প্রথমেই গুস্তাকির জন্য মাফ চাইছি খেলার পাতায় এহেন একটি লেখার জন্য। ক্রাইস্টচার্চে যা ঘটে গেলো তাতে নিজেকে স্থির রাখা বড্ড কঠিন হয়ে গিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের এ বিষয়টা নিয়ে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বিস্তর এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ঐটি আমার জায়গা না হওয়ায় আমি সে পথে যাবো না, আমার মনে জনম নিয়েছে ভিন্ন এক সাওয়াল; কোন কায়ানাত নিজের অজান্তেই সৃষ্টি করছি আমরা?
আমি খেলার জগতের মানুষ হবার ফলে ফেসবুক ভিত্তিক নানা নামের খেলা সম্পর্কিত গ্রুপগুলোতে যুক্ত রয়েছি। প্রতিনিয়ত সেখানকার পোষ্ট, কমেন্টগুলোও আমার দৃষ্টিগোচর হয়। খেলার মতো একটি নির্দোষ বিনোদনের মাধ্যম, যাকে আমরা শান্তির বার্তাবাহক জেনে বড় হয়েছি সে খেলাকে কেন্দ্র করে যেরুপ ঘৃণা ছড়ানো হয় তা বিস্ময়কর। ক্রাইস্টচার্চ ঘটনায় যেটির জিকর করেছেন কেভিন পিটারসেন। এ কোন জঘন্য কায়ানাতের জনম দিচ্ছি আমরা?
শুধু গ্রুপগুলোই বলছি কেন, ব্যক্তিগত ওয়ালে দেশ, দল, খেলোয়াড়দের যে সকল শব্দের সাহায্যে আক্রমন করা হয় তা কল্পনাতীত। রেন্ডিয়া, পাক বীর্য এতই অহরহ ব্যবহৃত হয় যে, পরের প্রজন্ম যদি দু’টো দেশকে এ নামে জেনে বড় হয় বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। ভারত, পাকিস্তানের ম্যাচ থাকলেই হলো, ঘৃণার বিষবাষ্পে দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে উঠে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাও পাখি’ আমার ভীষন প্রিয় একটা উপন্যাস। যে উপন্যাসটা আমার চিন্তার জগতে বেশ বড় ধাক্কা দিয়েছিলো। সে উপন্যাসের অন্যতম মূখ্য চরিত্র ব্রজ ঠাকুরের একটি কথা ছিলো, মানুষ আপন টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর। কোথায় হারাচ্ছে মানুষগুলো? মানুষের মধ্যে তো এ ঘৃণা থাকার কথা না। এত বিদ্বেষ, এত ক্রোধ তো মানুষের থাকতে পারে না। এ প্রজন্মটি বড়ই হচ্ছে একে অপরকে ঘৃণা করতে শিখে।
দেখুন, খেলার জগতটা সম্পুর্ণ আলাদা এক জগত। দুই চির বৈরী দেশের দু’জনও এখানে সহাস্যে ঠাট্টায় মেতে উঠতে পারে। ময়দানি যুদ্ধ আলাদা বিষয়। কিন্তু ঘৃণা যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে এক সময় তো বোলিং করে আউট করার বদলে বল ছুড়ে মেরে কতলের প্রচেষ্টা চলবে। ক্রাইস্টচার্চে যে হামলাটা হলো তার লক্ষ্য ক্রিকেটাররা ছিল না। কিন্তু ঘটনার ফেলে তারা হয়ে যেতে পারতেন এর নির্মম শিকার। যে তামিমের সমালোচনা করে একটি লেখা শেষ করে ডেস্কে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন এমন একটি খবর কতটা ধাক্কা দিয়েছে তা বোঝানো আসলে সম্ভব না। খোদার দরবারে শুকরিয়া যারা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন তাদের জন্য, এবং যারা এ নির্মমতার বলি হয়ে শহিদ হয়েছেন তাদের জন্য আসলে কি শব্দ ব্যবহার করা উচিত জানা নেই।
খবরে যা প্রকাশ হয়েছে তাতে নরপশু সে আদমিকে বলা হয়েছে উগ্রপন্থী। ফেসবুক, টুইটারের কল্যাণে আমরাও কি ধীরে ধীরে উগ্রপন্থী হয়ে যাচ্ছি না? যেমনটি শুরুর দিকে বলছিলাম, রেন্ডিয়া বা পাক বীর্য ধাঁচের শব্দের ব্যবহার কি চূড়ান্ত উগ্রতার নিদর্শন না? আমি নিজেও জ্ঞাত এ দু’দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক সম্পর্কে। এ প্রজন্ম ইতিহাসের অর্ধেকটুকু জেনে ঘৃণা চর্চায় আশ্চর্য এক পুলক লাভ করছে। অথচ, আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পিছনে ভারত এবং পাকিস্তানের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
যারা বিষয়গুলো সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখেন তাদের নিশ্চুপ ভূমিকা মূর্খের দলকে এ প্রপাগান্ডা চালাতে আরো উৎসাহিত করছে। এমন যদি চলতে থাকে তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে না, যেদিন সরাসরি হামলা হবে ক্রিকেটারদের উপর, বা অন্য যে কোনো খেলার খেলোয়াড়দের উপর। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মই যে আমাদের ঘৃণার শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলছে।
কিছু ক্ষেত্রে না চাইতেও কিছু কথা চলে আসে, বলতে হয়। নিউজিল্যান্ডকে শান্তির দেশ বলেই আমরা জানি, জেনে এসেছি এতোদিন। সেখানে এতটা সময় ধরে এতো বড় একটি ম্যাসাকার চললো অথচ পুলিশের দেখা মিললো না। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় দল সেখানে সিরিজ খেলার জন্য অবস্থান করছিলো। কতটা ঠুনকো নিরাপত্তা আমাদের দেয়া হয়! খোদার কৃপায় খেলোয়াড়রা জানে বেঁচে তো ফিরেছে তবে এ ট্রমা থেকে তাদের মুক্তি মিলতে কতদিন লাগবে, বা অদৌ মিলবে কি না, তার জওয়াব আছে?
এটি আমাদের এখানে হলে কি হতো? হলি আর্টিজানে হামলার পর কি হয়েছে আমরা দেখেছি। মিডিয়ার কাছে আমার সাওয়াল আছে। মুসলিম বৈ অন্য ধর্মের হলে উগ্রপন্থী বা মানসিক ভারসম্যহীন আর মুসলিম হলেই জঙ্গি ব্যবহার করা হয় কেন? হলি আর্টিজান এ যারা হামলা করেছিলো তারা মানসিকভাবে সুস্থ ছিল বা উগ্র না হয়ে ভদ্র ছিল এ তথ্যটা নিশ্চিত করেছে কে? সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসীরও বিভাজন করছি আমরা সজ্ঞানে।
এ বিভাজনটাও আমরা চাই না। এ হামলার দায় যেমন পুরো নিউজিল্যান্ডের না, তেমনি আর্টিজান হামলার দায়ও আমাদের পুরো জাতি ছিল না। পুরো ক্রিকেট বিশ্ব যেমন এ ইস্যুতে কিউইদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ঐ সময় আমরাও তেমনটাই আশা করেছিলাম। দুর্ভাগ্য সেটা হয় নি, হয় না। আর কর্তা ব্যক্তিদের এমন অদূরদর্শী আচরণে ঘৃণার পারদ বাড়তেই থাকে, যার জঘন্য বিস্ফোরণ যেকোনো সময় ঘটতে পারে।
যে ভারতের খেলোয়াড়দের আমরা ক্রমাগত গালাগাল করি, পাকিস্তানের পক্ষে কথা বললেই রাজাকার খেতাব পেয়ে যাই সে দু দেশের অন্যতম দুই শীর্ষ তারকা কিন্তু সাথে সাথে বাংলাদেশ দলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কোহলি টুইট করেছেন, আফ্রিদি তামিমের সাথে কথা বলেছেন। খেলার মাঠটা অন্তত বৈরিতা মুক্ত থাকুক। আমাদের এই বিভাজন জিইয়ে রেখে যুগের পর যুগ রাজনৈতিক ফায়দা নিচ্ছে রাজনীতিবিদরা। আমি বলছি না সমস্ত অতীত ভুলে তিন দেশ এক হয়ে যাবে। আমি বলছি না আমাদের বিপক্ষের ইংলিশ বা অজিদের নেয়া অন্যায় সিদ্ধান্ত কবুল করে নিতে হবে। সমালোচনা সে সিদ্ধান্তগুলোরই হোক যা হবার মতো।
শুধু ক্রিকেটই না পুরো বিশ্বই হকচকিয়ে গিয়েছে এ ঘটনার আকস্মিকতায়। শোক এবং সমোবেদনা জানানো ক্লাব বা ব্যক্তিরাই যদি জানতো যে, তাদের কেন্দ্র করে কি পরিমাণ ঘৃণা ছড়ানো হয় তারাও বিস্ময়ে বেবোধ হয়ে যেত। যে কোনো মানবিক বিপর্যয়েই ক্রীড়া বিশ্বকে আমরা এগিয়ে আসতে দেখি। এখন সেটা যদি হয়ে উঠে ঘৃণা ছড়ানোর জায়গা তাহলে আমাদের সামনে ঘোর অমানিশা অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের গ্রুপে পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের নিয়ে পোস্ট করা নিষিদ্ধ। ভারতের খেলোয়াড়ের সুনাম করলেই গালির সুনামি নেমে আসে। যারা খেলা ভালোবাসেন তাদের তো এমন হবার কথা না। চেতনার অচেতনকারী ঔষধে এতটাই বেহাল আমরা ঘৃণা বৈ এখন আর কিছুই করতে জানি না। সে ঘৃণা বোধ থেকে জন্ম নিচ্ছে এসকল কুলাঙ্গার যারা বিনা কারণে প্রার্থনারত মানুষকে হত্যা করে পৈশাচিক পুলক লাভ করে।
এ কায়ানাত তো চাই না আমরা। অন্তত এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে হলেও বন্ধ হোক ঘৃণা বিনিময়। কিছু মানুষ জন্মাক। এ সময়টায় মানুষের জারুরাতই যে সবচেয়ে বেশি।