ভারতের সর্বাধিক ‘বিতর্কিত’ জমি বিবাদ বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি মামলা মেটাতে হবে মধ্যস্থতার মাধ্যমে, ঘোষণা করল ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের বিবাদ নিরসনের লক্ষ্যে তিন সদস্যের প্যানেল তৈরি করেছে। প্যানেলের শীর্ষে থাকবেন প্রাক্তন বিচারপতি এফ এম কলিফুল্লা এবং অন্য দুই নির্বাচিত সদস্য হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর ও প্রবীণ আইনজীবী শ্রীরাম পঞ্চু। কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক, এক সপ্তাহের মধ্যে মধ্যস্থতা শুরু করতে হবে; প্রথম অগ্রগতি সংক্রান্ত বিবরণ চার সপ্তাহের মধ্যে জমা করতে হবে এবং আট সপ্তাহের মধ্যে মীমাংসায় পৌঁছাতে হবে। এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া চলবে বিতর্কিত ভূমি অবস্থিত যেখানে সেই ফৈজাবাদে বসেই। আগামী মাসদুয়েকের মধ্যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচার জোরকদমে চলবে, অন্য দিকে বিতর্কিত জমিকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় পথ খুঁজবে তিন সদস্যের প্যানেল। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠছে, ভারতীয় রাজনীতি কি প্রভাবিত হবে না এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া দ্বারা? উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে। সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকায় সুপ্রিম কোর্ট কঠোর নির্দেশ দিয়েছে, মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া চলাকালীন কোনও সদস্য সংবাদ মাধ্যমে কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না। ‘চূড়ান্ত গোপনীয়তা’ বজায় রাখার উদ্দেশ্য, কোনও রাজনৈতিক দল যেন নির্বাচনী ফায়দা নিতে না পারে।
উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা অঞ্চলে দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাসে পুণ্যস্থান বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির ‘বিতর্কিত’ জমিকে কেন্দ্র করে হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাদ জারি আছে বহু বছর থেকে। মুঘল শাসক বাবরের জমানায় ১৫২৮-২৯ সময়কালে ঐতিহ্যশালী বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এপ্রিল, ১৯৮৪ থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জোরদার দাবি করে, বাবরি মসজিদের ‘ওখানেই’ রাম জন্মভূমি! অতএব, মসজিদ ভেঙে ওখানেই তৈরি হবে মন্দির। দাবি কার্যকর করার লক্ষ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করে ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময়পর্বে। পরে একাধিক রথযাত্রা আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজেপি, ভিএইচপি, আরএসএস দলের কয়েকজন শীর্ষনেতা সেখানে হাজির হয়েছিলেন। ওই দিন কিছু ‘করসেবক’ অর্থাৎ উগ্র হিন্দুত্ববাদের অনুসারী গম্বুজে উঠে ভাঙচুর করে বাবরি মসজিদ। দীর্ঘদিন ধরেই ওই বিতর্কিত ভূমিতে রামমন্দির নির্মাণের দাবি করে কিছু হিন্দু সংগঠন। হিন্দু ভোট টানতে ওই ‘বিতর্কিত’ ভূমিতে রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়াও বিজেপির এক রাজনৈতিক কৌশল ছিল। ভোট-বৈতরণী পার হতে রামমন্দির ইস্যু ‘শিওর শট’ ছিল অতীতে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে একই পন্থায় বাজিমাত করার পরিকল্পনা ছিল বিজেপি শিবিরের। কয়েক মাস আগেও রামমন্দির ইস্যু উত্থাপন করে জল মাপতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ‘সেনাপতি’ অমিত শাহ। কিন্তু, তাদের কৌশল ধরে ফেলেছে হিন্দু সংগঠনগুলি। কুম্ভে সাধুদের ধর্ম সংসদে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেছেন, নির্বাচনের জন্য রামমন্দির আন্দোলনে চার মাস বিরতি থাকবে। সূত্র অনুযায়ী, হিন্দু সংগঠনের সদস্যগণ বিজেপি সরকারের জমানায় রামমন্দির নির্মাণের আশা রাখছেন না। তাই তারা সচেতন, আসন্ন নির্বাচনে রামমন্দির ইস্যু দ্বারা বিজেপি যেন ফায়দা নিতে না পারে। কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ মনে করছেন, ‘‘এক দিকে গোপন মধ্যস্থতা, অন্য দিকে তার জন্য আট সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সক্ষম হয়েছে। কোনও দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই ইস্যু কাজে লাগাতে পারবে না। যা হবে ভোটের পরে।’’ হাওয়া বুঝে তাই বিজেপি শিবির রামমন্দির ইস্যু বাদ দিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরের পুলওয়ামায় ৪৯ জন সৈনিক নিহত হওয়া প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজে লাগাতে তৎপর। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, রামমন্দির আবেগ যদি কাজে লাগত তবে বিজেপি শিবির সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে অধ্যাদেশ আনার চেষ্টা করত।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে অযোধ্যা মামলা নিষ্পত্তি করতে পি ভি নরসিংহ রাও এবং চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রীত্বে চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু, মোট চারবারের চেষ্টা বিফল হয়েছে। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর এবং হিন্দু ধর্মগুরু কাঞ্চীর শঙ্করাচার্য, শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর উদ্যোগী হয়েছিলেন মীমাংসা করতে, সেই চেষ্টাও বিফল হয়েছে। তাই এবারও যে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে মামলা নিষ্পত্তি হবে, আশা রাখছেন না সচেতন নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশ। বর্তমান সাংবিধানিক বেঞ্চের বিচারপতিদের বক্তব্য, তারা অযোধ্যার ২.৭৭ একর জমিকে কেন্দ্র করে লড়াইকে স্রেফ জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদ মনে করছেন না। মধ্যস্থতার মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের অতীতে ঘটে যাওয়া বিবাদে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষতের চিকিৎসা করতে চান তারা! তবে কিছু আইনজীবী মনে করছেন, মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় হিন্দু পক্ষের দাবি। তাই হিন্দু মধ্যস্থতাকারীদ্বয় যদি অনড় অবস্থান নেন, তবে মুসলিম শিবিরের মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী বলেছেন, “আমি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। কিন্তু রামকে তাঁর জন্মস্থান থেকে কেউ হঠাতে পারবে না। রামমন্দির তৈরি করতে হবে ওখানেই।” শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর বলেছেন, দুই সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় মন্দির তৈরি হলে সমস্যা সমাধানে হবে। রবিশঙ্কর মন্দির নির্মাণের পক্ষে সওয়াল করবেন, তা সন্দেহাতীত। তাই এমআইএম সুপ্রিমো আসাদউদ্দিন ওয়াইসি মন্তব্য করেছেন, “যদি নিরপেক্ষ কাউকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা হত, খুশি হতাম। রবিশঙ্কর এর আগে মন্তব্য করেছেন, মুসলিমরা অযোধ্যার দাবি না ছাড়লে, ভারত সিরিয়ায় পরিণত হবে। সুপ্রিম কোর্টের উচিত ছিল নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা।” অতীতে রবিশঙ্কর বলেছেন, “মুসলিম সম্প্রদায়ের উচিত হিন্দুদের রামমন্দির তৈরির জন্য বিতর্কিত জমিটা উপহার দিয়ে দেওয়া। কারণ সেটা রামের জন্মভূমি। মুসলিমদের জন্য জায়গাটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে জমিতে বিবাদ থাকে, সেখানে নামাজও আদায় হয় না।” এই প্রসঙ্গে তিনি মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডকে চিঠিও লিখেছিলেন। আদালতে দুই পক্ষের মধ্যস্থতা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মানবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কীভাবে মধ্যস্থতার দায় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপরে চাপিয়ে দেব? এটা ততখানি সরল হবে না।’’ কিন্তু বিচারপতি বোড়দে বলেছিলেন, ‘‘যখন এক পক্ষ একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে, তা আদালতের লড়াই হোক বা মধ্যস্থতা, তা মানতেই হবে।’’ আপাতত আগামী মাসদুয়েক অপেক্ষা করতে হবে, দীর্ঘকালের অযোধ্যা বিবাদ নিষ্পত্তি হয় কি না তা দেখতে।