[আয়াক্সের সাথে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর এক রিয়াল ভক্তের খোলা চিঠি]
নিশাচর,
তুমি কি কাল মধ্যরাতে জেগেছিলে? যদি জেগে থাকো, তবে দেখে থাকবে ডুবে যাওয়া সূর্য আলো জ্বালিয়ে কীভাবে আবার ডুবে যায় চোখের পলকে। দেখে থাকবে, সুই-সুতোর মলাটে বোনা এক স্বপ্নের থমথমে অপমৃত্যু। যে স্বপ্ন বুকফাঁটা ছিল— যে স্বপ্নে রাতজাগা ছিল— ছিল অন্তরাত্মা খুবলে খুবলে খাওয়া নিষ্ঠুর করাঘাত।
আমি ফুটবল বুঝিনা। কোনদিন বুঝতেও চাই না। শুধু জানি, ধবধবে সাদা এক কোর্তায় বছরের পর বছর ধরে রঙিন স্বপ্নরা আমার কীভাবে আঁকিবুঁকি করে!
জানি, পৌষের রাতে একশ তিন ডিগ্রী জ্বর এসেনসিও নামের এক ছেলের গোল উল্লাসে নিমেষেই হাওয়া হয়ে যায়।
জানি, সুন্দরী প্রিয়তমার জন্মদিনের রাতে, তার ফোনালাপের চেয়ে মার্সেলো নামের কুচকুচে এক কালো লোকের পায়ের দৌড় আমায় বেশি কাছে টানে।
এসেনসিও-মার্সেলো এদের কারো সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। দেখলে এরা আমায় চিনবেও না।তবুও লাল-নীল জার্সি পরিহিত কোন ভদ্রলোক যদি এদের কটাক্ষ করে উক্তি ছাড়ে। সারাদিনের নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে আমি তার মন্তব্যের জবাব দিয়ে যাই দাঁতভাঙ্গা সব তর্কযুদ্ধে।
রামোস নামক উগ্র এক ব্যাডবয়ের হাসির ছবি খালি পেটে দেখতে দেখতে আমার পেটভরে ওঠে— বেরোয় তৃপ্তির ঢেকুর।
মাসের আটাশ তারিখে শূন্য মানিব্যাগ হাতড়ে বেড়াই। ধারের দোকানে লজ্জা লজ্জা ভাবে আরও একটি রিচার্জ কার্ড খুঁজতে যাই। সেদিন রাতে ফেসবুক লাইভে মদ্রিচ নামে এক মধ্যবয়সীর সোনালি চুলের দোলন দেখবো বলে।
জানো, নিশাচর? আমি না খুব বদ মেজাজি ছেলে। ক্লাস সেভেনের রেজাল্ট ডিমোশন দেখে বাবা বকেছিলেন বলে দুই মাস তাকাইনি তার দিকে। ২০০৯ সালে পছন্দের নীল পাঞ্জাবি কিনে দেয়নি বলে ঈদের দিন কাপড় গায়ে জড়াইনি। অথচ সেই আমি সিজনের পর সিজন অফফর্মে কাটিয়ে দেওয়া করিম বেঞ্জেমা একদিন জোড়া গোল করলেই তার ছবি প্রোফাইলে টাঙ্গিয়ে দিই। ভুলে যাই তার লক্ষ্যহীন শটে হারিয়ে যাওয়া বলের মত হারিয়ে যাওয়া অগণিত ট্রফির হাতছানিগুলোকে।
ঠুঁটো জগন্নাথ রূপে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যারেথ বেলকে রোজ সকালে গালি দেই। তাকে বিক্রির স্ট্যাটাস দেই। কিন্তু সেই বেলকে নিয়ে শত্রুপক্ষ কিছু বলতে গেলেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই বাই সাইকেল কিকের কথা।
নিশাচর শুনছো? —এই সাদা জার্সি অনুভূতি জড়ানো এক আবেগের নাম— যে আবেগ সব সম্পর্কের ইতি টেনে ইতালি পাড়ি জমানো লোকটাকে এখনো নতুন করে ভালবাসতে শেখায়— যে আবেগ বারেবারে আঘাত করা রাবণরূপী পেরেজকেও নতুন এক সৈনিক কিনে আনার আকুতি করতে শেখায়— যে আবেগে অজপাড়া গায়ের অচেনা এদেখা এক ব্লাংকোস ফ্যানকে মুহূর্তে সহোদর ভাই বানিয়ে দেয়।
যে কখনো ভালবাসেনি! প্রিয়ার কি রূপ সে কি বুঝে? সে কি জানে? —এই জার্সিটা যে এক ভালবাসার লকেট। দিনের পর দিন আত্মমর্যাদার গোলপোস্ট পাহারা দেওয়া ক্যাসিয়াসকে ছুড়ে ফেলার পর ও যে ভালবাসা একচুলও কমেনি— যে ভালবাসা রাউলের সরলতায় ছেদ ফেলে সময়ের সেরা তারকা হয়েও উপেক্ষিত করায় এক বিন্দুও খসে পড়েনি।
আজও তারা মাদ্রিদের ঘড়ির সন্ধ্যে টাইমে টিভির চ্যানেল খুলে। ইস্কোর চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে হাততালি দিয়ে উঠে। ‘গোল’ ‘গোল’ বলে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে লাফিয়ে উঠে ক্যাসেমিরোর ডান পায়ের আচমকা শটে।
নিশাচর, আমি একঝাঁক গ্যালাক্টিকোসের নোয়ানো মাথায় বছরের পর বছর ট্রফি জয়ের অপেক্ষা গুণতে দেখেছি। কখনো বেঞ্চে— কখনো মাঠে— পেন্ডুলামের মত দোল খাওয়া গুতি হাজের ভাগ্যের দোলাচল দেখেছি। কিন্তু অবজ্ঞা-অনাদরে পড়ে থাকার পরও তার বুকপকেটে অন্য আকাশে উড়াল দেওয়ার ইচ্ছে দেখিনি।
জানি না ঠিক কী আছে এই জার্সির তলায়? তবে জানি অনেক কিছুই আছে; যেটা আধাম্যাচ খেলে হাটুর ব্যথায় নেমে যেতে যেতে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের বাচ্চাসুলভ কান্নায় খুঁজে পাই— যেটা ক্লাসিকোতে জোড়া হারের পর রেগুলিয়নের চোখ বেয়ে টপ টপ করে ঝ’রে পড়া নোনা পানিতে খুঁজে পাই— যেটা চার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সিজনের মাঝপথে এসে পরের মৌসুমের আশা বুকবাধার মাঝে খুঁজে পাই।
ওহে নিশাচর, এই মাদ্রিদের ধ্বংসস্তূপ দেখে তুমি ভয় পেয়ো না। মনে রেখো, এই জার্সিতে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর গায়ের ঘাম লেগে আছে; যার জোড়াপায়ের শটে ভেঙ্গে চুরমার হয়েছিল প্রতিপক্ষের দম্ভ-অহংকার।
ভুলে যেওনা, আমরা ফেরেঞ্জ ফুসকাসের উত্তরসূরি, যতবার মাদ্রিদের সম্মানে আঘাত এসেছে, ওৎপেতে শত্রুতা মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে ততবার বীরদর্পে জানান দিয়েছি আগলে রাখা রাজত্বের কথা। এ জার্সি বিশ্ববিজেতা ফেনোমেনের উত্তরাধিকারী— হতাশার নীলবিষে জ্বলতে থাকা দাউদাউ আগুন জমিয়ে রাখা রাবার্তো কার্লোসের তরবারি— রক্তে আগুন ধরা ডেভিড ব্যাকহামের ফ্রি কিক এই জার্সি পড়ে শাসন করেছে— বুলেটগতির জাল ফেটে বেরিয়ে যাওয়া ভলিতে প্রতিপক্ষকে কাঁদানো একজন জিজু এই জার্সিতে মিশে আছে।
এরা ঠিকই রাজার আসনে ফিরে আসবে। বুনো উল্লাসে আবারো উঁচিয়ে ধরবে ইউরোপ-সেরার জ্বলন্ত মশাল। এরা আবারও দগ্ধচিত্তে জানান দিবে হৃদয়ের অভ্যন্তরে জ্বলতে থাকা লাভা— এরা আবারো বিষবৃক্ষে মত ধুলোয় মিশিয়ে দিবে রাইভালদের বিশ্রী হাসি— এরা ফিরে আসবে আবারো, ফিরে আসবে রাজার বেশেই।
নিশাচর জলে ভরা চোখ মুছে বললো, তুমি কে বাছা?
– আমি? আমি মাদ্রিদিস্তা!