প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা

প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা

কলকাতা বইমেলা ২০১৯ উপলক্ষে ‘দেশ’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় কলকাতার খ্যাতিমান লেখকদের প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। জবান’র পাঠকদের জন্য জনপ্রিয় ৪ জন লেখকের প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা হল :


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

প্রথম বই প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ তো সকলেরই থাকে। বই প্রকাশ পাওয়া মানে নিজেকে প্রকাশ্যে উপস্থাপিত করা। পাঠক কীভাবে নেবেন, আদৌ গ্রহণ করবেন কি না, সে বিষয়ে একটা কৌতূহল তো থেকেই যায়। এই বিষয়গুলো আমার মধ্যেও ছিল, তবে সেটা এমন কিছু বেশি টানটান উত্তেজনাও নয়। ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার পুজোসংখ্যায় আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ বেরোয়। এর মাসখানেক পর নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এটা বলতে গেলে একটা নিয়মের মতোই ছিল। পূজোসংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাসগুলো পরে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই আকারে প্রকাশিত হত। সেভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল পাতলা একটা বই, প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমার বন্ধুস্থানীয় পূর্ণেন্দু পত্রী। প্রকাশিত হওয়ার পর বইটা আমি উলটে-পালটে দেখেছি, কিন্তু আর পড়া হয়ে ওঠেনি। প্রথম এডিশনের বইটা অবশ্য এখন আর নেইও আমার কাছে! তখন মেসে থাকতাম, কবে যে সেটা হারিয়ে গিয়েছে বা কাউকে পড়তে দিয়ে আর ফেরত নেওয়া হয়নি, তা এখন আর মনেও নেই! আমার প্রথম কেন, প্রথম বেশ কয়েকটি বই-ই সাফল্য পায়নি। প্রথম বইটা নিয়ে আমার অনেক আশা ছিল, কিন্তু বই তেমন বিক্রি হত না, খুব একটা প্রশংসাও পাইনি কারও কাছ থেকে। আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর সেই আক্ষেপ আর নেই। কারণ, ‘ঘুণপোকা’ এখন পাঠকমহলে গৃহীত হয়েছে। মানুষ বইটা কেনেন, বছরে প্রায় একটা করে এডিশন বিক্রি হয়। এটা একটা বড় সৌভাগ্যের কথা বলা যেতে পারে।

জয় গোস্বামী

আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগের এক জানুয়ারি মাসে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির  নাম ছিল ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’। এটাকে আসলে সেভাবে দেখলে সেভাবে দেখলে বই বা গ্রন্থ কোনওটিই বোধ হয় বলা যায় না, বরং একে পুস্তিকাই বলা চলে। এই বইটিতে সাতটি সনেট এবং আরও একটি কবিতা— ছাপিয়েছিলাম। মোট আটটি কবিতা ছিল। সম্পূর্ণ বইটিই আমি আমার নিজের অর্থে কৃষ্ণনগরের একটি প্রেস থেকে ছাপিয়েছিলাম। মোট দু’শো কপি ছাপানো হয়েছিল। বইটি মুদ্রণ ও প্রকাশ করতে সেইসময় খরচ হয়েছিল একশো পয়ঁতাল্লিশ টাকা। এই বই মূদ্রণের সম্পূর্ণ খরচ, অর্থাৎ ওই একশো পয়তাল্লিশ টাকা, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। এখনও মনে আছে, আমার প্রথম সেই বইয়ের দাম ছিল এক টাকা, বিয়াল্লিশ বছর আগে বইটি প্রকাশিত হলেও, মাঝে মাঝে আমি বিভিন্ন জায়গায় এখনও ওই বইটির উল্লেখ পাই। কখনও কারও-কারও লেখাতেও দেখেছি এই বইয়ের কথা। এমনকি, পাঠকেরা এখনও বইটির কথা বলে থাকেন। অথচ বইটি আটটি কবিতা নিয়ে লেখা এবং মাত্র বারো পাতার এত ছোট একখানা বই। আমার অবাক লাগে এটা ভেবেই যে, পঠকদের এখনও সেই বাইয়ের কথা মনে আছে!

সুবোধ সরকার

আমি তখন কৃষ্ণনগরে, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। পাড়ায়-পাড়ায় গান শিখিয়ে কলেজে পড়াশোনা করছি আর বদ্ধ উন্মাদের মতো কবিতা নিয়ে ডুবে আছি। সেই সময় আমার প্রথম পাণ্ডুলিপি তৈরি হল। ছোট একটি বই, আটচল্লিশ পাতার। সেই পাণ্ডুলিপির নাম দিলাম, একবারে যে-সালে কবিতাগুলো লেখা সেই সাল নিয়ে ‘কবিতা ৭৮-৮০’। বই প্রকাশ করব বলে ভাবনাচিন্তা করলেও, বই প্রকাশ সম্পর্কিত কোনও অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না। তখন কৃষ্ণনগরে একটা বাচ্চা মেয়েকে গান শেখাতাম। একদিন আমার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ছাত্রীর মা প্রশ্ন করাতে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেই রিনাদিকে (ছাত্রীর মা) আমার কবিতার বই প্রকাশ করার ইচ্ছেটুকু জানালাম। সবটুকু শুনে পরের দিন উনি তাঁর দুটো সোনার বালা আমাকে দিয়েছিলেন, যাতে সেটা বিক্রি করে বই প্রকাশের টাকাটুকু জোগাড় করতে পারি। কিন্তু বন্ধুদের কথা শুনে আর সোনার দোকানে যাইনি, বালাদুটো আমার কাছে বেশ অনেকদিনই ছিল। তারপর আমি আমার ছোড়দিকে আমার বই প্রকাশের ইচ্ছেটুকু জানালাম, সবটা শুনে দিদি বললেন, “আচ্ছা তুই দাঁড়া, আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করতে পারি।” তখন আমি প্রকাশক খুঁজতে লাগলাম। গেলাম কৃষ্ণনগর চার্চ-সংলগ্ন কৃষ্ণনগর চার্চ মিশন প্রেস থেকে কবিতার বই প্রকাশ করব শুনে ওঁরা বেশ অবাকই হলেন, কাকুতি-মিনতি করে বললাম, “আমিতো কাউকে চিনি না, আর এই চার্চের মাঠেই আমরা গল্প করি, আড্ডা মারি, যিশুর পায়ের কাছেই আছি।” যাই হোক, যিশুর পায়ের কাছে আছি শুনে বেশ মায়া-দয়া হল কি না জানি না, বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা রেখে যেতে বলেছিলেন। তারপর ওঁরাই ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধু কভার পেজটি করে দিয়েছিল।

শ্রীজাত

আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। তখন প্রথম আলো বলে একটা পত্রিকা বের হত, যেটা করতেন বীথি চট্রোপাধ্যায় ও তরুণ চট্রোপাধ্যায়। তাঁরা মূলত কবিতারই লোক। একবার তারা ঠিক করলেন যে, বইমেলায় একশোজন তরুণ কবির এক ফরমার মানে ষোলো পাতার একটি বই বের করবেন। আমার সঙ্গে সেই সময় কারওই তেমন যোগাযোগ নেই, তখন আমাকে ফোন করেন কবি জয় গোম্বামী। বলেন “এই রকম একটা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, আমাকেও ওঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, কাদের লেখা নেওয়া যায় বই হিসেবে। তুমি যদি একটা এক ফর্মার পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দাও…” কথাটা শুনেই খুব দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম, প্রথমেই নাই বলেছিলাম। বলেছিলাম  যে এখন আমি নিজের বই প্রকাশের জন্য প্রস্তুত নই। বেশ বকুনি দিয়েই বললেন, “দেখো, তোমাদের অনেক সৌভাগ্য যে অন্য লোকে চাইছেন। আমরা যখন লিখতে এসেছিলাম তখন কিন্তু নিজেদের বই কিন্তু নিজেদেরই বের করতে হয়েছিল, এরপরও যদি তুমি না পারো সেটা তোমার ব্যাপার!” তখন আমি ভয় পেয়ে এক ফর্মার একটি পা-ুলিপি জমা দেই। প্রথম আলো থেকে বইটা প্রকাশ পায়, নাম ছিল ‘শেষ চিঠি’। আমি ধরেই নিয়েছিলাম ওটাই আমার শেষ বই, আর আমরা যারা এখন লেখালেখি করছি তাদের অনেকের বই-ই কিন্তু ওই সময়ে বেরিয়েছিল। একটা বা দুটো সংস্করণ হয়েছিল বইটার। এখন তো আর আলাদাভাবে পাওয়া যায় না, ‘কবিতাসমগ্র-র প্রথম খণ্ডে পাওয়া যায় সেই ‘শেষ চিঠি’।