এলিজা গ্রিসওল্ড, আমেরিকান সাংবাদিক ও কবি। নিয়মিত লেখেন দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায়। রাজনীতি, ধর্ম ও পরিবেশ নিয়ে মূলত কাজ করেন। ভারতের মুসলমানদের উপর নির্যাতনের চিত্র দেখতে তিনি নিজে ভারতে ছুটে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে লিখেছেন দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায়। আলোচিত এই লেখাটি জবান’র জন্য অনুবাদ করেছেন, মাশকুর রাতুল।
সালটা ২০১৭, পহেলা এপ্রিল। বিশ বছর বয়সী তরুণ ইরশাদ খান। উজ্জ্বল কালো চুল আর চেহারায় হালকা দাড়ি-গোঁফের আভায় বয়সটা দিব্বি বোঝা যায়। ছেলেটি তার সদ্য আঠারো বছরে পা দেয়া ছোট ভাই আর বাবার কাজে সাহায্য করছিল। দুটো গরুকে মাহিন্দ্রার পিকআপ ভ্যানে উঠাচ্ছিলো তারা। রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে যাত্রা শুরু করবে। গন্তব্য জয়সিংহপুর। জয়সিংহপুরেই তাদের বাড়ি। জয়পুর থেকে তাদের গ্রাম ঘণ্টা চারেকের পথ। জয়সিংহপুরে মূলত মুসলমান ও নিম্ন বর্ণের দলিত হিন্দুদের বসবাস। এই দুই শ্রেণির মানুষ সেখানে পাশাপাশি থাকে, দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ ফুলের ক্ষেত, কৃষকরা সরিষা আবাদ করে। ওটাই তাদের মূল পেশা। গ্রামটিতে ছয়শ’ মানুষের বাস। প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার মহানগর দিল্লির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ফলেই জয়সিংহপুর গ্রামটিরও উন্নতি হয়েছে ব্যাপক। রকেটের গতিতে দাম বেড়েছে দিল্লির জমির। খানের পরিবারসহ গ্রামটির মুসলমান পরিবারগুলোরর আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। অনেকে আবার দিল্লি ও এর আশেপাশে বালু ও সবজির বাণিজ্য করে এখন যথেষ্ট সচ্ছল।
সেদিন বিকালে ইরাশদ তার বাবা-ভাইয়ের সাথে ঐ পিকআপে ওঠে। তারা যাত্রা শুরু করে তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে। তারা গরুর সওদা করে ফিরছিল তাদের গ্রামে। গরু হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র প্রাণী। তবে ইরশাদ ছোটবেলা থেকেই গরু ক্রয়-বিক্রয়ের কাজে এমন বহু সফর করেছেন। সে নানা কথাও শুনেছে। পথের বিভিন্ন জায়গায় উগ্র হিন্দুগোষ্ঠী গরু বিক্রির কাজে যাওয়া মুসলমানদের ভয় দেখায়। যারা এই কাজটি করে তারা মূলত সশস্ত্র হিন্দু যুবকদের সংগঠনের কর্মী। সংগঠনের নাম বজরঙ্গ দল। তাদের মূল কাজ গরু রক্ষার স্বার্থে মুসলমান ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করা। এতকিছুর পরও ইরশাদকে ভীত মনে হয়নি। সে আমাকে বলল “আমাদের ভেতর ভয়ের ছিটে ফোটাও নেই। আমরা সরকার আয়োজিত মেলা থেকে সওদা করে ফিরছি এবং সেখানে গরু বেচা-কেনা সম্পুর্ণ বৈধ।”
ঐ দলটি যে রকম সহিংস হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে তা মোটেও নতুন নয়। ১৯৪৮’র ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে নামের একজন ব্যক্তি হত্যা করে গান্ধীকে। নাথুরাম ছিল আরএসএস’র সদস্য। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) একটি উগ্র ডানপন্থী সংগঠন, যার মূল কাজ হিন্দুত্ববাদের ঠাকুরালী বা প্রভুত্ব প্রচার। বজরঙ্গ দলের সদস্যরা ঐ আন্দোলনের তৃণমূল সৈনিক যাদের কাজই সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর ত্রাস সৃষ্টি করা। মূলত কোন সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ করে দাঙ্গা সৃষ্টি করাটা তাদের কাজ। বজরঙ্গ দল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। ষোড়শ শতাব্দীতে অযোধ্যায় একটি মসজিদ তৈরি করে তৎকালীন মোঘল সম্রাট বাবর। বাবরি মসজিদ নামেই মসজিদটির খ্যাতি। মসজিদটি ধ্বংস করার আন্দোলন হিসেবে সংগঠিত হয় বজরঙ্গ দল। (১৯৯২ সালে আরএসএস সংগঠিত একটি দাঙ্গা মিছিলের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয় বাবরি মসজিদ)। শুরু থেকে এই পর্যন্ত সংগঠনটির আড়াই হাজারেরও বেশি উপদল তৈরি হয়েছে ভারত জুড়ে। ২০০৫ সালে এমন একটি উপদল সম্পর্কে আমি প্রথম অবগত হই। নাম ‘আকাদাস; মুম্বাইয়ে অবস্থিত এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তিতে তারা হিন্দু যুবকদের সংগঠিত করে এবং গো-রক্ষার নামে সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক পল রিচার্ড ব্রাস বজরঙ্গ দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন “জঘন্য একটি সংগঠন যা কিনা জার্মানের নাৎসি বাহিনীর মারাত্মক একটি সংস্করণ।”
বিগত ত্রিশ বছর ধরেই বজরঙ্গ দল ভারতে হয় নিষিদ্ধ ছিল, না হয় গুপ্ত অবস্থায় ছিল। তবে ২০১৪ সালে ভারতীয় জাতীয় পার্টি (বিজেপি)’র নেতা নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। বিজেপি একটি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল যাদের আদর্শে আরএসএস’র বীজ রয়েছে সুস্পষ্ট। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বজরঙ্গ দল সমাজে ন্যয্যতা পেতে শুরু করে এবং কয়েক বছরেই সংগঠনটি আরো বড় এবং শক্তিশালী রূপ ধারণ করে। Factchecker.in ভারতের একটি নিরীক্ষণ প্রতিষ্ঠান। তাদের জরিপে বেরিয়ে এসেছে বিগত ৭ বছরে ঘৃণামূলক অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যা লঘুর সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে ১৬৮ বার। সকল হামলার একটিই উদ্দেশ্য ছিল ‘গো-রক্ষা’! ঐ হামলায় মোট নিহত হন ৪৬ জন। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লেখক সালমান খুরশিদ আমাকে বলেন “মুসলমানদের জন্য ভারতে বর্তমান সময়টা খুব খুব প্রতিকূল।” তার আসন্ন প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘ইনভিজিবল সিটিজেন’। বইটিতে তিনি ভারতের মুসলমানদের উপর হয়ে আসা নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়ন ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।
মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতে মুসলমানদের কিছু ঐতিহাসিক বিপত্তি নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। তিনি বলেন “প্রথম বিপত্তি ঘটে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে।” তিনি ঐ যুদ্ধের বিবরণ দিয়ে বলেন, ঐ বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল হিন্দু মুসলমান সৈনিকদের সমন্বয়ে। জনপ্রিয় একটি বৈপ্লবিক উত্থান ছিল সেটা। সেনারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড নৃশংসভাবে দমন করা হয় সেই বিদ্রোহ। এরপর আসে দেশভাগ। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী এই অঞ্চলকে দু’টি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ করে দেয়। মুসলিম প্রধান অঞ্চল হয় পাকিস্তান ও হিন্দু প্রধান অঞ্চল হয় ভারত। দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রাণ যায় ১০ লক্ষেরও অধিক। আরও ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে খুরশিদ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উদাহরণ টানেন। এরপর মোদির শাসনের সম্পর্কে তিনি আমাকে বলেন “এরপরেই সবচেয়ে বড় বিপত্তি তৈরি হয় এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর।” মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবার ইরশাদের গল্পে ফেরা যাক। যখন তারা মাঝ রাস্তায়, তাদের গাড়ি আলওয়ার এ যানজটের কবলে পড়ে তখন ৮ জনের একটি দল তাদের পিকআপ ঘিরে ফেলে। তারা খানের কাছে জানতে চায় পিকআপের পেছনে কি আছে। একজন বলল ‘গরু’। গরুগুলো বিক্রির বৈধ কাগজপত্র দেখানো হল তাদের। “আমরা বজরঙ্গ দল আমরা ঐ সব কাগজ পত্রের ধার ধারি না।”— তাদের মধ্যকার একজন বলে উঠলো। এরপরই কাগজগুলো নিয়ে ছিড়ে রাস্তায় ফেলে দিল তারা। তারা খানদের গাড়ি থেকে নামিয়ে বাহিরে নিয়ে গেল, একটু দূরে। প্রচণ্ড ক্রোধে জেরা শুরু করলো। খানদের পথে একটি থানাও ছিল। সেখান থেকে আধ মাইল হবে। তাদেরকে যেখানে জেরা করা হচ্ছিল সেখান থেকে থানা নজরে পড়ে। ইরশাদ ভেবেছিল যদি তারা জঙ্গিগুলোর সাথে কিছুক্ষণ কথায় কথায় কাটিয়ে দেয় ততক্ষণে পুলিশ বোধহয় তাদের সাহায্যে চলে আসবে। কিন্তু সময় যতই গড়ায় পুলিশ আর আসে না। এর মধ্যে আরো ১০-১২ জন গুণ্ডা এসে তাদের উপর একত্রে হামলা শুরু করে। ইরশাদের কানে কেউ একজন খুব জোরে বাড়ি মারে, এরপর একের পর এক হামলা শুরু হয় তার উপর। রক্তাক্ত হয় সে। ওর ছোট ভাই আরিফ রাস্তায় কুচকে পড়ে থাকে এবং ঐ অবস্থায়ই তার উপর এলোপাথাড়ি আক্রমন চলতে থাকে। পেহেলু, যার পরনে ছিল কুর্তা ও মুখে দাড়ি, সম্পূর্ণ ধর্মীয় বেশভূষা, ইরশাদের বাবা, তাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলা হয়।
এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ভিড় ঠেলে তারা আহত খানদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। হিংস্র জনতা পুলিশের পেছন পেছন হাসপাতালে আসে। তারা হাসপাতালটিকে ঘিরে ফেলে। একজন ডাক্তার ইরশাদ ও তার ছোট ভাইকে রক্ষা করতে তাদের একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখে। ছেলে দু’টো এখনো সেই পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় যা তারা শুনেছিল ওই হাসপাতালের ছাদে যারা তাদের খুঁজছিল মারবে বলে। ইরশাদ আমাকে বলেছিল “আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা চিৎকার করছিলো। তারা আমাদের তিনজনকেই হত্যা করতে চেয়েছিল।” এর দুইদিন পর ছেলে দু’টো সুস্থ হতে শুরু করে। তবে তাদের বাবা পেহেলু এপ্রিলের তিন তারিখ মারা যান। যখন পেহেলুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে তখন হিংস্র জনতা আবার আসে। তারা পেহেলুর লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ডাক্তাররা লাশটাকে হাশপাতালের নিচ তলায় লুকিয়ে ফেলেছিল। পুলিশ আরিফ ও ইরশাদের নিরাপত্তার জন্যে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারা যখন সুস্থ হয়ে জয়সিংহপুরে ফিরে যাওয়ার অবস্থায় যায়, তাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের গ্রাম থেকে শতশত মানুষ আসে। জনতার ঐ ভিড়ে হিন্দু মুসলমানের বিভেদ ছিল না। মুসলমান-দলিত সবাই ভারতে নিপীড়িত।
এইবারও মোদি নির্বাচন করছে। ভারতে নির্বাচনের প্রচারণার সময় প্রায়ই কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে। পূর্বে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। এই বছর বিজেপি বিশেষভাবে চিন্তিত। রাজ্যসভার নির্বাচনগুলোতে হেরে যাওয়াই তাদের চিন্তার কারণ। রাজস্থানের নির্বাচনে ভারতের প্রথম গো-মন্ত্রীর করুণ পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। যদিও এসকল নির্বাচনী পরাজয় শুধুমাত্র কট্টর ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্য নয়। ভারতের জনতা মোদির উপর অসন্তুষ্ট। পাঁচ বছর আগে মোদি যে সকল অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছিল তা না হওয়াটাই সবচেয়ে বড় অসন্তোষ। ২০১৪ সালে জনগণ মোদিকে ভোট দিয়েছিল শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নতির আশায়। বাস্তবিকই ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। গত পনের বছরে ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ ভারতে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। তবুও মোদির আশ্বাস অনুযায়ী উন্নয়ন করতে পারেনি। বর্তমান বেকারত্বের হার সে দেশের গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদি গত কয়েক সপ্তাহে নতুন কিছু অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশ্বাস দিচ্ছে। হতাশ ভোটারদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে উন্নয়নের এমন কি দরিদ্র কৃষকদের নগদ সাহায্য দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
অনেক গবেষক ধারণা করছে ধীর গতির অর্থনীতি থেকে ভোটারদের দৃষ্টি সরিয়ে আনতে নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উষ্কে দেবে নরেন্দ্র মোদি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক তানভীর আলম আমাকে বলেছেন “যেহেতু এই গতিহীন অর্থনীতিতে তার কোন সাফল্য নেই, সে চাইবে জাতীয়তাবাদী প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে।” অনেক বিশ্লেষকের ধারণা মতে, কাশ্মিরে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনার পেছনে মোদি ও বিজেপির হাত রয়েছে। সেখানকার উত্তেজনা দমনে সরকার প্রায় এক বছর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়। ঘাতক বিস্ফোরকসহ একটি গাড়ি নিয়ে প্যারামিলিটারি বাহিনীর উপর ঐ হামলা চালায়। জানা যায় হামলাকারী স্থানীয় বাসিন্দা, তার নাম আদিল আহমেদ দার। সে গতবছর বাড়ি থেকে পালিয়ে জৈশ-ই-মুহাম্মেদ নামের সশস্ত্র সংগঠনে যুক্ত হয়। বিগত দশকের মাঝে এটাই কাশ্মিরে সবচেয়ে বড় হামলা। ঐ হামলার পরেই যুদ্ধের হুমকি দেয় নরেন্দ্র মোদি। উত্তর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় ভারতে বিমান বাহিনী। পাকিস্তান বাহিনী হামলা প্রতিহত করে এবং অন্তত একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে। দু’দেশের মাঝে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার গত কয়েক বছরে কিছু এমন আইন পাশ করেছে যা সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। কিছু রাজ্য সরকার ‘এন্টি-কনভারশন’ আইন পাশ করেছে যেখানে বলপূর্বক ধর্ম পরিবর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইন পাশ করা হয়েছেই মূলত হিন্দুদের খ্রিষ্টান ও মুসলমান ধর্ম গ্রহণ বন্ধ করার লক্ষ্যে। ধর্মান্তরিত হওয়া ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের একটি ঐতিহাসিক পরিণাম। বর্ণ ব্যবস্থার অতি কঠিন ও নিপীড়নমূলক নিয়ম-কানুন থেকে বাঁচতেই ধর্মান্তরিত হয় তারা
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার গত কয়েক বছরে কিছু এমন আইন পাশ করেছে যা সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। কিছু রাজ্য সরকার ‘এন্টি-কনভারশন’ আইন পাশ করেছে যেখানে বলপূর্বক ধর্ম পরিবর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইন পাশ করা হয়েছেই মূলত হিন্দুদের খ্রিষ্টান ও মুসলমান ধর্ম গ্রহণ বন্ধ করার লক্ষ্যে। ধর্মান্তরিত হওয়া ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের একটি ঐতিহাসিক পরিণাম। বর্ণ ব্যবস্থার অতি কঠিন ও নিপীড়নমূলক নিয়ম-কানুন থেকে বাঁচতেই ধর্মান্তরিত হয় তারা। বজরঙ্গ দল বিভিন্ন প্রতিমার উদ্ধৃতি দিয়ে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের উপর হামলার ন্যয্যতা দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে উত্তরপ্রদেশে এক ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত হওয়ার সাজা স্বরূপ বজরঙ্গ দলের সদস্যরা প্রথমে তাকে ন্যাড়া করে এবং মাথায় রঙ মাখিয়ে তাকে গাধার পিঠে চড়ায়। মোদির ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিয়ে বরবরই নীরব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালের টাইম ম্যগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যাক্তির তালিকায় নাম আসে নরেন্দ্র মোদির। সেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মোদির সমর্থনে নানা কথা লিখলেও তার দেশের উগ্র ও সহিংস জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছুই লেখেননি। অন্যদিকে ট্রাম্পের পাবলিক সাপোর্ট অফ রিলিজিয়াস ফ্রিডম থেকেও ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কে কোন সমালোচনা করা হয়নি। মোদি বেশ কয়েকবারই যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চপর্যায়ের সফরে গেলেও তার কোন সমালোচনা সেখানে হয়নি।
আন্তর্জাতিক মহলে মোদি সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য কিছুটা দৃশ্যমান হলেও সেদেশের সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে কোন হিসাব হয়নি এখনও। ভারতের একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমিতাভ কুণ্ডু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল “তোমার কি মনে হয় এদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা নিয়ে আমেরিকান ব্যবসায়ীরা বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়?” দিল্লিতে তার অফিস। সেখানেই কথা হচ্ছিল তার সাথে। তিনি আরও বলেন “এখন সাধারণ হিন্দুরাই এই ক্ষিপ্র হিন্দুত্ববাদকে থামাতে পারে।” ২০১৪ সালে কুণ্ডুর একটি গবেষণাপত্র ছাপা হয়। যেখানে তিনি ভারতের মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। ভারতের ১৫ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলমান। কুণ্ডু তার গবেষণায় বলেন গত কয়েক দশকে বর্ণ বৈষম্য কমেছে বটে তবে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মুসলমান নির্যাতন ও নিধন। যদিও ভারতের শহরগুলোতে অন্তঃপ্রবাহ সবসময়ই বেশি তবুও বড় শহরগুলোতে কমেছে মুসলমানদের প্রবেশ। শ্রমবাজারে মুসলমান বর্জনই এর বড় কারণ। ভোটার তালিকা থেকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে মুসলমানদের নাম। গুরগাঁওতে মুসলমানদের জামাতে নামাজ পড়া নিষিদ্ধের দাবিও এসেছে হিন্দুদের কাছ থেকে। সেই দাবিতে নামাজ চলাকালীন অবস্থায় হামলাও হয়েছে বেশ কয়েকবার।
কুণ্ডুর সাথে কথা হওয়ার পর আমি গিয়েছিলাম শারিম নাভিদের সাথে দেখা করতে। নাভিদ একজন তরুণ মুসলমান আইনজীবী। অফিস ঘরেই কথা হয় তার সাথে। তার অফিসটা জানালাহীন একটি ভবনের বেজমেন্টে অবস্থিত। নাভিদ মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে হওয়া পুলিশি অত্যাচার, দাঙ্গা-হত্যা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। সে একটা ব্যাংকের বড় চাকরি ছেড়ে নিজেকে এই কাজে উৎসর্গ করেছে। তার এই পেশায় আসার কারণ সে এমন এক সময় এদেশে বেড়ে উঠেছে যখন পুরো ভারত ভুগছে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-ভীতিতে। সে বলেছিলো “তুমি যদি মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ কর তবে তুমি আজন্ম রাজনৈতিক।” সে এখনও ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসকালীন দাঙ্গার কথা মনে করে। তখন সে ছোট্ট শিশু তবুও ঐ দাঙ্গা দাগ কেটেছে তার মনে। সে বলছিল “তারা বলত এদেশে নাকি বাম রাজনৈতিক শক্তি ছিল তবে আমার প্রজন্ম তা কখনোই দেখে নাই। আমরা দেখেছি শুধুই হিন্দু জাতীয়তাবাদ।”
এক দুপুরে আমি ইরশাদ ও আরিফের সাথে দেখা করেছিলাম যারা ডানপন্থী হিন্দুদের হামলা থেকে বেঁচে ফিরেছিল। তারা এখনো তাদের বাবার তৈরি করা বাড়িতেই থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, কাদা ওয়ালা রাস্তার পাশে একটি নিম গাছের ছাউনি, ওখানেই ইরশাদদের বাড়ি। খোলা উঠানের এক পাশে একটি মহিষ বাধা, অন্যপাশে একটি ছাগল আর তিনটে ছাগলছানা শীতে রোদ পোহাচ্ছিল। ইরশাদ রোদের নিচে একটা আসন নিয়ে আসল। আমাকে বসতে দিল। ইরশাদ আর আরিফ আমাকে বলল কিভাবে ঐ হামলা তাদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই দিনের পর তারা যে শুধু দরিদ্রই হয়েছে তাই-ই না, ঐ হামলার পর থেকে সামাজিক লজ্জা আরও ধ্বংস করে দিচ্ছে তাদের। ইরশাদ বলেছিল “মানুষ আমাদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে।” অনেকে সাহায্যও করেছে তাদের। সবুজ-হলুদ রঙের একটা জন ডিরি ট্রাক্টর উপহার পেয়েছে তারা। বাড়ির পেছনে পুঁই’র মাচার সাথে রাখা ছিল সেটা। ইরশাদ ঐ ট্রাক্টরের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তবে সরিষার চাষ মৌসুম ছাড়া সারা বছর তাই ঐ ট্রাক্টরে আয় সম্ভব হয় না। এভাবে তার পরিবার চালিয়ে নেয়া বেশ মুশকিল হয়ে পড়ছে। ঐ হামলার পর তাদের গরু হরিয়েছিল তারা। ওদের বাবার দুধের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইরশাদও এখন বনিকের কাজ করতে পারে না। সে বলছিল এখন তাদের জন্য বাণিজ্য এতটাই কঠিন যে গরু নিয়ে সওদা করতে যাক না যাক, তার কাছে গরু আছে এমন গুজবই যথেষ্ট তার মৃত্যুর জন্য। সে গাড়ি চালানোর চাকরি পেলেই কেবল গ্রাম ছাড়বে। পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বেতন হলেই তার চলবে বলে জানায় সে।
মোহাম্মদ আলী ভারতের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। বর্তমানে তিনি এই প্রেক্ষাপটেই একটি বই লিখছেন। তিনি আমাকে বলেন “আইন বহির্ভূত বিচার এখন একটি জাতীয়তাবাদী প্রক্রিয়া।”
গত বছর জুলাই মাসে গো-রক্ষা সম্পর্কিত হত্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সে মাসে ১৩টি মর্মান্তিক মামলা চলছিল এই বিষয়ে। কোর্ট জানায় আইন সভার ঐ সমস্ত বিল আইন চর্চার পরিপন্থী। গত মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০৪ পৃষ্ঠার একটা প্রতিবেদন পেশ করে। এখানে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন সম্পর্কিত সকল মামলার তদন্তে ঘাটতি ও কর্মকর্তাদের উদাসীনতার চিত্র তুলে ধরা হয়। তাদের তালিকাও আসে ঐ প্রতিবেদনে যেখানে উল্টো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তদন্ত করার কারণে। মোহাম্মদ আলী ভারতের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। বর্তমানে তিনি এই প্রেক্ষাপটেই একটি বই লিখছেন। তিনি আমাকে বলেন “আইন বহির্ভূত বিচার এখন একটি জাতীয়তাবাদী প্রক্রিয়া।” তিনি জানান খুব অল্প সংখ্যক অপরাধীর সাজা হয়েছে যা বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি তৈরি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমান নিধন ও ধর্মীয় চেতনা রক্ষার নামে হত্যাকারীদের বীর রূপে প্রদর্শিত করা হচ্ছে।
পেহেলু মৃত্যুর আগে চেতনা ফিরে পেয়েছিল, সে তার কিছু হামলাকারীদের সনাক্ত করে গিয়েছিল। সে তার হত্যাকারীদের নামও উল্লেখ করে গিয়েছিল যদিও আজ পর্যন্ত একজনকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। আসল হত্যাকারীর পরিবর্তে অন্য ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যদিও ইরশাদ জানতো এটা বিপজ্জনক তবুও সে আলওয়ারে গিয়ে এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সাক্ষ্য দিতে চাইলেও তার সেই ব্যবস্থা করে দেয়া হয়নি। সে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিল, কীভাবে তাদের উপর হামলা হয়, কীভাবে সে জয়সিংহপুর ফিরে আসে। তবুও তার বাবার হত্যাকারীরা এখন জামিনে মুক্ত। মূলত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব দেখিয়েই এসব ক্ষেত্রে রেহাই পায় হামলাকারীরা। অপরাধীদের একজন হামলাচলাকালীন অবস্থায় ভিডিও ধারণ করেছিল যা ইউটিউবে আপলোডও করা হয়। বজরঙ্গ দলের চ্যানেল থেকেই আপলোড করা হয় ভিডিওটি। ভিডিওটির তাৎক্ষনিক দর্শক ছিল ৬ লক্ষ।
খানদের বাড়িতে, শবনমকে দেখি আমি। সে ইরশাদের স্ত্রী। তার কোলে ছিল তাদের তৃতীয় সন্তান যে আমার মত একজন অচেনা মানুষকে দেখে চিৎকার করছিল। শবনম বলছিলো, তার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর তাদের জীবন কতটা বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছে। শুধু পেহেলুর আয়ই নয়, পরিবারে তার শূন্যতা সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে। শবনম বলছিল “এই পরিবারটিকে একত্র করে রাখার মত আর কেউ নেই এখন।” সে হামলার খবর জেনেছিল ঘটনার ঘণ্টা কয়েক পর। পাশের গ্রাম থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে এসে খবর দেয় এরপর কেউ একজন তাকে ইউটিউবে ভিডিওটি দেখায়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ভিডিওটা যখন দেখেছিল তখনও কি ঐ হামলাকারীরা ইউটিউবে অনলাইন ছিল কিনা। সে জানায় ছিলনা। এর মধ্যেই স্থানীয় এক মানবাধিকারকর্মী এসে আমাকে ঐ ইউটিউব চ্যনেলটি দেখায়। আমরা খুঁজছিলাম ঐ হামলার ভিডিওটা। ঐ ভিডিওটা খুঁজতেই আমরা ডজন খানেক একই এরকম হামলার ভিডিও খুঁজে পাই। ভিডিওগুলো শুধু মুসলমান নির্যাতনের জন্যই আপ করা হয়েছিল তাই নয় বরং এমন একটা ন্যাক্কারজনক কাজ করার পরেও তাদের বীরসুলভ-আচরণ ছিল অসহ্যকর। তারা হামলা করতে পেরে খুব গর্বিত ছিল। একটা ভিডিওতে আমি দেখলাম সাদা প্যান্ট আর গোলাপি সোয়েটার পরা একজন লাঠি দিয়ে এক মুসলমানকে প্রহার করছে। তাকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তির অপরাধ ছিল সে একজন হিন্দু নারীর প্রেমে পড়েছিল। ঐ হত্যার পর, হত্যাকারী ক্যমেরার সামনে এসে সকল হিন্দু নারীর উদ্দেশ্যে বলে “আমি সকল হিন্দু বোনদের প্রতি আবেদন করছি আপনারা কেউ এমন ভুল করবেন না। এইসব জিহাদিদের ফাঁদে পা দেবেন না। তারা আপনাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবেন না শুধুই নিজেদের যৌন-ক্ষুদা মেটাবেন।” আর একটি ভিডিওতে দেখলাম বজরঙ্গ দলের এক সদস্য ট্রাকে উঠে চালককে থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞেস করছে “তোর নাম কি?” উত্তরে চালক বলে “মুবারক”। ঐ উত্তর শুনে ঐ হামলাকারী বলে “মুবারক, মুসলিম?” বলেই তাকে বেদম প্রহার শুরু করে। অবশেষে আমরা পেহেলু হত্যার ভিডিওটি পেয়েছি। ভিডিওতে দেখলাম পেহেলু ফুটপাতের কিনারায় বসে আছে, হাতের তালু উল্টে সে ক্যামেরার মালিককে অনুরোধ করছে ভিডিও না করার জন্য। এরপরেই একজন হামলাকারী তাকে সজোরে ধাক্কা দিল এবং সে ক্যামেরা ফ্রেমের বাহিরে চলে গেল।