ক্রাইস্টচার্চ সন্ত্রাসী হামলা: রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র এবং সভ্যতার সংঘাত

আন্দ্রেয় কোরিবকো’র কলাম

ক্রাইস্টচার্চ সন্ত্রাসী হামলা: রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র এবং সভ্যতার সংঘাত

আন্দ্রেয় কোরিবকো একজন রাশিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার ফলে নিহত হয় ৫০ জন মুসল্লি। যার প্রেক্ষাপটে হামলাকারীর ইসতেহারের ‘সভ্যতার সংঘাত’ এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ কৌশলের ব্যর্থতা নিয়ে কলাম লিখেছেন তিনি। ইউরেশিয়া ফিউচার ডটকম থেকে লেখাটি জবান’র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, তুহিন মোহাম্মদ


গত শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা চালিয়ে অস্ট্রেলিয়ান এক সন্ত্রাসী অন্তত ৫০ জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, একই সাথে সে এই হত্যালীলা ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এরপর থেকেই সারা পৃথিবী শোকে মূহ্যমান।

এছাড়াও ঘাতক সেখানে এমন ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভূক্ত করেছে যারা পূর্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এবং সে তার ম্যানিফেস্টোতে কুখ্যাত একটি বিট্রিশ-পাকিস্তানি গ্রুমিং গ্যাং’এর কথা বলেছে। সে একটি ফ্যাসিবাদী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে যেখানে মুসলিমদের প্রতি তার প্রচন্ডঘৃণাকে ভাল মতো হাজির করা হয়েছে।

 

এই হামলার সমস্ত লক্ষণ এই ধারণা দেয় যে, সে ‘সভ্যতার সংঘাত’কে ছড়িয়ে দিতে খুবই সক্রিয়। (যা প্রাচ্যকে বিভক্ত ও শাসন করার জন্য খুবই মোক্ষম একটি নীলনকশা) অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের ক্রুসেড বা ধর্মযোদ্ধাদের ‘স্মরণ’এ তার অস্ত্রের খোদাই করা উস্কানিমূলক ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান, যুদ্ধক্ষেত্র এবং স্লোগান— এই সভ্যতার সংঘাতকে উস্কে দেওয়ার উগ্রবাসনারই  ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়াও ঘাতক সেখানে এমন ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভূক্ত করেছে যারা পূর্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এবং সে তার ম্যানিফেস্টোতে কুখ্যাত একটি বিট্রিশ-পাকিস্তানি গ্রুমিং গ্যাং’এর কথা বলেছে। সে একটি ফ্যাসিবাদী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে যেখানে মুসলিমদের প্রতি তার প্রচন্ডঘৃণাকে ভাল মতো হাজির করা হয়েছে।

যখন ‘কপিক্যাট’ আক্রমণগুলোতে অতিরিক্ত ঝুঁকি থাকে এবং মতাদর্শগত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চরমপন্থীদের প্রতিশোধমূলক সহিংসতার সম্ভবনা দেখা দেয়, তখন সুস্পষ্টভাবে হামলাকারীর ‘অনিয়ন্ত্রিত’ সহিংসতার উদ্দেশ্য হ্রাস পায়। কেননা, এর জন্য দায়ী ব্যাক্তিরা জানে যে এই দৃশ্য আসলে তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি নাটক এবং তারা ওই ‘সন্ত্রাসী হামলা’কে কৌশগতভাবে ‘সফল’ করে। এর মানে এই নয় যে, এরপরের সন্ত্রাসী হামলাগুলো এই হামলার দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে না, কিন্তু এর প্রভাব এমনভাবে পড়বে না, যা হামলাকারী ভেবেছিলো। তারপরও সে ‘সভ্যতার সংঘাত’র বক্তব্য সমাজকে গ্রহণে বাধ্য করাতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়েছে।

যে কোন ক্ষেত্রে, পরিকল্পিত হামলার জন্য সন্ত্রাসীরা মুখিয়ে থাকবে, তা যে ইস্যুতেই হোক না কেন? কিন্তু রাষ্ট্রের স্থায়ী আমলাতন্ত্রের (ডিপ স্টেট) ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কাজ এই সকল হুমকি বাস্তব রূপ নেওয়ার আগে চিহ্নিত করা এবং তা কারও ক্ষতিসাধন করার আগে নিষ্ক্রিয় করা, এবং এই এখানে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ তাদের জনগণ এবং প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ডের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এটা কল্পানাতীত যে, রাষ্ট্রের ভেতরকার রাষ্ট্রটির একজন ব্যক্তিও ভাবেনি যে, একজন সন্ত্রাসীকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। যে কিনা ক্রিপটোকারেন্সি বিক্রির উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে এবং ‘স্পর্শকাতর’ দেশগুলোতে ভ্রমণ করে । যেখানে পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো সাধারণত তাদের ‘সন্দেহভাজন’ বলে চিহ্নিত করে থাকে।

হামলাকারী উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং তুর্কির মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করেছে যা তাদের জন্য কোনরূপ ‘সন্দেহজনক’ নয়। কিন্তু সাধারণত ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি দ্বারা একে ‘রেড ফ্লাগ’রূপে ব্যাখা করা হয়, যখন পশ্চিমাদের কেউ কোন ধরনের বাহ্যিক সম্পর্ক ছাড়া হঠাৎ করেই এই সকল দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বা যায়।

 

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, হামলাকারী উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং তুর্কির মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করেছে যা তাদের জন্য কোনরূপ ‘সন্দেহজনক’ নয়। কিন্তু সাধারণত ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি দ্বারা একে ‘রেড ফ্লাগ’রূপে ব্যাখা করা হয়, যখন পশ্চিমাদের কেউ কোন ধরনের বাহ্যিক সম্পর্ক ছাড়া হঠাৎ করেই এই সকল দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বা যায়।

নাইন ইলেভেন’র (৯/১১) পর পাশ্চাত্য জুড়ে বেড়ে যাওয়া ‘জাতীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্র’ যাকে তথাকথিত ‘ফাইভ আই’ স্টেটও বলা হয়। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। এই রাষ্ট্রগুলো, বিটকয়েন বিক্রি কিংবা ২০ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের ব্যক্তি যারা এ সকল দেশে ভ্রমণ করে, তাদের হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না, কিন্তু তারা তাদের উপর কড়া নজর রাখে।

আপনি শুধু অনুমান করতে পারেন, অস্ট্রেলিয়ান ‘ডিপ স্টেট’র ইন্টেলিজেন্স উইং কি জানতেন এবং কখন জানতেন? কিন্তু এটা অদ্ভূত হবে, যদি তারা জেনেও তাকে ন্যূনতম ‘পারসন অফ ইন্টারেস্ট’ হিসেবে বিবেচনা না করে। এমনকি অদ্ভূত হবে, যদি তাদের কাছে ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে ভ্রমণ এবং ভ্রমণের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রির উপর নির্ভর করা ব্যতিত অন্য কোন প্রমাণ না থাকে।

এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, এটা আশ্চর্য হবার নয়— যদি বেরিয়ে আসে যে, সে কারও দ্বারা ‘ফ্লাগড’ হয়েছিল কিংবা কারো দ্বারা ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল কিন্তু সেই তথ্য অনুসরণ করা হয়নি কিংবা তা অন্যদের সাথে শেয়ার করা হয়নি। আবার এটাও ধারণা করা যেতে পারে, এই ঘটেছে তা মূলত ঘটেছে আমলাতন্ত্রিক দুর্বলতার কারণে যা আরও ক্ষতিকর লক্ষণ। কিংবা এটাও তদন্তের ফল হতে পারে যে, প্রথম ইস্যুতে তদন্তের কোন প্রয়োজনই ছিল না।

যাইহোক, এই ঘটনার কিছু রাজনৈতিক পরিণতি অনুমান করা সম্ভব। এটি ইতিমধ্যে বলা হয়েছে যে হামলাকারীর ‘ক্লাস অফ সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার সংঘাত’মূলক বক্তব্য সম্ভবত ব্যর্থ হবে। কেননা এটি সুস্পষ্ট ছিল কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কিছু দেশ এবং তাদের ইতিহাস (বিশেষ করে বলকান রাষ্ট্র) ‘বর্ণবাদী’ কিংবা ‘ইসলামোফোবিক’ হিসেবে নিজেদের চর্চা বাদ দিবে। এবং ঘাতক দাবি করেছে যে, সে তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

এটা এখন দেখার বিষয় যে, এটাকে এখন অন্য কোন্ উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করা হতে পারে। কিন্তু এটি সনাক্ত করা উচিত এবং কী ঘটতে পারে সে বিষয়ে আগাম সতর্ক থাকাও উচিত। এই ঘটনার অন্য আরেকটি রাজনৈতিক পরিণতি হলো— পশ্চিমা ‘ডিপ স্টেট’ সাধারণভাবে ‘ডানপন্থী’ ব্যক্তিদের সূক্ষ তদন্ত করবে যারা এই দেশগুলোতে ভ্রমণ করে।

হামলাকারীর উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এং তুর্কি ভ্রমণের কারণ অজানা (এ ক্ষেত্রে এটি কোন সন্দেহজনক কাজ নয়, যদিও খুবই হতাশাজনক যে— একজন ইসলামোফোবিক ব্যক্তি দু’টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভ্রমণ করছে), সরকারি নজরদারি কিংবা কর্তৃপক্ষের অতিমাত্রার নিষেধাজ্ঞার ভয়ে পশ্চিমা পর্যটকেরা এই স্থানগুলো ভ্রমণ থেকে বিরত থাকবে। এটি উত্তর কোরিয়ার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু তুরস্কের প্রতিষ্ঠিত পর্যটন শিল্প, এবং পাকিস্তানের পর্যটন শিল্পের উপর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে হামলা-পরবর্তী সময়ে কিছু পশ্চিমাদের পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাবের কারণে এই দুই দেশকে দোষারোপ করা হবে, হয়তো হাস্যকর ভাবেই এটা করা হবে।

আরও স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে আইন পাশ করবে। এই মুহূর্তে এটা পরিস্কার নয় যে, এই পদক্ষেপগুলো কোন্ কাঠামোতে গ্রহণ করা হবে, তবে আগ্রহী সংগঠনগুলো এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপ দেবে, অন্যদিকে জনগণ এখনো ‘যা ঘটছে’ সে বিষয়েই বেশ আশাহত। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলার প্রধান পদক্ষেপ যদি তাই হয়, তাহলে হামলাকারী’র ‘সভ্যতার সংঘাত’র পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে ‘ডিপ স্টেট’র নিরাপত্তা কৌশল, তা সে যে কারণেই ঘটনাটা ঘটাক না কেন। কিন্তু এই দুঃখজনক ঘটনার পর সরকারগুলো তাদের নিজস্ব ক্ষমতা প্রসারিত করার চেষ্টা করবে।