মুখরোচক ‘নারীবাদ’র বয়ান দিয়ে কিভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে টাকা কামাচ্ছে তা আমরা ভেবে দেখিনা। নারী দিবস নিয়ে নানান রকম বক্তব্য ও উম্মাদনার বাইরে এই নিবন্ধটি আমাদের নতুন করে ভাবনার দুয়ার খুলে দিবে। এ নিয়ে আল জাজিরা’য় কলাম লিখেছেন নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ক্যাথরিন রটেনবার্গ। লেখাটি জবান’র জন্য অনুবাদ করেছেন, মাইনুদ্দিন সেজান।
কিছুদিন আগে আমি আমার ছেলের স্কুল থেকে একটি মেসেজ পেলাম। শুক্রবারে স্কুলটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। মেসেজটিতে বলা হয়েছে, ইভেন্টটিকে স্মরণীয় করে রাখতে স্কুলটি ‘নারীবাদী সুয়েটার’ বিক্রির আয়োজন করেছে। সুয়েটারগুলো বিশেষ ছাড়ে ১০ পাউন্ডে (১৩ ডলারে) পাওয়া যাচ্ছে। দয়া করে আপনার মেয়ে বা ছেলেকে ১০ পাউন্ড সাথে করে নিয়ে আসতে বলবেন, যদি সে এই সুয়েটার পরিধান করতে চায়’।
কয়েক ঘন্টা পর আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসের টি-শার্টগুলো’তো ওল্ড-ফ্যাশন্ড হয়ে গেছে! ‘ছাড়ে পাওয়া যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সেক্স টয়’ এমন একটি লিংক পাঠিয়ে বলল, এইসব পণ্যের জায়গায় স্থান দখল করে নিচ্ছে ‘সেক্স টয়’।
কৌতুকের বিষয় হচ্ছে ১৯০৮ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি কর্তৃক নারী গার্মেন্টস কর্মীদের ধর্মঘটকে সম্মান জানানোর একটা পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস যাত্রা শুরু করে। যেটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসে নারী কর্মীদের সবচেয়ে বড় শ্রম আন্দোলন । পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে এভাবে নারীদের জন্য একটি দিন উৎসর্গ করা, যে দিনটাতে নারীরা উত্তম কর্ম পরিবেশ ও উপযুক্ত মজুরির দাবি তুলেছিল।
এটা সত্য যে বিংশ শতাব্দীর পথ পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু দেশে কিছু কিছু পরিবেশে এটি কেবল একটি দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। এটি নারী কর্মীদের ভোট ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে শুরু করে, যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ এবং সাম্প্রতিক সময়ে লিঙ্গ-সমতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে নারীদের যোগদানের অনুঘটক হিসেবেও কাজ করেছে।
প্রতীকি বা লোক দেখানো কিছু উদযাপন (টোকেনিজম) করার মাঝে অবশ্যই কিছু সমস্যা আছে। বছরের একটি দিনে আমরা কি নারীদের গুণগান গাইব না লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদ করব।
প্রতীকি বা লোক দেখানো কিছু উদযাপন (টোকেনিজম) করার মাঝে অবশ্যই কিছু সমস্যা আছে। বছরের একটি দিনে আমরা কি নারীদের গুণগান গাইব না লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদ করব। তবে বিগত কিছু বছরে বিশেষ করে ট্রাম্পের রাজনীতি এবং ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কার্যকারিতা ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ২০১৬ সাল থেকে ৮ই মার্চের সংগঠিত আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আরও বেশি আক্রমণাত্বক ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু স্পেনের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, লিঙ্গ অসমতা ও যৌনবৈষম্যের প্রতিবাদে গত বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রে ‘৯৯% নারী অধিকার আন্দোলন’ (ফেমিনিজিম ফর দ্য নাইন্টি নাইন পারসেন্ট) তো নারী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
সমতা বা ন্যাযতার ব্যানারে তাদের প্রতিবাদ কর্মসুচিগুলো হলেও তারা লৈঙ্গিক, বর্ণগত, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং জলবায়ু নিয়েও আলাপ করছে। তারা মনে করে এই বিষয়গুলো একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমার ছেলের স্কুলের ম্যাসেজ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সেক্স টয়, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আক্রমণাত্মক গতিপথের পাশাপাশি এখানে আরেকটি জিনিসের সমান্তরাল উন্নয়ন ঘটেছে। সেটি হচ্ছে, ৮ই মার্চের পণ্যায়ন ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা এর ব্রান্ডিং।
পণ্ডিতগণ এটাকে বলেন ‘ব্র্যান্ড অ্যাকটিভিজম’। যে অ্যাকটিভিজমে কর্পোরেটগুলো তাদের জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেইনে কিছু জনপ্রিয় ও প্রগতিশীল ইস্যু ব্যবহার করে তাদের সুনাম বাড়ানোর চেষ্টা চালায়। এমন একটি উদাহরণ হচ্ছে, ‘নেট এ পর্টার’র মালিক যিনি ছয়জন নারী ডিজাইনারের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের টি শার্টের একটি এক্সক্লুসিভ কালেকশন প্রতিষ্ঠা করেন । যদিও এটা সত্য যে, এসব অর্থ যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া নারীদের সহযোগিতায় ব্যয় করা হয়। তবুও অ্যাকটিভিজম এবং নারী ক্ষমতায়ন সমানতালে ‘ইউ গো গার্ল’ লেখা সম্বলিত দামী টি-শার্ট বিক্রির মাধ্যমে হচ্ছে। নারীরা তাদের সংহতি প্রকাশ করছে সংগ্রাম বা প্রতিবাদের মাধ্যমে নয় বরং কেনাকাটা করার মাধ্যমে। এই কর্পোরেট মনোভাব একটি বিশাল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অংশ— তথা নয়া উদার নারীবাদের (নিও লিবারেল ফেমিনিজম) উত্থান ঘটিয়েছে।
নিওলিবারেল ফেমিনিজম হচ্ছে মুখরোচক ও বাজারজাতযোগ্য। কারণ এটা হুমকিমূলক নারীবাদ নয়। এটা বিধ্বংসী নয়া উদার পুঁজিবাদ (নিও লিবারেল ক্যাপিটালিজম), নয়া সাম্রাজ্যবাদ (নিও ইম্পিরিয়ালিজম), পদ্ধতিতগত নারিবিদ্বেষ ও যৌনতাকে এড্রেস করে না। তাই এই নারীবাদ সহজে মেনে নেওয়া যায় এবং বাজারে খুব খায়।
এই ধারার নারীবাদ নারীদের তাদের নিজেদের জন্য এবং নিজস্ব আকাঙ্খা পূরনে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতা তৈরিতে এক ধরণের উদ্দীপনা দেয়। এই নারীবাদ স্বীকার করে লৈঙ্গিক মজুরি বৈষম্য ও যৌন হয়রানি চলমান অসমতার আলামতস্বরূপ। এসবের কাঠামোগত ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে চ্যালেঞ্জ না করে তারা সমাধান হিসেবে বলে নারীর ভাল-মন্দ দেখভালের দায়িত্ব যেন নারী নিজেই নিয়ে নেয়।
নিওলিবারেল ফেমিনিজম হচ্ছে মুখরোচক ও বাজারজাতযোগ্য। কারণ এটা হুমকিমূলক নারীবাদ নয়। এটা বিধ্বংসী নয়া উদার পুঁজিবাদ (নিও লিবারেল ক্যাপিটালিজম), নয়া সাম্রাজ্যবাদ (নিও ইম্পিরিয়ালিজম), পদ্ধতিতগত নারিবিদ্বেষ ও যৌনতাকে এড্রেস করে না। তাই এই নারীবাদ সহজে মেনে নেওয়া যায় এবং বাজারে খুব খায়। এই নারীবাদ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হওয়া নারী ধর্মঘটের ঠিক উল্টো শিক্ষাটা বহন করে।
তদুপরি, এই মুখরোচক নারীবাদের উত্থানের কারণে, এটা বোঝা খুব বেশি কঠিন নয় যে, কেন হঠাৎ করে সিনেমা তারকা এমা ওয়াটসন থেকে শুরু করে কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো পর্যন্ত সবাই নারিবাদী পরিচয় দিতে আগ্রহী হয়ে উঠল। এটাও বোঝা কঠিন নয়, কেন এই নারীবাদ আজকাল খুব ভাল ব্যবসা করছে। এ ধরনের নারীবাদের জনপ্রিয়তা বা সব জায়গা জুড়ে এর বিস্তৃতি সবসময়ই খারাপ বিষয় নয়। কিন্তু এটা জানা খুব জরুরি যে, কি ধরণের নারীবাদ জনপ্রিয় হয়েছে এবং কেন হয়েছে। মৌলিকত্ব হারানো এবং অকার্যকর একটি নারীবাদী শিক্ষা না পারবে পুরুষতন্ত্রকে উৎখাত করতে, না পারবে জীবনের প্রতি হুমকিগুলোর সমাধান দিতে। আমাদের হাতে এখন দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি আছে। এক. আমাদের আছে জনপ্রিয় ব্যবসাবান্ধব নারীবাদ, যা নিওলিবারেলিজমের দাসত্ব করে। অপরদিকে আছে, ব্যাপক সংখ্যক নারীবাদীদের অংশগ্রহণমূলক একটি উঠতি আন্দোলন, যেটা সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আলিসিয়া গার্জা, যিনি ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’র সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং লিন্দা সারসর, যিনি ২০১৭ সালের ‘উইমেন মার্চ’ ‘ডে উইদাউট এ ওমেন’ ২০১৯ সালের ‘উইমেন মার্চ’ পরিচালনা করেছেন, নেতৃতে এই ধরনের গণভিত্তিক আন্দোলন সাড়া পাচ্ছে। তাদের নারীবাদ হুমকিমূলক, কারণ এটি অত্যাচারের বিভক্তিমূলক পদ্ধতি- ইসলামফোবিয়ার মধ্য দিয়ে সাদাদের আধিপত্য থেকে শুরু করে নারীবিদ্বেষ এবং নিও লিবারেল ক্যাপিটালিজমকে চ্যালেঞ্জ করছে। এই নারীগণ বৈপ্লবিক উদ্দীপনা ধারণ করে, যা এক শতাব্দী আগে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা করে।
কোন নারীবাদের জিত হবে, এটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে। আমি আমার সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিয়েছি। আমি আমার দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে বৈশ্বিক নারী ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করব।