মাত্র দু’দিন পরেই ডাকসু’ নির্বাচন ২০১৯। শুরুতে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের শোডাউন এবং ছাত্রলীগের উষ্ণ অভ্যর্থনার কারণে এই নির্বাচন নিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।গতকাল শুক্রবার ‘সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র ব্যানার ছিড়ে ফেলা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। যা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ ডাকসু নির্বাচনকে বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত হওয়া আর দু’চারটে নির্বাচনের ফরম্যাটে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। যে বিবেচনায় বলতে হয়, ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া ভাল; অন্তত এই সরকারেরর শাসনামলে।
দীর্ঘ তিন দশকের বন্ধ্যা অবস্থা কাটিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই বিষয়টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা স্বস্তি বয়ে এনেছিল। যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। সেটা আমাদের বর্তমান জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যাবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, মতিয়া চৌধুরী, আমানউল্লাহ আমান, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনুদের মতো রাজনীতিবিদরা এক সময় ডাকসু’র প্রতিনিধিত্ব করেছেন।এদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য পরে নিজেদের ছাত্র-রাজনীতির আদর্শ থেকে সরে গেছেন! সেই বিবেচনায় রাজনীতির একরকম সুতিকাগার এই ছাত্র সংসদ এবং নির্বাচন।
স্বাধীনতার পর থেকে মাত্র ৬ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ বর্ষে নির্বাচন হয়েছিল। সে সময় বিএনপি’র অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলের প্যানেল জয়যুক্ত হয়েছিল। এরপর থেকে আর কোন নির্বাচন হয়নি। মূলত বলা হয়ে থাকে, গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচন দিতে ভয় পায়। কেননা, তাদের শঙ্কা থাকে যে যদি তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হেরে যায়। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সমর্থন উঠে যাবে। এখনও সে শঙ্কা রয়েছে। ডাকসু নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সফল বাম রাজনীতির সংগঠনগুলো। কিন্তু তারা কখনোই জাতীয় রাজনীতির ক্ষমতায় ছিলেন না। অন্যদিকে ছাত্রলীগ যতবার ক্ষমতা পেয়েছে তারা জোট করেছিলো বাম সংগঠনগুলোর সাথে। ছাত্রদল অবশ্য একাই লড়েছিল। এই ক্ষমতাসীনদের হেরে যাওয়ার শঙ্কা এখনো বহাল রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে ২৫ জন ভিপি এবং ১৪ জন সাধারণ সম্পাদক পদে লড়াই করছে। ভিপি পদে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রধান নেতা নূরুল হক নূর লড়ছেন ভিপি পদের জন্য, একই পদের ফেবারিট প্রার্থী প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের লিটন নন্দী। অন্যদিকে জিএস পদে স্বতন্ত্রপ্রার্থী অরণি সেমন্তি কিংবা আসিফুর রহমান সংগঠনগুলোর প্রার্থীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী। ডাকসু নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হলে যোগ্য নেতারাই ভোট পায় তা ইতিহাস স্বীকৃত। যার ফলে এই প্রার্থীদের জয়ে সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।
ডাকসু নির্বাচনের সমস্যাটা যেখানে
ডাকসু নির্বাচন ২০১৯ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়ের একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন দিচ্ছে এটাকে অনেকে ইতিবাচকভাবে দেখায় আসল ক্ষতগুলো চোখে পড়ছে না।সেদিকেই খানিকটা লক্ষ করা যাক।
জাতীয় নির্বাচনের পরপর খুব দ্রুতই ডাকসু নির্বাচন দেয়া হয়েছে। এই সময়ে সংগঠনগুলোর গুছিয়ে ওঠা সম্ভব না। বিশেষ করে এতদিন যেখানে ছাত্রলীগের দৌরাত্মে ক্যাম্পাসে মিছিল-মিটিং করাই সম্ভব হচ্ছিল না। সেখানে এতদ্রুত ছাত্র সংসদের মতো একটা নির্বাচনে যোগ দেয়া কঠিন। ছাত্রদল সময় বাড়ানোর আবেদন করলে তা বাড়ানো হয়নি। নির্বাচনের প্রধান খেলাটা মূলত প্রশাসন নিজের হাতে রেখে দিয়েছে। তারা হলের ভোটার নয় এমন প্রার্থীকেও মনোনয়ন দিয়েছে। কারণ সে ছাত্রলীগের প্রার্থী!
যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা সিটি নির্বাচনের মতোই ডাকসু নির্বাচন হয়। তবে বলতে হবে, ডাকসু নির্বাচনের কোন প্রয়োজন নেই। নির্বাচিত সরকারের অধিনে এই নির্বাচন না হওয়াই উচিত। অন্তত বর্তমান সরকারের শাসনামালে।
ছাত্র-সংগঠনগুলো আন্দোলন করেও ভোটকেন্দ্র সরাতে পারেনি। গঠনতন্ত্র পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন আনা হয়নি। হলে ভোট কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য। হলে ভোট কেন্দ্র ডাকসু নির্বাচনের নিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় হুমকি। হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে। বিভিন্ন সময়েই তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। ক্যালকুলেটর চাওয়ায় মার খেতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। আর আটকে রেখে টর্চারতো নিত্য নৈমিত্তিক। সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা সিটি নির্বাচনের মতো আদৌ ভোট দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে!
দ্বিতীয়ত, ভোটার ঘণ্টা নিয়ে বিপত্তি। ডাকসু নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ৪৩ হাজার। যাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৬ ঘন্টা। এই ছয় ঘণ্টায় এতো শিক্ষার্থীর ভোটগ্রহণ আদৌ সম্ভব কি না? সে বিষয়ে প্রশাসনের কোন খেয়াল নেই। একজন ভোটারকে মোট আটত্রিশটি ভোট দিতে হবে। প্রতি হলে যদি ৩০টি করে বুথ বসানো হলেও ২৮ হাজারের মতো শিক্ষার্থীর ভোটগ্রহণ সম্ভব। সংগঠনগুলোর দাবি ছিল আরও ৪ ঘন্টা সময় বাড়ানোর কিন্তু প্রশাসন সেদিকে কোন নজরই দেয়নি। তাহলে কি আবারও পূর্ব পরিকল্পিত নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, আচরণবিধি ভাঙার ক্ষেত্রেও দলকানার ভূমিকায় প্রশাসন। নূরুল হক নুর’র ব্যানার ছিড়ে ফেলার পরও কোন তদন্তর কথা বলেনি নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী’র রঙিন ব্যানার ও পোস্টার দেখা গেছে। যা ডাকসু নির্বাচনের ৬(ক) ধারার লঙ্ঘন। সরাসরি নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি।
আর যাই হোক, এতটুকু ধারণা করা যায়, ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পথে নেই। প্রশাসনের দলকানা মানসিকতাই ডাকসু’র ভবিষ্যৎকে কলুষিত করতে যাচ্ছে। যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা সিটি নির্বাচনের মতোই ডাকসু নির্বাচন হয়। তবে বলতে হবে, ডাকসু নির্বাচনের কোন প্রয়োজন নেই। নির্বাচিত সরকারের অধিনে এই নির্বাচন না হওয়াই উচিত। অন্তত বর্তমান সরকারের শাসনামালে। ছাত্র সংগঠনগুলোর উচিৎ ডাকসু’র মান বাঁচাতে নির্বাচনকে প্রত্যাখান করা। সাবধান, ডাকসু অন্ধকার ভবিষ্যৎ রচনা করতে যাচ্ছে!