১৯৭২ সালে সমগ্র পৃথিবীর নজর কেড়েছিলো এক ফিলিস্তিনি সংগঠন, যার নাম BSO বা ব্লাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন। ওই বছর পশ্চিম জার্মানির মিউনিখ শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। এই অলিম্পিক শুরুর ঠিক আগেই ফিলিস্তিনি এই সশস্ত্র সংগঠনটি হত্যা করে বসে ১১জন ইসরায়েলি অ্যাথলেট ও একজন জার্মান পুলিশ অফিসারকে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি মিলিটারি গ্রুপ ‘হাগানাহ্’র আগ্রাসনে চূর্ণ হওয়া দু’টি ফিলিস্তিনি গ্রামের নামানুসারে এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় ‘ইক্রিট ও বিরাম’। মূলত এই কাহিনির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘মিউনিখ’ সিনেমার গল্প।
সিনেমার কাহিনিতে এই ঘটনা থাকলেও এটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে একটি ভিন্ন স্বাদে। থ্রিলারধর্মী এই চলচ্চিত্রে রয়েছে স্পাই স্টোরি, অ্যাকশন ও প্যাশন।যদিও সিনেমাটি মোসাদ’র কাজের উপর ভিত্তি করে বানানো। মানে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ‘মিউনিখ মুভিকে আপনি ড্রামা বলতে পারেন, থ্রিলার বলতে পারেন আবার হিস্ট্রি মুভিও বলতে পারেন। আপনি যেভাবে গ্রহণ করবেন এই মুভি আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে।
কিন্তু সব ছাপিয়ে যে জিনিসটা আমাকে আকর্ষণ করলো সেটা হলো, একজন খুনির হৃদয়ের দ্বন্দ্ব। ক্ল্যাশ অফ মাইন্ডস অফ এ কিলার। মুভিটিতে কয়েকটা জায়গায় খুব গভীর কিছু ডায়লগ আছে, আমার স্মৃতির দুর্বলতার কারণে সব আমি স্মরণ রাখতে পারিনি, সেটার জন্য দুঃখিত। তবে এই সিনেমাতে আমরা যেটা দেখি সেটা হলো হত্যাকারীর বাইরে মানুষের একটা মন আছে, যেটা কোন কোন সময়ে তার ভেতরের সত্ত্বাকেকে নাড়া দেয়, তার কৃতকর্ম’র জন্য, তার জঘন্য অপরাধের জন্য তাঁর ভেতরও এক ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়।
যেমনটা এই ফিল্মে আমরা দেখি, মোসাদ এজেন্ট এভনার’র বেলায়। যাকে দেশপ্রেমের দোহায় দিয়ে মেন্টালি ইমোশন্যালি এক প্রকার ব্ল্যাকমেইল করে মিউনিখ অ্যাটাকে জড়িতদের হত্যা করতে নিয়োগ করা হয়। সেই সাথে নিয়োগ করা হয় আরো তিন চারজন বিভিন্ন পেশার ইসরায়েলিকে। তারা প্রথমে বেশ উৎসাহে কাজে নেমে পড়ে। ভাবে এগারোটা টার্গেট এগারোটা বুলেটে শেষ করে দিবে। কিন্তু নেমে টের পায়, এই এগারো জনে শেষ না। ছয় জনকে মারতে গিয়ে তাদের হাতে নিহত হয় আরও ডজন খানেক, যাদের সাথে তাদের কোন পরিচয় নেই, সবাই যার যার জায়গায় সাধারণ মানুষ আবার ভেতরে ভেতরে কেউ অন্য কারো বলির পাঠা। আসলে এই স্পাই, অ্যাসাসিনের দুনিয়ায় কে, কার জন্য, কার পক্ষে হয়ে খেলছে খেলোয়াড়েরা তা জানে না, জানে কেবল তাদের উপরের মহল, যারা আরাম কেদারায় বসে বসে হয়তো অর্ডার করে, আর টাকা দেয়। বুলেট তাদের স্পর্শ করেনা। মারতে মারতে এভনার’র মস্তিষ্ক একসময় বিদ্রোহ করে ওঠে। সে নিজের সাথেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আসলেই কি এই হত্যায় সব সমাধান করে দেবে, ইসরায়েলকে নিরাপদ করে দেবে। এভনার তার উপরের মহলকে জবাব দেয়. আমরা এগারোটা টার্গেট শেষ করবো তার বদলে আরো তেত্রিশ টার্গেট রিপ্লেস হচ্ছে। তার মানে এই হত্যার খেলার শেষ নেই, এভাবেই চলতেই থাকবে। সে মোসাদ ছেড়ে দেয়, মিশন আধা রেখে ছেড়ে দেয়। তারপর সে নিজেই হয়ে যায় টার্গেট। তাও নিজেদের লোকদের কাছে। তারমানে যতক্ষণ তুমি মারার মেশিন ততক্ষণ আমরা তোমাকে সাপোর্ট দিবো, তারপর হয়তো তুমিও টার্গেট। এই হল ব্যাপার । মোসাদ’র এই খেলা এক হাতেই শেষ হয় না, প্রতিটা রক্ত আবার তাদের দিকেই ফিরে আসে। এভনার’র দলের তিনজন একই কায়দায় গুপ্তহত্যার হয়, একজন নিজের বোমায় নিজেকেই উড়িয়ে দেয়, কারণ এই মানসিক যন্ত্রণা সে আর নিতে পারছিলো না। এভনার সরে যায়, তার জায়গায় আবার অন্যকেও একই চালে বলির পাঠা হয়ে মিশনে অংশ নেয়। ছয়জন টার্গেটকে মারতে মোসাদ ব্যায় করে দুই মিলিয়ন ইউএস ডলার। তার মানে এই খুনোখুনিতে প্রতিশোধ ও আইডিওলজির বাইরেও আছে টাকা। এই টাকার বেলায় কেউ কারো না শত্রু-মিত্র, সবাই এক।
দেখা যায় লুইস নামের যে ব্যক্তি হাজার হাজার ডলারের বিনিময়ে এভনারকে তথ্য দিচ্ছে, সে একই লোক টাকার বিনিময়ে আবার কেজিবিকেও তথ্য দিতেছে, সে আবার পিএলও’কেও সহায়তা করে। মিউনিখ কাণ্ডের একজন আবার সিআইএর এজেন্টও আছে বলে জানায় লুইস। তার মানে এখানে সবাই সবার স্বার্থ ও টাকার পেছনে আছে, আদর্শ মানবতা এসব হয়ে যাচ্ছে বাকওয়াজ, যেটা এভনার ফিল করে ধীরে ধীরে। সিনেমার একটা দৃশ্যে প্যারিসের একটা রুমে পিএলও ও মোসাদের এজেন্টরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে যায়, কিন্তু দুই পক্ষ জানে না কে কার লোক। এই সময় এভনারের সাথে আলির কথোপকথন হয়। এভনার বলে যে, ভূমিটা তো তোমাদের না সেটা পাবার আশা করো কেমনে? আলি বলে এক একটা জাতি একটা দেশ পাইতে কতো সময় লাগছে তুমি জানো? আমাদেরও হয়তো লাগবে, তোমরা ফিলিস্তিন দখল করেছো বর্বরতায়, আমাদের একশ’ বছর লাগলেও আমরা বিজয়ী হবো। আরবের অনেক জায়গা আছে কিন্তু নিজের ঘরে ফেরার মতো আনন্দ আর কিছুতে নাই। ঐ রিফিউজি ক্যাম্প আমাদের ঘর না।
লুইস আর এভনারের মধ্যে শেষের দিকের একটা কথোপকথন এমন— লুইস বলে, সালামিহ বড় টার্গেট, সিআইএ’র সাথে তার লিংক আছে, তুমি কি মনে করো তাকে ইলিমিনেট করলে তোমাকে ছেড়ে দেবে। দেখো তুমি যে কিচেনের শো রুমের সামনে দাড়িয়ে আছো, এমন একটা কিচেন তোমারো থাকতে পারে, তবে সেটা আন্তরিকতা দিয়ে বানাতে হয়। এইভাবে টাকা, ঘৃণায়, হত্যার বিনিময়ে এসব হয় না। মোসাদ’র তিন এজেন্ট এর মধ্যে একটা সময় ঝগড়া হয় এই নিয়ে, আমরা আসলে কি করছি, একজন মারছি তার জায়গায় রিপ্লেস হচ্ছে আরও ছয়জন। ফিলিস্তিনতো আমাদের মধ্যে আসেনি, বরং আমরাই তাদের এই অবস্থায় আসতে বাধ্য করেছি। এটা আমর দখল নিয়েছি, এখন তোমার কি মনে হয় এটা এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। না এটা হবেনা। সিনেমার শেষ অংশে দেখা যায়, মিউনিখ ম্যাসাকারের অনেকটা দায় জার্মানির ঘাড়েও বর্তায়। তারা ফায়ারিং শুরু না করলে এটা সম্ভবত হতোনা। আফটার অল এই খুনোখুনির খেলার শেষ নাই।এভনার বুঝতে পারে, সবার জায়গায় সবার কাজের পেছনে একটা লিগ্যাসি আছে। কিন্তু এই দুই এর মাঝে ঝরে যাচ্ছে অনেক নিরীহ প্রাণ। অন্যান্য সিনেমার তুলনায় এখানে কিলারের সাইকোলজিক্যাল ন্যারেটিভটা বেশ ভালো এসেছে। বিশেষত একজন সুদর্শন তরুণীকে মারার পরে তিনজন মানসিক অবসাদ ও বিষন্নতায় ডুবে যায়। তাদের মানসিক দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে উঠে। যতই কারণ থাকুক মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষের বুক ঝাঁঝরা করাটা সহজ না।সবার পেছনে আছে ঘৃণা, ক্রোধ। ভালোবাসাই পারে কেবল মুক্তির দিতে। দুনিয়া কি কখনো করবেনা সে ভালোবাসার চাষ?