তালাল আসাদকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নাই। দুনিয়ার চিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন তিনি। এবং জীবিত চিন্তকদের মধ্যে তিনি আসলে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তিনি আসলে চিন্তকদের চিন্তক। বা সোর্স পারসন বলা যায়। তার কাজের পরিধি ইসলাম ও সেক্যুলারিজম ধারণাকে কেন্দ্র করে বিস্তার লাভ করলেও হাল আমলের বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডে উনার কাজের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘ফরমেশন অব সেক্যুলারিজম’ ও ‘জেনেওলজি অব রিলিজিয়ন’ নামক দুটি বিপুল প্রভাব বিস্তারী গ্রন্থসহ বেশ কিছু আলোচিত গ্রন্থের লেখক তালাল আসাদ।
বাংলাদেশে তালাল আসাদের লেখা-লেখি খুব বেশি অনুবাদ হয়নি। এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি ২০১৭ সালে নিয়েছেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান আজাদ। এটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্টে। অনুবাদ করেছেন, মামুন আবদুল্লাহিল।
হাসান আজাদ : পরিবেশ বিপর্যয় এবং প্রাণ প্রজাতির উপর হুমকি এখন খুব আলোচিত বিষয়। পৃথিবীর ইতিহাসের অনান্য সময়কার তুলনায় পরিবেশের উপর আগ্রাসণ এখন বেশি পরিমানে হচ্ছে। একদল বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখানো হয়েছে দুনিয়া এখন ধবংসের ৬ষ্ঠ ধাপে প্রবেশ করেছে। বলা হচ্ছে মানুষ নিজেরাই এসব বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। ঠিক এই সময়ে এসে ‘‘হিউম্যানিটি নোশান বা ধারণা’’ যা আগে কেবল মানবজাতির একটা বিশেষ অংশ বিশেষ করে কেবল পশ্চিমারা নিজেদের এটার অন্তর্ভুক্ত মনে করতো এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান নির্মাণ করতো। এটা এখন আরও বড় পরিসরে পৃথিবীর অন্যান্য মানবগোষ্ঠীকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে নিজের ‘বয়ান’ তৈরি করছে। এর কারণ কি? এই ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন?
তালাল আসাদ : আমি যদি একটু পেছন থেকে শুরু করি, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করি তাহলে দেখতে পাবো, আধুনিক দুনিয়ায় বাহাদুরি করার মত যত অর্জন আছে বলে মানুষ মনে করে বা লেখা-লেখিতে প্রকাশ করতো এর মধ্যে বড় অর্জনটা হল, ইউরোপীয় সভ্যতা। আমার যতটুক মনে পড়ে ঐ সময়ে প্রত্যেকের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ইউরোপীয় সভ্যতা। এমনকি ‘ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্কট’ নিয়েও দেখা যায় প্রচুর আলাপ আলোচনা চলতো। বিশেষ করে ইউরোপে ফ্যাসিজমের পতনের মধ্য দিয়ে কিভাবে বিশ্ব নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করলো সেসবও ছিল। তো এসব আলোচনায় একবার ইউরোপীয়ান সিভিলাইজেশন, আবার মডার্ন সিভিলাইজেশন অথবা শুধুমাত্র সিভিলাইজেশন শব্দ ব্যবহার করা হতো। দেখতাম এভাবেই শব্দের অদলবদলের খেলা চলতো। মূলত এসব শব্দের অদলবদলের মধ্যে দিয়ে যা প্রমাণ করার চেষ্টা চালানো হতো তা হলো, ইউরোপীয়ানদের শ্রেষ্ঠ মানবজাতি হিসেবে হাজির করা এবং যারা এদের মতো করে সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পারে নাই তাদের মধ্যে পার্থক্যের রেখা টেনে দেয়া। তাদের আলাদা করা। অবশ্যই এসব পুরনো আলাপ। পুরনো গল্প যা অনেক আগে থেকেই বার বার বলা হয়েছে; এমনকি মাঝে মধ্যে সমালোচনাও করা হয়েছে। দেখুন তবুও কিন্তু বাস্তবে ঠিকই এই ধরনের চিন্তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং এর প্রতিফলন ঘটেছে এভাবে— “আমরাই (ইউরোপীয়ানরা) যেমন সব মহান ও বিস্ময়কর চিন্তা ও কাজের আঞ্জাম দিতে পারি তেমনি কেবল আমরাই এর কদর ও গুরুত্ব বুঝতে পারি এবং রক্ষা করি, অন্যরা নয়।”
দীর্ঘদিন আগের কথা। আমার এক বন্ধু ছিল। তো আমরা যখনই একে অপরের মুখোমুখি হতাম এমন কিছু বাস্তবধর্মী বিষয়ে টেকনিক্যালি কথাবার্তা বলতাম সে প্রায় মজা করে বলতো, দেখো দেখো শাদা চামড়ার মানুষেরা কত চতুর হয়! বরাবরের মত তখন থেকে আমিও প্রায় এই বাক্যটা আয়ত্ত্বে নিয়ে ঠিক একইভাবে ব্যবহার করতে থাকি। আরে দেখো সাদা চামড়ার মানুষেরা কত চতুর হয়! আমার পয়েন্টটা হলো এই ধরনের বুলি প্রথম দিকে কেবল মজা কিম্বা ফান করেই বলা হতো । কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর মাঝামাঝিতে এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এটা কেবল আর জোকস কিম্বা মজা ছিল না বরং সিরিয়াসলি দাবি করা হতো। ইউরোপীয়ানদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা সাধারণত তারাই দাবি করতো ও বলে বেড়াতো যারা ভৌগলিকভাবেই ইউরোপীয় সভ্যতার বলয়ের বাসিন্দা ছিল। এবং এই দাবি খুব জোরালোভাবেই হাজির ছিল।
হিউম্যানিটি তথা মানবতার ফেরিওয়ালারা’ কী সর্বনাশটা করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করেই হিউম্যানিটি খতরনাক বিষয়ে পরিণত হলো। কারণ, ইউরো-আমেরিকানরা হিউম্যানিটির স্লোগানকে পুঁজি করেই পশ্চিমের চোখ ঝলাসানো উন্নয়ন ও অর্জনের ঢোল পিটায়।
গত কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক সংকটসমূহ একে একে জমা হয়ে স্তুপের আকার ধারণ করছে। যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, আনবিক যুদ্ধের হুমকি এমনকি নিউক্লিয়ার অ্যানার্জির ঝুঁকি, অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সিস্টেম এবং আরো অন্যান্য যা আছে। এর ফলে এখন আমরা মানুষদের বলতে শুনি দেখো ‘হিউম্যানিটি তথা মানবতার ফেরিওয়ালারা’ কী সর্বনাশটা করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করেই হিউম্যানিটি খতরনাক বিষয়ে পরিণত হলো। কারণ, ইউরো-আমেরিকানরা হিউম্যানিটির স্লোগানকে পুঁজি করেই পশ্চিমের চোখ ঝলাসানো উন্নয়ন ও অর্জনের ঢোল পিটায়। আপনি যদি একদম শুরুর দিকে তাদের লেখাজোখার দিকে নজর দেন এবং বারবার পড়েন তাহলে দেখবেন প্রত্যেকেই (যদিও প্রত্যেক বলা ভুল হবে বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ এবং উপনিবেশিক গভর্নররা) অবিরামভাবে পশ্চিম তথা ইউরোপীয় সভ্যতার বাহাদুরি আর অর্জন নিয়ে কথার মালা সাজাতো। এই ধরনের শব্দ ও পরিভাষা নিয়ে কথা বলতে তারা খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করতো এবং যুক্তিসংগত বলে মনে করতো। এমনকি তৃতীয় বিশ্বের সংস্কারকেরাও একই সুরে কথা বলতো। কারণ তারাও জ্ঞান বলতে শুধু বিজ্ঞান চর্চা ও সামরিক দক্ষতার ধারণাকে বুঝতো। আর নিজেদের এমনভাবে মানিয়ে নিয়েছিল কেবল এসবকেই সব দিক থেকে অগ্রসর পন্থা হিসেবে বিবেচনা করতো । আমার পয়েন্টটা কিন্তু খুব সরল, এতদিন বলা হতো বিশ্বের সব বিস্ময়কর আগ্রগতির অবদান হলো ইউরো-আমেরিকানদের কিন্তু যখনই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কথা আসলো তখনই বলা হচ্ছে এর দায় সব মানুষের। হঠাৎ করেই আমরা শুনলাম দাবি করা হচ্ছে সমগ্র মানুষ এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কৃষক থেকে শুরু করে এমনকি শহুরের গরীব জনগোষ্ঠীকেও একইভাবে দায়ী করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমরা যদি আরো সুনির্দিষ্ট করে ধরি তাহলে ধনী রাষ্ট্র সমুহ মুলত এর জন্য দায়ী।
হ্যাঁ। দাবি করা হয়ে থাকে, বিস্ময়কর চোখ ঝলসানো যত অর্জন আছে কিম্বা দূরদর্শী চিন্তা ভাবনা করতে পারা মানুষগুলো এরা সবাই হলো মানবজাতির বিশেষ একটি অংশ এবং এরা হল পশ্চিমের। সুনির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমা-খ্রিষ্টান। কিন্তু দেখুন, পৃথিবীতে ঘনঘোর যে বিপর্যয় ধেয়ে আসছে এর দায় নিতে কিন্তু মানবাজতির এই বিশেষ অংশ এখন অস্বীকার করে বসেছে। কিভাবে অস্বীকার করেছে? তারা এখন পশ্চিমকে ফোকাস না করে বিপর্যয়ের দায়ভার সমগ্র মানবজাতির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। নয়া বয়ান তৈরি করছে। বলা হচ্ছে মানবজাতির সবাই মিলে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা ও বিপর্যয় ডেকে আনছে। অথচ হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা যে আনবিক বোমা মেরে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল যার মধ্যে দিয়ে নিউক্লিয়ার যুগের সুচনা হয়েছিল যা কিনা এখন পর্যন্ত বিশ্বে ঘটে যাওয়া সব থেকে বড় মানবতার বিরুদ্ধ গর্হিত কাজ। কিন্তু দেখুন এই ঘটনা নিয়ে তেমন কোন সাড়া শব্দ নেই। যতটা ইউরোপে নাজিদের দ্বারা ইহুদি নিধন নিয়ে আলাপ হয়ে থাকে। যদিও নাৎসিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে পরিমান অনেক বেশি। তবুও নাজিদের থেকেও হিরোশিমা নাগাসাকির ঘটনা মানব ইতিহাসে বড়সড় বিপর্যয়ের ধাক্কা ছিল। ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিদের বিনাশ কিম্বা উচ্ছেদের জন্য সায়েন্টিফিক নলেজের তথা আনবিক বোমার দরকার পড়ে নাই বরং জোর জবরদস্তি করে মানবগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশকে (ইহুদি) কেবল আদর্শিক কারণেই নির্মূল করে দেয়া হয়েছে। আর এদিকে ছিমছাম সাধারণ গোছের একটি শহর যেখানে সাধারণ জনগোষ্ঠীর বসবাস সেখানে নিউক্লিয়ার বোমা মেরে শিশুসহ অসংখ্য নারী পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি পশুপাখিসহ অনান্য প্রাণপ্রজাতিও এর থেকে রেহাই পায় নাই। এক তুড়িতে সবকিছু ধবংস করে দেয়া হয়েছে। জেনে অবাক হবেন তখনকার ঐ বোমা এখনকার আনবিক বোমার তুলনায় খুবই পুরনো ধাঁচের ছিল। তাতেই দেখুন একটি শহরকে বিধ্বস্তের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি আজও পোহাতে হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়েই মানব ইতিহাসের এক নতুন ও অনিশ্চিত যুগ সন্ধিক্ষণের উত্থান হয়। এটা মোটেও বাহদুরি করার মত অর্জন বলা যায় না বরং এর ফলে মানুষ প্রযুক্তিগত ও আদর্শিকভাবে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে।
দেখবেন ঘটনাক্রমে এখনো দাবি করা হয় বা বলা হয় যে, এই কাজটা মিলিয়ন মিলিয়ন আমেরিকানদের জীবন রক্ষার্থে করা হয়েছিল। খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন, যে সংখ্যক লোকেরা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে যুক্ত ছিল এবং অনুমোদন দিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য বিবেচনায় নিলেই পরিষ্কার হবে এটা মোটেও মানবিক কোন কারণে করা হয়নি বরং একান্তই রাজনৈতিক নিয়তকে সামনে রেখেই করা হয়েছিল। তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সামনে আমেরিকানদের শক্তি সামর্থ্যের জৌলুস প্রদর্শন করা। আমার পয়েন্ট হলো, এটা খুবই ভালো কথা যে পশ্চিমারা তাদের ইউনিক নৈতিক মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন করেছে। তারা বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রেডিও, ইলেকট্রিসিটি, মর্ডান মেডিসিন উদ্ভাবনের পাশাপাশি ডেমোক্রেটিক গভর্মেন্ট এবং ইউনিভার্সালিজমের ধারণা নিয়ে এসেছে। ফলে এসবের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দায় দায়িত্বও রয়েছে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি যখন হুমকিস্বরূপ ভয়ঙ্কর পরিণতির সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে তখন বলা হচ্ছে এর দায় কেবল ওয়েস্টার্নাস তথা পশ্চিমাদের নয় বরং সমগ্র মানুষের। অর্থাৎ পৃথিবীকে অনিশ্চিত অন্ধারাচ্ছন্ন ভবিষৎতের দিকে ঠেলে দেয়ার মূল এজেন্ট তথা হর্তাকর্তা যারা তাদের নাম সাকিন ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। আরও অধিক গুরুত্বপুর্ণ হলো যা আমাদের চিন্তার রাজ্যে খুব কমই যা ধরা পড়ে তা হলো আধুনিক বিশ্ব কিন্তু গড়ে উঠেছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী কাঠামোর উপর ভর করেই। ফলে এর যতই চোখ ঝলসানো অর্জন থাকুক না কেনো তা এখন ভয়ঙ্কর হুমকির সম্মুখীন। আর হ্যাঁ, আমি যে শুধু জলবায়ুর পরিবর্তন আর আনবিক যুদ্ধের হুমকির কথাই বলতেছি তা নয় বরং বিশ্ব আরো অনেক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে।
অক্টোবরের ৯ ও ১০ তারিখে ‘Global Rally for Humanity’র উদ্যোগে আমেরিকা জুড়ে মসজিদের বাহিরে প্রায় বিশটির মত র্যালির আয়োজন করা হয়েছিল। এসব র্যালি আয়োজনের প্রধান ব্যাক্তি হলেন ইউএসের নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য জন রিটজিমার। যিনি এর আগে মে মাসে পয়েনিক্স মসজিদের সামনে ‘Draw Muhammad Contest’ র্যালির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এদিকে ফ্রান্সে শার্লি হেবদো হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রায় দু মিলিয়ন মানুষের বিশাল র্যালি হয়েছে। সোশিওলজিস্ট ইমানুয়েল টড এই ধরনের র্যালিকে ব্যাখা করেছেন মিডল ক্লাসের প্রচণ্ড ঘৃণার চাষ, কুসংস্কার ও ইসলামফোবিয়ার অসুখ হিসেবে। ব্রিটিশ জোকার ক্যাটি হপকিনস সিরিয়ান অভিবাসীদের তেলাপোকা আখ্যায়িত করে তাদেরকে মেরে ধরে শেষ করে দেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এন্টি-ইসলাম গ্রুপ ‘রিক্লেইম অস্ট্রেলিয়া’ দাবিতে র্যালির আয়োজন করেছে। এসব র্যালি ও এতে সরগরম উপস্থিতি দেখে এটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায় যে, ইসলাম তথা মুসলিমরা মূলত ওয়েস্টের হিউম্যান ক্যাটাগরির অংশ নয়। আপনার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘রিফ্লেকশান অন ভায়োলেন্স, ল’ এন্ড হিউম্যানিটারিয়ানিজম’ আর্টিকেলে হিউম্যানিটি নোশান ও এর জেনিওলজি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আপনি দেখিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ক্রিস্টিয়ানিটির সমার্থক শব্দ হিসেবে হিউম্যানিটিকে সার্বজনীন রূপ দেওয়া হয়। এছাড়া হিউম্যান কনসেপ্টকে পুঁজি করে কিভাবে অপরকে ভিন্ন ভিন্নভাবে আলাদা করার আইডিয়া নির্মাণ হয় তাও তুলে ধরেছেন। ইউরো-আমেরিকানদের হিউম্যানিটি ধারণার সাথে ইসলাম তথা মুসলিমদের পুরোপুরিভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য যে দৌড়ঝাঁপ আজকাল দেখা যায় তা কীভাবে দেখছেন? এই ধরনের প্রত্যাশা করা কিম্বা আদৌ কি তা সম্ভব হবে বলে মনে করেন?
সত্যি বলতে, ইউরোপীয় সভ্যতাকেই সবচেয়ে অগ্রসর, সবচেয়ে চতুর প্রতিভাসম্পন্ন ও উর্বর সভ্যতা বলে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববাসী জেনে আসছে। এর ফলে এমন এক নির্দিষ্ট ধরনের ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হয়েছে যা অন্য সভ্যতার তুলনায় ইউরোপকে উঁচু স্থানে আসীন করে । আরেকটু আগবাড়িয়ে বলা যায়, মানুষ আগে যা করেছে এবং বর্তমানে যা করতেছে তা ব্যাপকভাবে ক্রিস্টিয়ানিটির কাছে ঋনী। আসলে আমাদের বানানো এসব কল্পকথার কোনটাই সত্য নয়। এমনিভাবে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মানুষ হিউম্যানিটিকে সর্ব উৎকৃষ্ট বা সবথেকে অগ্রসর এবং সর্বজনের কাছে নৈতিকতার মানদণ্ডে গ্রহনযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতো। যা পরোক্ষভাবে হায়রার্কিক্যাল সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। একইভাবে এমন কিছু কুযুক্তি থাকতে পারে যেমন, আমরা সবাই যেহেতু এক সুতরাং বৈশ্বিক দুর্দশার জন্য আমরা সমগ্র মানবজাতি দায়ী । প্রকৃতপক্ষে হুমকিতো সবার জন্য। কেউ ভিন্ন বলে ছাড় পাবে তাতো নয়। তাছাড়া শুধু মানবজাতি কেবল সমস্যার মুখোমুখি তাও নয় পশুপাখির জীবনওতো বিলুপ্তির হুমকির মুখে। দেখুন পশুপাখির জীবনও যে বিলুপ্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে এর জন্য কি পশুপাখি দায়ী? তাহলে পুরো মানবজাতিকে আজকে বৈশ্বিক দুর্দশার জন্য দায়ী করা কতটা হাস্যকর যুক্তি হতে পারে বুঝুন এবার।
মুখে। দেখুন পশুপাখির জীবনও যে বিলুপ্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে এর জন্য কি পশুপাখি দায়ী? তাহলে পুরো মানবজাতিকে আজকে বৈশ্বিক দুর্দশার জন্য দায়ী করা কতটা হাস্যকর যুক্তি হতে পারে বুঝুন এবার।
আমি ঠিক নিশ্চিত নই হিউম্যানিটি নোশান কতদুর কিভাবে মুলমানদের পলিটিক্যালি ও মোরালি কাজে লাগতে পারে। আমি এরকম ঠুনকো যুক্তি দিচ্ছি না যে, কোন মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে হিউম্যানিটি নোশান ব্যবহার করার দরকার আদৌ আছে। মানুষের মানবিক কাজ করার জন্য কোন থিওরি, কনসেপ্ট এমনকি হিউম্যানিটির নোশানও আমার কাছে পর্যাপ্ত কিম্বা দরকারি বলে মনে হয় না। বরং একজন মানুষের মানুষ হয়ে উঠার জন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আচার আচরনের সুনির্দিষ্ট গঠন ও পঠনের পাশাপাশি মনুষ্য চেতনার বিভিন্ন দিককে সজীব ও ক্রিয়াশীল করে তোলার উপর তা নির্ভর করে। আমি মনে করি আমরা যারা একাডেমিক জগতে আছি এরা চিন্তার ক্ষেত্রে ভুল্ভাবে তাড়িত হচ্ছি। যেকোন কনসেপ্ট বা ধারণা নিয়ে তা কেবল তত্ত্বের জাঁতাকলে পিষে ব্যাখা করাকে নৈতিক স্বার্থে প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা। এটা একাডেমিয়ার বড়সড় ঝামেলা। আমি ঠিক এভাবে ভাবতে নারাজ। কারণ সব কিছুকে তত্ত্ব দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমাদের সামাজিক জীবনের দীর্ঘস্থায়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির ঘূর্ণিছক যেভাবে বেয়ে চলছে, আমি মনে করি না আমরা খুব সফলতার সাথে এসবের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেছি। এটা আরো সহজেই ধরতে পারবেন ইতিহাস পাঠে। ইতিহাসবিদরা তাদের ইতিহাস পুস্তকে সুনিপুণভাবে দেখিয়েছে কোন কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সুত্রপাত হলো এবং এই যুদ্ধ কিভাবে আরেক নয়া বিশ্বের গঠনে সাহায্য করেছে যেখানে প্রকৃতপক্ষে তা কোন মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
আমি আসলে জানি না মুসলিমদের হিউম্যানিটি বা মানবিকতাবাদের ধারণার সাথে একীভুত হওয়া উচিত কি উচিত নয়! এই প্রশ্নের কোন তড়িৎ জবাব আছে কিনা জানি না। আমি মনে করি এই মূহুর্তে মুসলিমদের বিশাল একটা সংখ্যা খুবই নাজুক অবস্থার সম্মুখীন। আমি কিন্তু দাবি করছি না আমি খারাপ অবস্থায় আছি। চারপাশের দৈনন্দিন হালচাল আমি যা দেখি, শুনি ও পড়ার মারফতে জানতে পারি তা আমার জন্য যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক। তার মানে এটা বলতেছি না সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব মুসলিম অভিবাসী নানারকম বৈষম্য, বিরুদ্ধতা, সম্পদের স্বল্পতা ও সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন পার করতেছে ঠিক আমারও একই অবস্থা। এটা সত্য ইসলামফোবিয়া মানবজাতির সব থেকে অগ্রসর বলে দাবিদার যারা তাদের মধ্যে খুব জোরালোভাবে হাজির । এমনকি এন্টি সেমিটিজমের থেকেও ইসলামফোবিয়া বর্তমান সময়ে আরো অধিক জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে। যদিও আনাচে-কানাছে এন্টি সেমিটিজম দেখা যেতে পারে তবে তা নাৎসিদের সময়কার ইউরোপ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে উত্তর আমেরিকাতে যেভাবে ছিল এখন আর সেভাবে নেই। ইসলামফোবিয়া ঠিক এরকম না যে সিরিয়ান শরণার্থীদের হাঙ্গেরি কিভাবে ট্রিট করেছে কিম্বা ইউরোপের অনান্য দেশে নিও-নাৎসিরা কী করে বেড়াচ্ছে। বরং এটা বুঝার বাকি নাই যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ধরনের ভায়োলেন্স পশ্চিমা বিশ্বে করা হয় এর বেশিরভাগ সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্সের অন্তর্ভুক্ত।
আপনার প্রশ্নে ফিরে আসি। আমার কাছে মনে হয় এক এক দেশের মুসলিমরা এক এক ধরণের পরিবেশ পরিস্থিতির মুখোমুখি। মুসলিমদের মধ্যে আবার শ্রেণি ভাগ আছে। ফলে তাদের সমস্যার ধরনও আলাদা। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি আর যিনি শিক্ষিত নন তুলনামূলক বিচারে উভয়ের অবস্থা এক হবে না। আবার যে ব্যক্তি সম্প্রতি কোন দেশে এসে উপস্থিত হয়েছে যার ভাষা ঐ দেশের মানুষরা খুব কমই বোঝে তার সমস্যার ধরন ও অবস্থাও আলাদা। আমি মনে করি না প্রত্যেক মুসলিম একই ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন। তবুও ইসলামফোবিয়া নিয়ে সাধারণত সুস্পষ্টভাবে কথা বলা হয় কারণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণার চর্চা হয় মূলত- গোটা ইউরোপজুড়ে যেন মুসলিমরা হলো এলিয়েন— এমন কল্পিত মিথ্যা বয়ানের উপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের ঘৃণার সৌধ ।
আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন মিডল ইস্টের উপর একটা কোর্স পড়াতাম। আমি পাঠদান শুরু করতাম ঠিক এই পয়েন্ট ধরে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে বিশেষ করে মধ্যযুগে ইউরোপে সমগ্র জনগোষ্ঠীর উপর ক্রিস্টানিটি প্রভাবশালী হয়ে উঠার আগে সেখানে জাতপাত ধর্ম নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের একধরণের সহাবস্থান ছিল। সুতরাং যে কাউকে প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞেস করা দরকার, সেই বহুমুখী অবস্থান এখন কোথায়? আধুনিক রাষ্ট্রের উত্থানের সাথে সাথে এটা ধবংস করে দেয়া হয়েছে। আপনি মধ্যপ্রাচ্যে এখনো অনেক ধর্ম, জাতি ও প্রথার সরব উপস্থিতি দেখতে পাবেন। কিন্তু ইউরোপে এই অবস্থা দিন দিন তলানির দিকে যাচ্ছে। যেই কারণে আমি আইএসআইকে খেলাফতের ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ইসলামের ইতিহাসের সাথে এর উত্থানকে সংযোগ না করে আধুনিক মুভমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করি। কারণ, আধুনিক রাষ্ট্র’র ভেতরকার বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বড়সড় পার্থক্য ও দূরত্ব রয়েছে তা ঘুচাতে পারে কিনা কিম্বা পারলেও তা কি পরিমাণে পারে এটার খোলামেলা জিজ্ঞাসা আকারে থেকেই যায়।
এটা সত্য ইসলামফোবিয়া মানবজাতির সব থেকে অগ্রসর বলে দাবিদার যারা তাদের মধ্যে খুব জোরালোভাবে হাজির । এমনকি এন্টি সেমিটিজমের থেকেও ইসলামফোবিয়া বর্তমান সময়ে আরো অধিক জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে।
অন্যভাবে, দেখলে এটা এমন কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে হাজির হয় যার ফলে আমাকে প্রায় বিরক্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যে কেউ এটা মেনে নিবে যে, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট খুবই বীভৎস ও বাজে কাজ করে বেড়াচ্ছে । ঠিক একইভাবে সৌদি সরকার ইয়েমেনে এবং মিশরের সরকার নিজ দেশে ভয়ানক তাণ্ডব চালাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া আমাদেরকে বলে বেড়ায় যে আমেরিকা ও ইউরোপে যেসব খারাপ কাজ হয় এর থেকে বরং আইসিস ও মুসলিম দেশে যা চলে তা অত্যন্ত ভয়ানক। আমি জানি না ওকলাহোমাতে রিচার্ড গ্লোসিপ নামে গরীব লোকটার কেইস আপনি ফলো করেন কিনা, জানি না। একজন লোক যে কিনা প্রকৃত খুনি এবং মৃত্যুর জন্য দায়ী সে দাবি করেছিল তাকে উক্ত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর প্রতিশ্রুতিস্বরুপ গ্লোসিপ টাকা দিয়েছে। এইরকম দাবি করার মধ্যে দিয়ে সে নিজের মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রত্যাহার করে নিতে চেয়েছে। আর এদিকে গ্লোসিপ বেচারা মৃত্যুর প্রহর গুনতেছে দীর্ঘ বিশ বছর ধরে যখন থেকে তাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমি উক্ত ঘটনাকে এখানে উদ্ধৃত করলাম এই পয়েন্টটা বুঝানোর জন্য যে, সৌদি আরবে জনসম্মুখে শিরচ্ছেদ করা আর গ্লোসিপের মৃত্যুদণ্ডের সাজা নির্মমতার দিক থেকে একই রকম। আমি মনে করি না, কাউকে বছরের পর বছর ধরে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিদারুণ যন্ত্রণা ও একের পর এক প্রানঘাতী ড্রাগস পুশ করে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার থেকে একবারে কল্লা কেটে মেরে ফেলাটা বেশি নির্মম হতে পারে। খেয়াল করুন, সব থেকে ভয়ঙ্কর নির্মমতার খুঁটি পোতা হচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্র দ্বারাই। যখন কাউকে সচেতনভাবে শাস্তির নামে বিভিন্ন অমানুষিক ধকল প্রয়োগ করে তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে মেরে ফেলার আয়োজন করা হয় আর রাষ্ট্র তখন বলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড আইনগতভাবে করা হয়েছে।
মুসলিম বিশ্বে যে সকল ভয়াবহ খারাপ কাজ সংঘটিত হচ্ছে এর জন্য নিন্দা জানানো মানে এই না যে ওয়েস্ট তথা পশ্চিমা বিশ্বে একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যা ঘটতেছে তা খুব ন্যায়সঙ্গত। বরং আমার কাছে মনে হয় ওয়েস্টের অবস্থাও খারাপ এমনকি মাঝে মাঝে মুসলিম বিশ্ব থেকেও বেশি খারাপ। সৌদিরা খুনিদেরকে পাবলিক প্লেসে হত্যা করে শাস্তি দেয়ার রেওয়াজে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ জনসম্মুখে প্রাণদণ্ড দেয়াকে তারা নির্মম কিম্বা অমানবিক বলে মনে করে না। অন্যদিকে ওয়েস্ট তথা পশ্চিমা বিশ্বের লিবারেলরা বলে তারা খুবই মানবিক এমনকি অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও তারাও মানবিক আচরণ করে থাকে। অথচ একসময় এরকম শাস্তির ধারণাটাই সেখানে চালু করা হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে আলোচনাকে পিচ্ছিল পথে নিয়ে আপনাকে দোলাচলে ফেলে দিচ্ছি। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে প্রচলিত রেওয়াজ হলো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে যারা তাদের আত্মীয়দেরকে খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য দেখার সুযোগ দেয়া হয় যাতে তারা তা দেখে প্রতিহিংসা নেয়ার সুখ পেতে পারে। যারা নিজেদেরকে লিবারেল বা উদার বলে দাবি করে এরা আসলে জানেনা তারা কি বিশ্বাস করে কিম্বা কী পরিমানে করে, এমনকি তারা ঠাহরই করতে পারে না তারা যা বিশ্বাস করে, এর সাথে তারা যা করে এবং তাদের নামে যা করা হয় অধিকাংশ সময়ে এর কোন মিল নেই। আইএসআই’র কর্তা ব্যক্তিরা বিশ্বাস করে তারা যা করে তা বীভৎস বলে আখ্যা দেয়া হলেও মূলত করে থাকে অবিশ্বাসীদের (যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে তারাও এর অন্তর্ভুক্ত) একবারে নির্মূল করে দেয়ার জন্য। কিন্তু পশ্চিমাদেরকেও দেখবেন এসব বীভৎস কাজ করে থাকে। এ দু’য়ের মাঝ থেকে আসলে ভালো কিছু বেছে নেয়ার সুযোগ নাই। তবে এটা খুব ভালো প্রশ্ন হতে পারে, যারা মানুষজন সম্পর্কে সিজেফ্রোনিক টাইপের কোন ধারণা পোষণ করে না এবং যারা একদিকে মানবজাতির প্রতি তাদের বিশেষ সন্মান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে, ঠিক তারাই কিভাবে আবার অপরদিকে মানবতাবাদের কথা বলে অধিকাংশ মানবতা বিরুদ্ধ বীভৎস কাজ ও হত্যাকাণ্ড করে থাকে? আসলে অন্যরা এসব ভাববার ফুরসতই পায় না। ব্যপারটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে এসব মানুষকে হত্যা করার হয়তো এমন বিশেষ কিছু কারণ আছে যার জন্য এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে আমরাও জায়েজ হিসেবে বিবেচনা করে চুপ থাকি।
আপনার প্রশ্ন ছিল মুসলিমদের এখন কীভাবে কাজ করা দরকার বা ভালো। এর আসলে সোজা সাপ্টা কোন জবাব নাই। তাছাড়া সকল মুসলিমের জন্য মানানসই এমন কোন একক ফর্মুলাও নাই। মুসলিমদের মধ্যে যেহেতু নানান ঘরাণা আছে। ফলে দেশ কাল পাত্র ভেদে তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল রপ্ত করতে হবে। পরিস্থিতিনুযায়ী এর প্রয়োগ করা জানতে হবে। এছাড়া বাকি জনগোষ্ঠী থেকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কুয়োতে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলা কোনভাবেই ঠিক হবে না। আমি মনে করি যেখানেই সুযোগ থাকে সেখানে অন্য মানুষকে সাথে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অন্য কথায় বললে, মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে যার উপরই অন্যায় হয়ে থাকুক না কেনো দেখা মাত্রই এর প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করতে হবে। নন মুসলিম বিশেষ করে আফ্রিকান আমেরিকানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার এদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অপরের সাথে মিলেমিশে কাজ করার চেতনা থাকতে হবে। গরীব, বেকার, শ্রমজীবী ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর দুঃখ দুর্দশায় এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাতে হবে। মুসলিম হিসেবে পরস্পরের সাথে বোঝাপড়া ও ঐক্যমতের জায়গা তৈরি ও সংহতি জানানোর চর্চা করতে হবে।
অন্যভাবে বললে, মুসলিমরা চারপাশ ঘিরে ক্যাম্প বানিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার বাহানা দিয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকাটা কোন সমাধান নয়। এই কৌশল হলো যায়নিস্টদের। আপনার নিজের ছোট্ট একটা দেশ আছে। যেখানে নিরাপত্তার কাছে নৈতিকতার কোন দাম নাই। যেহেতু সারা বিশ্ব আপনাদের বিরুদ্ধে তাই সবকিছু ভুলে নীতি নৈতিকতা বিরদ্ধ কাজ করার ফল পাওয়া যায় হয়তো। এই সুযোগ কেবল তখনই পাওয়া যায় যখন বিশ্বের শক্তিধর মাতব্বর রাষ্ট্র এসে আপনার পাশে দাঁড়ায়, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ করার ইন্ধন দেয় এবং নিরাপত্তা দেয়ার দায়ভার নেয়। যায়নিস্টরা এক উদ্ভট গোছের স্বপ্ন লালন করে। তারা মনে করে ইহুদিরা কেবল তাদের লেজার ক্যাম্পেই নিরাপদ থাকবে। অবশ্যই মনোজগতে ফ্যাসিস্ট চিন্তা ভাবনা লালন করে শক্তিধরদের সহযোগিতার উপর ভর করে এবং একপাশে অন্য জনগোষ্ঠীদের অধিনস্ত করে রেখে নিরাপদ থাকা যায় বটে। তবে কেউ যদি অপরের সাথে বসবাস করতে গিয়ে সমস্যা অনুভব করেন। যা আসলেই সমাধান করা প্রয়োজন কিন্তু অপরকে কোন রকম পাত্তা না দিয়ে দূরে রেখে সমাধানের গন্তব্যে যে পৌঁছানো যায় না তা যে কেউ স্বীকার করবে। আর এটাও মনে রাখতে হবে আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে এই ধরনের ঝুট ঝামেলা ও সংকট মেটানো সম্ভব নয়।
ওয়ায়েল হাল্লাক যখন বলেন তিনি আধুনিক রাষ্ট্রকে থিওরিটিক্যালি সন্দেহের চোখে দেখেন আসলে ঠিকই বলেন। যদিও আমি নিজেও শিওর না যে মুসলিম নাগরিকরা শরীয়াহ’র মানদণ্ডে আধুনিক রাষ্ট্রকে নিয়ে কোন যুতসই পর্যালোচনা আসলে হাজির করতে পারে কিনা। ওয়ায়েল হাল্লাক তার ‘ইম্পসিবল স্টেট’ বইয়ে বলেন, “আমরা মনে করিনা আমরা এই ধরনের পর্যালোচনা হাজির করতে পারবো আবার আমরা এটাও মনে করি না আধুনিক রাষ্ট্র আমাদের সমালোচনা ও পর্যালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে কোন ধরনের রেসপন্ড করবে।” আমি মনে করি আধুনিক রাষ্ট্র এর দানবীয় রুপ নিয়ে ক্যাপিটালিস্ট এলিট ও গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমির সাথে খাপে খাপ মিলে জট লেগে আছে। যাইহোক নানানরকম অসঙ্গতি থাকলেও আধুনিক রাষ্ট্র এখনও এর অস্তিত্ত্ব নিয়ে টিকে আছে এমনকি বলা যায় সুদূর ভবিষৎতেও উধাও হয়ে যাচ্ছে না। তত্ত্বের জগতে আমরা যা খুশি তাই ভাবতে পারি। আমাদের কল্পিত রাষ্ট্র নিয়ে বিস্ময়কর চিত্র বুনতে পারি। কিন্তু বাস্তব জগতের চিত্র পুরোই ভিন্ন জিনিস।
গুরুত্বপুর্ণ হলো কেবল নিজ সম্প্রদায়কে সবকিছুর উর্ধ্বে শ্রেষ্ঠ ও মহান বানিয়ে উপস্থাপন করা কিংবা নিজেরাই একমাত্র শোষণ বঞ্চনার শিকার এই ধরনের চিন্তা করা থেকে বের হয়ে আসা।
শত্রুতা ও ঘৃণা জারি রেখে যারা লাভবান হয় কেবল তাদের পক্ষেই জনসাধারণকে তথা নিজ সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে রাখা সম্ভব। এটা আমার কাছে খুবই পরিষ্কার যে মুসলিমদের নন-মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন হয়ে থাকা খারাপ লক্ষণ। এই ধরনের পৃথকিকীকরণ ও বিচ্ছিন্নতার ধরণ একেক জায়গায় একেক রকম। ফলে এর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কোন একক ফর্মুলা কাজে আসে না। এইটা ঠিক যে, কোন সম্প্রদায়কে এর নিজের জন্য নিজেরদেরকেই চিন্তা ভাবনা করতে হয়। তবে গুরুত্বপুর্ণ হলো কেবল নিজ সম্প্রদায়কে সবকিছুর উর্ধ্বে শ্রেষ্ঠ ও মহান বানিয়ে উপস্থাপন করা কিংবা নিজেরাই একমাত্র শোষণ বঞ্চনার শিকার এই ধরনের চিন্তা করা থেকে বের হয়ে আসা।
তার মানে আমি এটা বলছিনা যে একবারে নিজেদের পরিচয় বিকিয়ে দিয়ে অপরের মধ্যে মিশে যাওয়াটাও ভালো কোন সমাধান নিয়ে আসবে। ঠিক এই একই কারণে আমি ইমানুয়েল টডের ‘চার্লি হেবদো’ নিয়ে লেখা দারুণ বইটার আর্গুমেন্ট দেখে খুশি হতে পারি নাই। টড মনে করেন মুসলিম অভিবাসীদের ফ্রেঞ্চ কিম্বা ফরাসি পরিচয়ে পরিচিত হওয়াটাই সমাধানের একটা মাধ্যম।
আমি ঠিক বিষয়টা এভাবে দেখি না। যে কোন পরিস্থিতিতে, এই ধরনের পরিচয় নির্মাণ করতে হলে একধরনের আলাপ আলোচনা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর আলাপ-আলোচনার এই প্রক্রিয়াটাও অত সহজ নয়, কারণ এক পক্ষের হাতে যেহেতু সকল ক্ষমতা ফলে তাদের একক সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত বলে গণ্য হয়। আপোষ করার কোন দরকার পড়েনা। যার কারণে মুসলিম পরিচয় পাল্টিয়ে ফরাসি, জার্মানি, আমেরিকান ইত্যাদি পরিচয় দাঁড় করানো কখনো সহজ হবে না। আর পরিচয় বদলানোটা বরং আরো বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপীয়ান বর্ণবাদী সমাজের দিকে যদি ফিরে তাকান তাহলে দেখবেন তখন ইহুদিদের ইউরোপীয়ান পরিচয় কোন কাজে আসে নাই। বরং ইহুদি হিসেবে ট্রিট করে মেরে কেটে ইউরোপ থেকে তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। এখন যা দরকার তাহলো ‘হোস্ট সোসাইটি’তে বড়সড় সংস্কার নিয়ে আসা। যদি তা করা না হয় তাহলে আপনার যে প্রশ্ন ছিল— মুসলিমদের হিউম্যানিটি নোশানের সাথে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার যে তোড়জোড় তা কি উপায়ে কতটা ফলপ্রসু হবে— এর সদুত্তর দেয়া যাবে না। আরেকটা হতাশার বিষয় হলো আমার যতদূর স্মরণে আছে এটা ইংল্যান্ডেও হচ্ছে, তাহলো এশিয়া ও মিডলইস্ট থেকে যেসব মুসলিম অভিবাসী আমেরিকাতে আসছে কিংবা যাদের অরিজিন রুটস হলো ইমিগ্র্যান্ট এরাও অন্যদের সংখ্যালঘু বহির্ভূত হিসেবে বিবেচনা করে। যেমন ইউএসেতে আফ্রিকান আমেরিকান। আমি মনে করি এটা খুবই বাজে কাজ। কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে মুসলিমদের মধ্যেও রেসিজমের চর্চা জারি আছে। অথচ রেসিস্ট চিন্তা ভাবনা যা তারা লালন করে এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন হুশজ্ঞান নাই। যখন কোন মেয়ে একজন আফ্রিকান আমেরিকান কিংবা কোন কালো বর্ণের পুরুষকে বিয়ে করতে চায় যে লোক ইসলাম ধর্মের সকল দিক বিবেচনায় যথেষ্ঠ ধার্মিক হিসেবে বিবেচিত কিন্তু শুধুমাত্র কালো হওয়ার কারণে বিয়ের সম্বন্ধটা আর হয় না। এটা সত্যিই বিরক্তির এবং ঘৃণ্য কাজ।
আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি মনে করি এমন কিছু টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার যাতে করে এই ধরনের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করা যায়। আরকটু বাড়িয়ে বললে, ধরুণ আমাদের এক ধরনের রাষ্ট্র আছে যেখানে আমরা বসবাস করি । এই রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা সবাই। (যদিও আমাদের সময়ে রিফিউজিরা হচ্ছে ট্রাজিক এক্সেপশান যাদেরকে হানা অরেন্ড হয়তো বলতো ‘ভালনারেবল নন সিটিজেন’।) সুতরাং রাষ্ট্রের মারফতে পাওয়া ভাষা ও ইনস্টিটিউশান যে সকল সম্ভবনা হাজির করে তা নিয়ে রেসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আমদের বসবাসরত রাষ্ট্রসমূহের একে অপরের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যামান তা কাজে লাগাতে হবে। সিটিজেনশিপ ধারণাকে এক কমিউনিটির প্রতি আরেক কমিউনিটির দায়িত্বশীল আচরণ হিসেবে বুঝা দরকার কিংবা এমন এক বিশাল কমিউনিটির সদস্য হিসেবে বুঝতে হবে যাতে সব কমিউনিটির সামষ্টিক মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার তাগাদা অনুভব করা যায়। শুধুমাত্র জাতি রাষ্ট্রের ভেতরকার কমিউনিটির প্রতি নয় বরং জাতি রাষ্ট্রের সীমানা ডিঙ্গিয়ে অনান্য রাষ্ট্রের কমিউনিটির প্রতিও দায়িত্ববান হওয়া হিসেবে বুঝতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ বোঝাপোড়া। যদিও আমরা এখনো জাতিরাষ্ট্রের কুয়োয় আবদ্ধ হয়ে আছি এবং এর থেকে বের হতেও পারতেছিনা কিন্তু আমাদের হাতে অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ার এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের দেয়াল টপকানো সম্ভব।
ইসলামের উম্মার ধারণা সুস্পষ্টভাবে ন্যাশান কিম্বা জাতির ধারণা থেকে বের হয়ে বৃহৎ কিছুর ধারণা হিসেবে এখনো দাঁড়ায় নাই। বরং আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে সব মুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত করছে মাত্র। এতটুকুনই। এছাড়া এটা এক ধরনের আহ্বান যা নৈতিকভাবে নয়া চিন্তার জন্য তাড়া দেয়।
আমি যা বুঝছি ইসলামের উম্মার ধারণা সুস্পষ্টভাবে ন্যাশান কিম্বা জাতির ধারণা থেকে বের হয়ে বৃহৎ কিছুর ধারণা হিসেবে এখনো দাঁড়ায় নাই। বরং আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে সব মুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত করছে মাত্র। এতটুকুনই। এছাড়া এটা এক ধরনের আহ্বান যা নৈতিকভাবে নয়া চিন্তার জন্য তাড়া দেয়। কোরানে যদিও বিভিন্ন অর্থে ‘উম্মাহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তবে এর কোন অর্থ টেরিটরি কিম্বা পলিটিক্যাল ধারণাকে সংযুক্ত করে না। এই কারণে এটা নিয়ে আরো বিশদভাবে চিন্তা ভাবনা করা দরকার। আধুনিক প্রযুক্তি যত বিপদ সংকুল পরিস্থিতি নিয়ে আসুক না কেন আমাদের পরস্পরের সাথে বোঝাপড়ায় যুক্ত হওয়ার এমন একটা তরিকা বের করা সম্ভব যেখানে ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় দিকই থাকবে । যেটা পূর্বে এত সহজ ছিল না।
অন্যভাবে বললে মুসলিমদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের পাশাপাশি অমুসলিমদের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জায়গা তৈরি করা। একটা উপায়ে এটা করা যেতে পারে তাহলো ইসলামের “আম’র বিল মারুফের’’ ধারণাকে রাষ্ট্রের স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো। এতে করে অথরিটির সাথে অনান্যদের সমানভাবে সম্পর্কিত করে আম’র বিল মারুফ একই সাথে খারাপ কাজের সমালোচনা ও ভালো কাজের উপদেশ দিতে সক্ষম হবে। যদিও আম’র বিল মা’রুফ প্রাথমিকভাবে মুসলিমদের জন্য পরিচালিত তবে অমুসলিমদেরও এর মধ্যে যুক্ত করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা রাষ্ট্রের কোন ইন্সট্রুমেন্ট হবে না বরং এর উপর ভিত্তি করেই শাসন কাঠামো তৈরি করতে হবে।
জাতিসংঘে সৌদির অ্যাম্বাসেডর ফয়সাল বিন খালিদকে সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের কাজ তদারকির জন্য প্যানেল সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে । অথচ একই সময়ে মানবাধিকার ইস্যুতে ইসলাম ও মুসলমানদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু যে রাষ্ট্র নিজ দেশে ভিন্ন মতাবলম্বী, সংখ্যালঘু ও নারী স্বাধীনতা হরণ করার ক্ষেত্রে বিশ্বে রেকর্ড করে আসছে তারা কিভাবে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের কাজ তদারকি করবে? মন্তব্যকারীরা এই নিয়োগকে হাস্যকর হিসেবে দাবি করছে। ইউএন ওয়াচের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টের হিল্লেল নিউয়ার বলেছেন, মানবাধিকারেরে নাম ভাঙ্গিয়ে আসলে সস্তা তেলের বিজয় হয়েছে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে এই বছরেই সৌদিতে একশ’র মত মানুষকে শিরচ্ছেদ করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে সৌদি শিরোচ্ছেদ করে কি করে না তা কোন প্রশ্ন নয় বরং সৌদির এই ধরনের কাজ করার অধিকার রয়েছে। অবশ্যই ম্যাক্স ওয়েবার রাষ্ট্র নিয়ে বলছিলেন, একমাত্র রাষ্ট্রেরই সহিংসতা করার একক অধিকার রয়েছে যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বৈধ বানানো হয়। ঠিক এই কারণে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধরে ধরে কল্লা কাটা সৌদির জন্য রাজনৈতিভাবে বৈধ হলেও আইসিসের জন্য তা অবৈধ। পার্থক্য এতটুকুই। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনি আগ্রহী হবেন?
সৌদি আরবকে আমি পছন্দ না করার অনেক বিষয় আছে। বিশেষভাবে বললে তেল বেঁচে ঢাউস ঢাউস সম্পদের পাহাড় বানানো ছাড়া এদের আর কাজ নাই। কিন্তু দেখুন, আমি মনে করি আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিস্থিতি এখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয়। কেউ এখানে ধোয়া তুলসি পাতা নয়। যেসব মানুষজন সৌদি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা আসলে ভন্ডামি করে। আপনি যদি আমেরিকার দুইশো বছরের ভয়ানক কাজ কাম ঘেঁটে দেখেন তাহলে দেখবেন নির্মমতা ও বীভৎসতার দিক দিয়ে তারা সৌদি থেকে কোন অংশে কম যায় নাই। আমি আসলে সৌদিকে ডিফেন্ড করতে চাচ্ছি না। তাছাড়া এখানে মানুষকে তুষ্ট করতে সৌদি নিয়ে বিষফোঁড়া মন্তব্য করতেও আমি আগ্রহী নই।
শুনুন। আমাদের এখানে গণতন্ত্র আছে। গণতন্ত্র হলো এমন ধরনের পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশান যেখানে এর নাগরিকরা সরকার যা করে বেড়ায় এর জন্য দায়ী থাকে। সৌদিরা এই ধরনের রাষ্ট্রে বসবাস করে না। তারা এমনি এক স্বৈরতন্ত্রের অধিনে বসবাস করে যেখানে রয়্যাল ফ্যামিলি হলো সবকিছুর উপর প্রভাবশালী। যারা ব্যাপকভাবে জনসাধারণের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ সৌদিদের কোন ভূমিকা নাই এতে। সুতরাং সৌদি রাষ্ট্র যা করে এর জন্য সৌদিরা দায়ী নয়। অথবা মুষ্টিমেয় সৌদি যা করে বেড়ায় এর দায় সব সৌদির নয়। আমরা এখনো এমন গল্প শুনি যেখানে বলা হয় টুইন টাওয়ার হামলার সাথে যেসব সৌদি অ্যাক্টিভিস্ট জড়িত সব সৌদি নাকি ঠিক এদের মতই। কিন্তু আমরা কি কখনো এমন দাবি করতে শুনেছি যে, সব আমেরিকানরাই স্কুলে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড করে বেড়ানোদের মত প্যাথলজিক্যাল শুটার? সৌদি আরবে এমন অসংখ্য সাধারণ মানুষ আছে যারা নাইন এলেভেনের ঘটনাকে সমর্থন করেনা। তাছাড়া কোন ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার মত সামর্থ্য তাদের অধিকাংশের নেই।
আমেরিকা ও ইউরোপের সমর্থন নিয়ে সৌদি সরকার ইয়েমেনে যে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে আসছে এ নিয়ে আমি আতঙ্কিত। এ ধরনের নির্মমতা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। ক্ষমার অযোগ্য। যদিও ইতিহাসে নির্মমতা নতুন নয়, কিন্তু আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক ধবংসস্তুপের যে সমারোহ চলছে তা এতই ভয়ানক যা বর্ণনা করার মত নয়। ল্যান্ডমাইন, ক্লাস্টার বোম্বস ও নিউক্লিয়ার ওয়েপনস জাস্ট এসবের বীভৎসতা নিয়ে একটু ভাবুন। যারা নিজেদের লিবারেল বলে দাবি করে এরা ল্যান্ডমাইন কিম্বা ক্লাস্টার বোম্বসকে নিষিদ্ধ করবেনা এমনকি নিউক্লিয়ার ওয়েপনসকেও বিলোপ করবে না। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা দেশের সরকারেরা মানুষ মারার এসব সরঞ্জাম উৎপাদনে পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে এসব বিক্রি করে । আপনি যদি গভীর মনযোগ সহকারে একাকি এসব পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখবেন আমরা এক ভয়ঙ্কর বিশ্বে বসবাস করছি। এতকিছু সত্ত্বেও বিশ্বে এখনো এমন কিছু মুক্তির লড়াইয়ের চিত্র হাজির আছে যেখানে স্বচ্ছ চিন্তার মানুষেরা শুধুমাত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আরাম আয়েশ উৎসর্গ করে ঝুঁকির জীবন বেছে নিয়েছে।
সুতরাং সৌদি আরব থেকে হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগ যে স্রেফ ভণ্ডামি এর জন্য প্রশ্ন তোলা দরকার। এটা ভণ্ডামি ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে বলুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন ভণ্ডামি কখন না ছিল? ইসরায়েল যে আন্তর্জাতিক আইন আদালতকে কোনরূপ তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম অত্যাচার করতেছে— এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কি ভণ্ডামিপূর্ণ নয়?
শুধুমাত্র মিলোসেভিক’র কেইস ছাড়া এশিয়া হোক কিম্বা আফ্রিকান প্রত্যেক ব্যাক্তিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত করা হয় কিন্তু ইউরপীয়ানদের নয় । এইটা কেনো হবে? বুশ, চেনে, রামসফ্লেড এবং ব্লেয়ার যারা কয়েকশ’ হাজার নিরাপরাধ মানুষ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী যাদের কারণে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে রিফিউজি হতে হয়েছে এবং যাদের হাতে কতগুলো দেশ ধবংস্তুপে পরিণত হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কেন তাদেরকে শাস্তির অধিনে আনা হবে না? ওবামার কথা কেন ভুলে যাওয়া হয় যে কিনা স্পেশাল অপারেশান ইউনিট দিয়ে ড্রোন মেরে ও গুম করে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিল এবং গুয়ান্তানামো কারাগারে নিরীহ নিরাপরাধ মানুষদের আঁটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল।
এতকিছু সত্ত্বেও রাজনীতিবিদ বলেই কি এদের কাউকেই অভিযুক্ত করা হয় নাই। যুক্তরাষ্ট্র চিলির এলিন্দা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার মোসাদ্দেককে হটিয়ে স্বৈরাচার শাহ’কে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছিল অথচ এসবের জন্য কখনো বিচার করা হবে না। এসব মোটেও ব্লেম গেইম নয়। যুক্তরাষ্ট্র খুবই নিষ্পাপ তারাই একমাত্র মানবিধকারের রক্ষক এমন ভান ভনিতার গল্প বলা এখন থেকে থামানো দরকার। বিশ্বের নেতৃত্বের কথা বলে যারা নিজেদেরকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করে তাদের এসব অথর্ব দাবির বিরোধিতা করা মানে ব্লাসফেমির দায়ে দোষী এমন হাস্যকর আলাপ দেয়াও বন্ধ করতে হবে।
অনুবাদক: শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, ঢাবি।