ওরিয়ানা ফাল্লাসি, জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ জুন, ইতালির ফ্লোরেন্সে শহরে। ওরিয়ানা ফাল্লাসি একজন তুখোড় সাংবাদিক, লেখক, বিখ্যাত একজন রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী। তার সাংবাদিকতার বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধ, বিপ্লব, বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সংবাদ। বিশেষ করে ষাট থেকে শুরু করে ৮০ দশকের একজন বিখ্যাত সফল সাংবাদিক ছিলেন তিনি। ওরিয়ানা ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, ফ্লোরেন্সেই মৃত্যুবরণ করেন। ওরিয়ানার সাংবাদিক পরিচয়ের চেয়েও বড় যেই পরিচয়— তা হচ্ছে যৌবনে তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন ‘এন্টি-ফ্যাসিস্ট রেসিস্ট্যান্ট মুভমেন্ট’র সফল নেত্রী ছিলেন। ইতালির ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির পতনই ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। তাই পরবর্তীতে ফ্যাসিবাদী নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন।
ওরিয়ানা ফাল্লাসি ইয়াসির আরাফাত, জুলফিকার আলী ভুট্টো, মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি, শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভী, ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনী, হেনলি কিসিঞ্জার, আলফ্রেড হিচকক, ইন্দিরা গান্ধী, গোল্ডামায়ার, উইলি ব্র্যান্ট, দেং জিয়াও পেং, আন্দ্রেস পাপান্দ্রু, হাইলি সেলাসি, লেচ ওয়ালেসাসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
বেশ কিছুদিন আগেই ওরিয়ানা ফাল্লাসির একটি লিখা পড়ার পর তাকে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ ওরিয়ানার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ার কারণ ভিন্ন। কারণ, ওরিয়ানা কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে এক অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তৎকালীন সরকারের। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে ওরিয়ানাকে প্রায় প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরে আসতে হয়। শেখ মুজিবুর নিজেই ওরিয়ানাকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেন আর কখনই এদেশে পা না রাখেন। তার সাংবাদিক জীবনে এমন নোংরা অভিজ্ঞতা আর কখনই হয়নি।
স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশটির জন্য তখন প্রয়োজন ছিল একজন দেশপ্রেমিক মহানায়কের। এবং সেই মহানায়কটি হতে পারতেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জাতি গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলো শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গড়ার চেয়ে দেশের ক্ষমতা আজীবনের জন্য কুক্ষিগত করাই মূল উদ্দেশ্য। তিনি এক প্রকার একদলীয় শাসক হয়ে উঠেছিলেন এবং তার আত্বীয়স্বজন ও কাছের মানুষেরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। অথচ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের জনসাধারণ খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের শিকার। তখন মুজিবুর রহমানের ক্ষমতার দম্ভে দেশের মানুষ চরম হতাশ হয়ে পড়ে। এমনই সময়ে ওরিয়ানা ঢাকায় আসেন।
ওরিয়ানা ঢাকায় এসেই শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি সাক্ষাৎকার না দিয়ে দাম্ভিকতার সাথে তাকে বলে দেন যেন তার ব্যাক্তিগত সচিবের সাথে যোগাযোগ করেন। তখনই শেখ মুজিবুর রহমানের এমন হীন আচরণ দেখে ওরিয়ানা অনুমান করতে পেরেছিলেন মুজিব গণতন্ত্রী হতে পারেন না। যাহোক মুজিবের সচিব পরের দিন বিকাল ৪ ঘটিকায় সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু পরের দিন ওরিয়ানাকে একা বৈঠক ঘরে বসিয়ে রাখা হয় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। রাত সাড়ে ৮টায় নির্ধারিত সময়ের চাইতেও অল্প সময়ের ভিতর মুজিব সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করেন অনেক স্ব-বিরোধী কথা বলে। ওরিয়ানা তখনই ভাবেন বাঙালি জাতির স্বপ্নভঙ্গ হবে অচিরেই।
সেদিনের সেই সাক্ষাৎকারে ‘ঢাকা স্টেডিয়াম’এ পৈশাচিক এক উম্মাদনায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মানুষ হত্যার কথা অস্বীকার করেছিলেন। যেই হত্যাকাণ্ডের ছবি কয়েক শত বিদেশি সাংবাদিকরা তুলেছিল এবং বহু বিদেশি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। তাছাড়া ওরিয়ানা নিজেও ৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের সেই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। সেই হত্যাকাণ্ডের ছবিও ওরিয়ানা তার সাথে থাকা ব্যাগ থেকে বের করে দেখিয়েছিল্ন এবং এও জানান যে, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে স্টেডিয়ামে নিহতদের অধিকাংশই দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। সেদিনের সেই সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তি-তর্কে হেরে গিয়ে এক পর্যায়ে ওরিয়ানার কাছে সেই হত্যার কথা স্বীকার করেই তৎক্ষনাৎ রেগে গিয়ে ওরিয়ানাকে বের করে দিয়েছিলেন। পরের দিনই গোটা ঢাকাবাসী জানতে পারে ওরিয়ানা ফাল্লাসির সাথে মুজিবের বিরোধের কথা।
সেদিনের ঘটনার দুইদিন পর মুজিবের সাথে ওরিয়ানার সাক্ষাতের সময় আবার বিকেল ৪টায় নির্ধারিত হলেও রাত ৯টা পর্যন্ত মুজিব ওরিয়ানাকে বসিয়ে রেখে সাক্ষাৎকার না দিয়ে পরেরদিন সকাল ৭:৩০ মিনিটে সাক্ষাতের সময় দেন। কিন্তু মুজিব মার্সেডিজ গাড়িতে করে আসেন সকাল ৯:৩০ মিনিটে। সেদিন ওরিয়ানা আবারও ভুট্টো সংক্রান্ত এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্নটি আবারও করলে মুজিব চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিদেশি এই নারী সাংবাদিককে ধমক দিয়ে দুর্ব্যাবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী ওরিয়ানাও কম নন। তিনি সেদিন মুজিবুর রহমানের মুখের উপর ‘তিনি গণতন্ত্রী’ নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে যান ওরিয়ানা সেখানে ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নিয়ে ওরিয়ানা নিশ্চিত হন যে, শেখ মুজিবুর রহমান তাকে অনেক ভুল তথ্য দিয়েছেন।