টেক আ বাউ, আয়াক্স

টেক আ বাউ, আয়াক্স

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে হাজির হয়েছিলো তার সৌন্দ্যর্য্যের সকল পসরা নিয়ে। অনুনমেয়তা বরাবরই এ আসরটির অন্যতম আকর্ষণ। তবে, গেল ক’বছরে সেটি যেন হালকা ফিকে হতে বসেছিলো আর্থিক দাপটে। সে দাপট চূর্ণ করে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সোলারির দলকে হালি হজম করিয়ে বের করে দিয়েছে অদম্য আয়াক্স।

গেল তিনবারসহ রেকর্ড তেরোবারের চ্যাম্পিয়নদের বিদায়ের ধাক্কার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে আয়াক্স’র উত্থান নিয়ে। জেনে বিস্মিত হবেন যে আয়াক্স এর মূল দল, রিজার্ভ এবং যুবদলের পেছনে মোট যা খরচ হয় এক বেলের পিছনেই তারচেয়ে বেশি খরচ করে রিয়াল। সে বেলকে বস্তাবন্দি করে যে খেলাটা আয়াক্স দেখালো তা লা জাওয়াব। এ তরুণ দলটি স্বপ্ন দেখাচ্ছে আয়াক্সের সোনালি সময় ফিরিয়ে আনার।

আয়াক্সের বেশিভাগ খেলোয়াড়ের বয়সই ২৫ এর মধ্যে। একদম ফ্রেশ ব্লাডে ভরপুর। মৌসুমের শুরু থেকেই দলটি আলোচনায় ছিল। কিন্তু, পেশীশক্তির এ যুগে এমন দল কতটা কি করতে পারে তা নিয়েও বিস্তর সংশয় ছিলো। সেটাকে কি মুগ্ধকরভাবেই না উড়িয়ে দিলো এরিক ট্যান হাগের শিষ্যরা। দলীয় নৈপুণ্য, চোখ ধাধানো স্কিল, মনে দাগ কাটার মত ফিনিশিং কি ছিলো না আয়াক্সের খেলায়? বিশেষ করে রিয়াল স্বপ্ন শেষ করে দেয়া তৃতীয় এবং চতুর্থ গোল দুটো ছিল চোখে লেগে থাকার মত।

আয়াক্সের উত্থানের সাথে সাথে রিয়ালের অস্বাভাবিক পতনও আলাদা মনোযগের দাবি রাখে। সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। পরপর তিন ম্যাচে তিনটি টুর্নামেন্টের শিরোপার দৌড় থেকে ছিটকে পরেছে সোলারির দল। বিষয়টা বিস্ময়কর। হ্যাঁ, রিয়াল মৌসুমের শুরুতেই রোনালদো এবং জিদানকে হারিয়েছে। এটি মাথায় রেখেই ফলটিকে বিস্ময়কর বলা হচ্ছে। ক্ষুদ্ধ ভক্তদের সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়েছে রিয়াল কর্তা পেরেজের উপর। মাতম হচ্ছে রোনালদোর না থাকা নিয়েও। এ দুটো বিষয়ও মনোযগের দাবি করে।

পেরেজের দায় 

রিয়ালের এ পরাজয়ের পর সমর্থকদের ক্ষোভের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে প্রবল প্রতাপশালী পেরেজ। রোনালদোর সাথে দ্বন্দ্বের জেরে রোনালদোর ক্লাব ত্যাগ এবং সেটির প্রতিক্রিয়ায় জিদানেরও ক্লাব ত্যাগের ফলে সমর্থকদের পুরো ক্ষোভ তার উপর। বিষয়টি স্বাভাবিকও বটে। প্রায় দশক ধরে যার কাঁধের উপর সাওয়ার হয়ে ছুটেছে রিয়াল তার বিদায়ের জন্য যাকে সরাসরি দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন খোদ রোনালদোই তাকে নিয়ে ক্ষুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। রোনালদোকে হারালে জিদানকে হারাতে হতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকার পরেও রোনালদোকে না আটকানো এবং তার জেরে জিদানকে হারানোরও বড় খেসারত দিতে হয়েছে দলকে। বিষয়টা হচ্ছে, রোনালদো থাকলে এমন হতোই না, জিদান থাকলেও এমন হতো না; এটা শুধুই অনুমান। গেলো মৌসুমে জিদানের অধিনেও রিয়াল ধুকেছে, এটা নিরেট সত্য। ক্লাসিকো বিপর্যয়ের পর তার থাকা না থাকাই তো পড়ে গিয়েছিলো প্রশ্নের মুখে। বিপর্যয় ঘটলে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে তার উপর ঝাল মেটানো একটি স্বাভাবিক মনোঃবৃত্তি, সেটি প্রকাশের জন্য পেরেজের চেয়ে ভালো বোধহয় কেউ নেই। তিনি একটি জুয়া খেলেছিলেন, সেটি কাজে আসেনি। রোনালদোর সাথে তিক্ততার দায় পুরোপুরি পেরেজের উপরে চাপালে সেটিও অন্যায্য হবে যদি আপনি গত কয়েক মাসের ঘটনা প্রবাহ দেখে থাকেন। তবে, একটি দায় পেরেজ কোনো ক্রমেই এড়াতে পারেন না। রোনালদোর বিদায়ের পর রিয়ালে একজন স্কোরারের অভাব প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিলো। সেটি পূরণের জন্য যার উপর ভরসা করার কথা প্রাথমিকভাবে ভাবা হয়েছিলো সে বেল যে এ জোয়ালা বইবার যোগ্য না তা মৌসুমের শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। মূল স্ট্রাইকার বেনজেমা প্রথাগত স্ট্রাইকার’র ভূমিকা ভুলে বসে আছেন মেলা আগেই। এমন অবস্থাতেও পুরো জানুয়ারি অলস সময় কাটিয়েছেন পেরেজ। মেসি থাকাবস্থাতেই বার্সা যখন তার বিকল্প হিসাবে একের পর এক বড় বিনিয়োগ করছে তখন পেরেজ নেইমারে মজে বর্তমানকে ভুলে বসে আছেন। যার চূড়ান্ত খেসারত দিতে হলো আয়াক্সের বিপক্ষে ম্যাচে।

সমস্যা সবখানেই

রিয়ালের দায়িত্ব নেয়ার পরে মনে হচ্ছিলো সোলারি রিয়ালকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিচ্ছেন। মার্সেলোর বদলে রেগুলন, বেলের বদলে ভাস্কুয়েজ, ইস্কোর বদলে ভিনিসিয়াসকে খেলানো এবং কয়েক ম্যাচ’র সাফল্য সেটাই ইঙ্গিত করছিলো। তবে, সোলারির বাধা সুতোগুলো যে কতটা আলগা তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে শেষ ক’ম্যাচেই। ক্লাসিকোতে বার্সা বধের ফর্মুলা তো বের করতে পারেনই নি, বরং বার্সার সাথে হারে হতবুদ্ধ হয়ে হারিয়ে ফেলেছেন রাস্তাই। সোলারি প্রতিভা পরখ করতে জানেন কিন্তু তাদের নারিশ করার মত যথেষ্ট যোগ্য কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রিয়ালের রক্ষণ যে কতটা উদাম তা তো শেষ ম্যাচেই স্পষ্ট। আক্রমণও যে কতটা ভোতা তাও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। আলোচনার কেন্দ্রতেও এ দুটো ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু মাঝ মাঠের অবস্থাও যে নাজুক সেটি বোধহয় সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন সমালোচকরা। ক্লাসিকোর পর রিয়ালের সাবেক কোচ বার্নার্ড স্যুস্টার সমালোচনা করেছিলেন ক্রুস’র, সেটির জওয়াবও ক্রুস দিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমে। বাস্তবতা হচ্ছে, সুস্টার সঠিক ছিলেন। গত ম্যাচের নব্বই মিনিট ক্রুস ঠিক কি করেছেন তিনিই জানেন। না তিনি ডেস্ট্রয়ার, না তিনি ডিস্ট্রিবিউটর। গতিও নেই আগের মতন। এবং চলনের আলসে ভাবও স্পষ্ট। কাসেমিরোর চেয়ে এ মৌসুমে ভালভার্দের পারফর্ম্যান্স ভালো। বড় ম্যাচে কাসেমিরোকে কেমন যেন জড়াগ্রস্ত মনে হচ্ছে। আক্রমণের অবস্থার সুনিপুণ এক বিজ্ঞাপন যেন গেলো ম্যাচে দেখালেন বেনজেমা। সামনে গোলরক্ষক একা, দুরত্ব এতই কম যে, শুধু পা ছোয়ালেই গোল; এমন অবস্থায় তার সটান শুয়ে পড়াকে প্রতিকী ধরা যায়। একজন দু’জন না, পুরো দলটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে রিয়ালকে।

লাগবে দক্ষ কান্ডারি

এ ম্যাচে আরো একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সোলারিকে নিয়ে। রিয়ালের ড্রেসিংরুম সামলানোর মত যথেষ্ঠ দক্ষতা তার রয়েছে কি না? ট্যাক্টিস’র বিষয়টার বাইরে রামোস কাহিনীর জন্য এ প্রশ্নটি উঠছে। আগের লেগে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে সেটিকেই যথেষ্ঠ মনে করে রামোসের কার্ড খাওয়ার বিষয়টা তো ইতোমধ্যেই সমালোচিত। আয়াক্সকে তুচ্ছজ্ঞান করতে গিয়ে এবার তল্পিতল্পা সমেত বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। প্রশ্নটা হচ্ছে রামোস কি স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজটি করেছিলেন? যদি তা করে থাকেন সোলারি পরবর্তীতে কি ভূমিকা নিয়েছিলেন? আর যদি এটা দলগত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে বলতেই হবে সোলারির পরিপক্কতা আসেনি।

তাতেও কমবে না আয়াক্সের কৃতিত্ব 

রিয়ালের ভুলগুলো যতই সামনে আনা হোক, তাতে বিন্দুমাত্র ম্লান হবে না আয়াক্সের কৃতিত্ব। যে মানের ফুটবল তারা খেলেছে তাতে ‘টুপি খোলা’ সম্মানই প্রাপ্য। ঝড়ো কাউন্টারের পয়লা গোলটা ছিল নিখুঁত ফিনিশিং এর এক অনুপম নিদর্শন। পরেরটি কি বলা যায়? টাডিচ’র চোখ জুড়ানো স্কিল, সেটিকে বৃথা যেতে না দিয়ে নারেশের মুগ্ধকর ফিনিশিং। দুটো গোলেই নিজেদের মান জানিয়ে দিয়েছিলো আয়াক্সের তারুণ্য নির্ভর দলটি। যাকে সুতোয় গেথে রাখছিলেন টাডিচ। তৃতীয় গোলটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা নিয়ে এখন আর কে ভাববে? দুটো গোলের নেপথ্য কারিগর টাডিচ যে ফিনিশিংটি দিয়েছেন তাতেই গোলটি আয়াক্সে দিয়ে দেয়া যায়। আর শেষ গোলটি থেকে অনেকেই শিক্ষা নিতে পারেন যে, ফ্রি কিক কি করে নিতে হয়। দূরুহ একটি কোণা থেকে সাড়ে ছ’ফুট কর্তোয়াকে বোকা বানিয়ে যে গোলটি শোনে করেছেন তা ফুটবল প্রেমিদের মনে থাকবে অনেকদিন। এমন গোল দেখেও সুখ। আয়াক্সের শ্যুটিংয়ের কোনো জওয়াবই যে কর্তোয়ার কাছে ছিলো না তা তার রেটিং এই স্পষ্ট, ৩.৭!

সব শেষে বলা যায় রাতটি ফুটবলের। অর্থের ঝনঝনানিই যে এখনো ফুটবলের শেষ কথা না সেটিই প্রমাণ করলো নারেশ, জিয়েখ, ডে লিটরা। এমন একটি কর্মের জন্য একটি বাউ পেতেই পারেন তারা।