আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে, ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ, লন্ডনে তখন বসন্ত। বসন্তের এমনি অগ্নিঝরা এক বিকেলে বিশ্ব সমাজতন্ত্রের প্রবাদ পুরুষ কার্ল মার্ক্স আর্মচেয়ারে দুলতে দুলতে হারিয়ে যান দূর আকাশে। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম এই দার্শনিককে আমরা চিনে থাকি তার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্ব কিংবা ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ গ্রন্থের মাধ্যমে। কিন্তু এই দার্শনিক ছিলেন এক দুরন্ত প্রেমিক। তার এক কবিতার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে সেই প্রেম-কাতরতা। ছাত্র অবস্থায় তিনি তার প্রেমিকা জেনিকে কয়েকটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন।তারই একটিতে লেখা ছিল :
My heart profoundly fetterd
My soul’s eye clearer grew
What I had vaguely, hoped for yor,
I found at last in you.
এছাড়াও তিনি জেনিকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন, টিয়েরের যুবকেরা যখন তোমার স্নিগ্ধ মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে ভাবে— এই শহরের সেরা বিদূষী ও সুন্দরী হলো জেনি, তখন আমার গর্বই হয়— এই সুন্দরী বিদূষী তরুণী আমার সহযোদ্ধা, আমার প্রণয়ী।
মার্ক্সের স্ত্রী জেনি ভন ওয়েস্টফালেন। জেনি আর মার্ক্স’র শৈশব কেটেছে জার্মানির ট্রিয়ের শহরে। জেনির ছোট ভাই এডগার ছিলেন মার্ক্সের সহপাঠী এবং বন্ধু। এই সুবাদেই তাদের পরিচয়। পরস্পরের বন্ধুত্ব। কৈশোরে মার্ক্স আর জেনি ছিলো খেলার সঙ্গী আর ভালো বন্ধু। ক্রমে তার বাঁধা পড়েন প্রেমের অবিচ্ছেদ্য আর খামখেয়ালি বাঁধনে। বোরন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় সে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, জেনিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখে পাঠাতো তরুণ মার্ক্স।
কেন মার্ক্স দুরন্ত এক প্রেমিক?— সেকথা বলছি। জেনি ছিল মার্ক্সের চেয়ে ৪ বছরের বড়। মার্ক্সের ১৮১৮, জেনি ১৮১৪। জেনি ছিলেন অভিজাত শিক্ষিত পারিবারের মেয়ে। জেনির দাদা সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা ছিলেন এবং পিতা প্রুশিয়ার ডিউকের অন্যতম উপদেষ্টা। জেনির চাচার সাথে মার্ক্সের পিতার সখ্যতা ছিল। এই সূত্রেও এই দুই পরিবারের পরস্পর যাতায়াত ছিল। মার্ক্সের যাতায়াত ঘটে মূলত এডগারের সাথে। ১৯৪২ সালের মার্চে মার্ক্স যখন হেগেলের রাষ্ট্র এবং সংবিধানিক রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে আলোড়ন জাগানো প্রবন্ধ লেখেন জেনি তখন মার্ক্সের নিত্য-সহচর। এর ঠিক এক বছর পরই পরিবারের অমতে মার্ক্স বিয়ে করেন জেনিকে। কোন কারণ জানানো ছাড়াই জেনির সাথে মার্ক্সের প্রণয় হোক এটা মার্ক্সের পরিবার চাননি। তাই তাদের গোপন রাখতে হয়েছিল বিয়ের খবর।
এরপর থেকে শুরু হয় কৈশোরের খেলার সঙ্গী, তারুণ্যের প্রেমিকা আর যৌবনের স্ত্রীকে নিয়ে মার্ক্সের এক ঝঞ্জামুখর জীবন। মার্ক্স পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করেন। নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের জন্য সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করেন। জেনি সহযোগী। প্রুশিয়ার পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দৃষ্টি পড়ে মার্ক্সের উপর। পালাতে হয় ফ্রান্সে। ফ্রান্স থেকে ব্রাসেলস’এ। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগী এঙ্গেলস তার সহযোদ্ধা এবং অকৃত্রিম বন্ধু। জেনিও তার পাশে। পুলিশ মার্ক্স ও জেনিকে গ্রেফতার করে। ফিরে আসে প্রুশিয়ায়, প্রুশিয়া থেকে ফ্রান্সে। ফ্রান্স থেকে লন্ডন।
লন্ডনের শ্রমিক অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ায় উদ্যোগী হয়। মার্ক্স পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে উঠলেও কঠিন কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটে তাদের সাংসারিক জীবন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মার্ক্স তার স্ত্রীকে তরুণী প্রেমিকের মতোই ভালোবেসেছেন। মার্ক্স ও জেনির সাতটি সন্তানের মধ্যে তিনজন বেঁচেছিল। বাকিরা শৈশবেই মারা যায়।
চরম দুঃখকষ্টে থাকা মার্ক্সকে তার সন্তান দাফনের অর্থ পর্যন্ত দিয়েছিল প্রতিবেশী। তারপরও মার্ক্স তার স্ত্রী কন্যাদের ভালোবাসতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যে সময় দিতেন স্ত্রী ও কন্যাদের। সময় পেলে দাবা খেলতেন, বেড়াতে নিয়ে যেতেন কিংবা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন।
১৮৮১ সালের ২রা ডিসেম্বর জেনির মৃত্যু হয়। জেনি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সে সময়েও ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। মার্ক্স প্রতিদিন জেনির ঘরে যেতেন এবং তাকে গল্পে-আড্ডায় মাতিয়ে রাখতেন। যেন দুই তরুণ-তরুণী জীবনের জয়গান গাইছেন। জেনির মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েন মার্ক্স। আক্রান্ত হন ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া রোগে। আর সেই রোগ নিয়ে ‘আর্মচেয়ার’এ বসে পৃথিবীর মানুষকে বিদায় জানান এই দুরন্ত প্রেমিক মার্ক্স।