচলিত মানেটাই বলা যাক। যখন কোন কোম্পানিকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বা কোন দেশকে তার চরম আর্থিক সংকটকালে (প্রায় দেউলিয়া অবস্থায়) উদ্ধারের জন্য সম্পদ সহায়তা দেয়া হয়– তাকেই ‘বেইল আউট’ বলা হয়। এইরূপ সহায়তা দেয়া হতে পারে ঋণ, ঋণের গ্যারান্টি, নগদ সহায়তা, বন্ড বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় করে।

এই মুহূর্তে বেইল আউটের প্রশ্ন কেন উঠলো?

এটা আসলে আগেই ওঠা উচিত ছিল। কারণ ২০১০-১১ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বেইল আউট পেয়েছে। (নিউ এইজ, ১৫ ফে.)। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। সাতটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক সম্প্রতি সরকারের কাছে আবারও মূলধন সংকট সামাল দিতে ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা সমমানের বেইল আউট চেয়েছে। যেমন, সোনালি ব্যাংক ২০১৩ সালে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা যার কিছুই উদ্ধার হয়নি। এখন তারা সরকারকে বলছে ৬ হাজার কোটি টাকা তাদের দিতে হবে। একইভাবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা চাইছে দুর্নীতির জন্য প্রচার মাধ্যমে বারংবার নাম উঠে আসা বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু কেন এই বেইল আউট হতেই হবে সে নিয়ে সমাজে কোন আলাপ-আলোচনা-বিতর্ক নাই।

আজ বৃহস্পতিবার বেইল আউট নিয়ে ডেইলি নিউ এইজ এর প্রতিবেদনের স্থিরচিত্র।

এবারের অংকটা কী অনেক বড়?

যদিও বেইল আউটের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো নীতিগত, অংকগত নয়– কিন্তু এও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ব্যাংকগুলো সর্বশেষ যে অংক বেইল আউট হিসেবে চেয়েছে তা নেহায়ত ছোট নয়। যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যায়, এটা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে নির্ধারিত বরাদ্দের (৪৫ হাজার কোটি) প্রায় অর্ধেক। একই বছরে বাজেটে শ্রম মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের (২০৩ কোটি) চেয়ে তা প্রায় ১০০ গুন বেশি!

মুখ্যত রাষ্ট্রীয় কোন কোন বিবেচনায় বেইলআউট গ্রহণযোগ্য নয়?

এটা অর্থনীতির অন্যখাতে অর্থপ্রবাহকে সীমিত করে ফেলে। বিশেষ করে এটা উৎপাদনশীল খাত ও উদ্যোক্তাদের দিক থেকে অর্থ চালিত করে অকর্মণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্তদের দিকে– লোকসানী খাতের দিকে। এর ফলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে বাধ্য। রাষ্ট্র যখন বেইল আউটের দায়িত্ব নেয় নিশ্চিতভাবে তা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ অন্যান্য জরুরি খাতগুলো থেকে ব্যয় সংকুচিত করেই করে থাকে। এর ফলে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়। এছাড়া অর্থনীতির এই সূত্রও স্মরণযোগ্য যে, ‘bad bailouts actually make financial crises worse’.

বেইল আউটের স্বপক্ষে কী কোন যুক্তি নেই?

আছে। প্রথমত এর মাধ্যমে সংকটগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়। সাধারণত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই বেইল আউটের দাবি ওঠে। এর ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরা তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হন। অনেকে বেকার হওয়া বা আর্থিক সুবিধা বঞ্চিত হওয়া থেকে রক্ষা পান। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে ফ্যাইনানসিয়াল সিস্টেমের ভেঙ্গে পড়া তথা অস্থিরতা রোধ করা হয়। বলা হয় যে, এটা ভেঙ্গে পড়লে যত ক্ষতি হবে বেইল আউটের ক্ষতি তার চেয়ে কম। এইরূপ যুক্তি কার্যত সরকার ও আমলাতন্ত্রকে তাৎক্ষণিক জবাবদিহিতা থেকে রেহাই দেয়। রাজনীতিও এ থেকে বড় আকরে লাভবান হয়।

ব্যাংক বেইল আউটের ক্ষেত্রে আরেকটি যুক্তি দেয়া হয় যে, এর মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থও রক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা করা হয় জনগণের টাকা দিয়ে– দুর্নীতিগ্রস্তদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধার করে নয়। যুক্তিটি খুবই হাস্যকর যে, জনগণের টাকায় জনগণকেই উদ্ধার করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, আদমজী বাংলাদেশের বৃহত্তম কারখানা হিসেবে কৃষি অর্থনীতি ও শ্রম বাজারে বিপুল অবদান রাখার পরও লোকসানের সময় ‘মুক্তবাজার’-এর দোহাই দিয়েই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অথচ ব্যাংক বেইল আউটের দাবি নীরবে গ্রহণ করা হচ্ছে। স্পষ্ট যে, বেইল আউটেরও প্রবল শ্রেণি চরিত্র আছে।

 

বর্তমান ধারার বেইল-আউট কি মুক্তবাজার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক?

হ্যা। কারণ তা প্রতিযোগিতার শক্তিসমূহকে হেয় করে। এটা ব্যবসার নিম্নমানকে উৎসাহ যোগায়। ব্যবসায় চরম ব্যর্থতার পরও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং ব্যাংকিং খাতের রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানকে স্ব স্ব স্থানে বহাল রেখে ব্যাংকগুলোকে পুনঃপুন অর্থায়ন বাজারের জন্য একটা খারাপ বার্তা। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সফলকে আরও ওঠার এবং ব্যর্থকে একদম নিশ্চিহ্ন হতে দেয়াই সঙ্গত।

প্রতিনিয়তই নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে ‘বাজার’ই নির্ধারণ করবে অর্থনীতিতে কে টিকে থাকবে আর কে থাকতে পারবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিজস্ব অসামর্থ্যতায় প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে জনগণের অর্থ দিয়ে বাজারে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার যখন বিদ্যুত, গ্যাস, পানি ইত্যাদির দাম বাড়াচ্ছে তখন প্রতিযোগিতামূলক বাজার দরের দোহাই দিলেও রাষ্ট্র ব্যাংকগলোকে অজ্ঞাত কারণে কোন ধরনের সংস্কারের বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। এটা যৌক্তিকভাবেই প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সময় অসম প্রতিযোগিতায় ফেলছে এবং তাদের যোগ্যতার প্রয়োজনীয় প্রতিদান পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আরও স্পষ্ট করে বললে, অর্থনীতির টেকসই মডেলগুলোর বদলে বেইল আউট জ্বালানি সরবরাহ করে অযোগ্য ও ক্ষতিকর মডেলগুলোর দিকে। বলাবাহুল্য, এই আচরণ মুক্তবাজারে কাজ করে না। বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় ন্যূনতম যে সৌন্দর্যটুকু আছে বেইল আউট তাকেও খুন করে। এবং অনিবার্যভাবেই তা অর্থনীতির জন্য বিপরীত ফল বয়ে আনে। যেসব ব্যাংক অনিয়মের কারণে পুনঃপুন কোমর ভেঙ্গে বসে পড়ছে তাকে কখনোই বেইল আউটের মধ্যদিয়ে দাঁড় করানো যাবে না।

বেইল আউট কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?

কোন ভাবেই না। করদাতারা যে সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী নয়– তাদেরই সেই সংকটের জন্য শাস্তি দেয়া হয় এর মাধ্যমে– বিশেষত, যখন সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরিপক্ক ঝুঁকির কারণে দেউলিয়া অবস্থায় পতিত হয়। বেইল আউটের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতি একরূপ পরোক্ষ বৈধতা পায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের আচরণে অতীত ভুলের পক্ষে বৈধতা তৈরি হয়। তাদের ভবিষ্যত আচরণেও এর ছাপ পড়ে।

এমনকি কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি স্রেফ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণেও সংকটে পড়ে তাহলেও বেইলআউট ঐরূপ ঝুঁকি গ্রহণে ভবিষ্যতে অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ এভাবে বেইল আউট হতে থাকলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে যুক্তরা ভাবতে থাকে, একইরূপ আচরণ/সিদ্ধান্ত/চুরি/ঝুঁকি (risk) নিলে সমস্যা হবে না– কারণ এর দায়ভার (cost) বইবে অন্য কেউ।

একবার বেইল আউট হলে পরবর্তীকালের দুর্নীতিগ্রস্তদের জন্য তা একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি হয় এবং অনুরূপ বেইল আউটের জন্য চাপ তৈরির উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সেটা।

বেইল আউটের জন্য করদাতাদের অর্থ না দেয়ার আরেকটা যুক্তি হলো– যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করছে তারা জেনে-বুঝে অনিয়ম করলেও এর দায়ভার বইতে হচ্ছে এমন কাউকে যে পুরো বিষয়টির কিছুই জানে না। যেমন বাংলাদেশে যখন ব্যাংকগুলোকে ২০ হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে তখন এর হিস্যা বইতে হবে সেই সব গ্রামীণ মানুষকেও যারা এখনও হয়তো ব্যাংকিং সিস্টেমেই অন্তর্ভুক্ত নয়।

এসব বিবেচনায় অর্থশাস্ত্রে এখন বেইল আউটকে ‘মোরাল হ্যাজার্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটা ভবিষ্যতে আরও বড়সংকটকে নিকটবর্তী করে তোলে। অর্থাৎ, বেইল আউট আসলে বড় ভবিষ্যত সংকটের বীজ রোপন করে মাত্র। যার প্রমাণ ২০১১ থেকে বেইল আউটের পরও এবার আবারও বড় অংকের বেইল আউটের দাবি উঠেছে।

বেইলআউট কি ন্যায়বিচারের সাংঘর্ষিক?

নিশ্চয়ই। কারণ এর ফলে আর্থিক সংকটের কারণগুলো চিহ্নিত করার কাজ আড়ালে পড়বে। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থার জন্য কিছু ব্যক্তি যে দায়ী সেটা মাননীয় অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে এবং প্রচারমাধ্যমে বহুবার বলেছেন। কিন্তু কীভাবে তারা পুনঃপুন এরূপ ঘটনা ঘটলো– দেশে এবং বিদেশে কারা এর সঙ্গে জড়িত সে বিষয় ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত ছাড়া, বিচার ছাড়া জনগণের অর্থ দিয়ে বেইল আউট করার দাবি উঠেছে। এটা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে প্রশ্ন তৈরি হয়– কাকে বেইল আউট করা হচ্ছে, অনিয়মকারীকে না কি অনিয়মকারীকেও? বিশেষকরে যে দেশে ৫-১০ হাজার টাকা কৃষিঋণ দিতে না পারায় দুর্যোগগ্রস্ত কৃষককেও মামলার মুখে পড়তে হয় এবং কোমরে দড়ি পড়ে– সে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকিং অনিয়মকে বেইল আউট দেয়া বিচারের ক্ষেত্রে চরম দ্বৈততাকে নির্দেশ করে। এছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরে (এমনকি অন্য কোন সেক্টরের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য) যেসব রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেইল আউট তাদেরও আইনগত জবাবদিহি থেকে রেহাই দেয়।

বেইল আউট কি বাড়তি কোন সমস্যা তৈরি করতে পারে?

মুদ্রা মান, মূল্যস্ফীতি ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে। যেসব দেশে বেইল আউট হয় সেটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় কোন স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না। এছাড়া এর ফলে স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যেতে পারে এবং মূদ্রাস্ফীতিও বাড়তে পারে। ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে চেক এন্ড ব্যালেন্সের অবক্ষয়ও নির্দেশ করে বেইল আউট।

তারপরও কেন বেইল আউট ঘটে?

বিপুল নেতিবাচক কারণ থাকার পরও বিশ্বব্যাপি দেখা গেছে, যখনই বেইল-আউট ঘটে– তখনই তা ঘটছে মূলত আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের স্বার্থে। সাধারণ জনগণ অর্থনীতির এইসব খুটিনাটি ও আপাত জটিল বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আগ্রহী ও সচেতন নয়। বেইল আউটের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমতের কোন তোয়াক্কা না করে গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্যাংক খাত রক্ষার নামে এগুলো আসলে দলীয় লোকজনের আখের গোছাতেই কাজ করে।