এবারের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘গ্রীনবুক’ যা দেখালো

এবারের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘গ্রীনবুক’ যা দেখালো

গ্রীনবুক সিনেমার একটা বাস্তব ও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। মূলত গ্রীনবুক নামে একটি ছোট বই ছিল, ষাটের দশকে আমেরিকায় কালোদের ভ্রমণের জন্য ব্যবহারিত একটা গাইড বই। এটা প্রণয়ন করা হয়েছিল কালোদের জন্য। যেটাতে কোন কোন এলাকায় কোন কোন হোটেলে, রেস্তোরাঁয় কৃষাঙ্গদের প্রবেশ ও খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ আছে সেটা উল্লেখ থাকতো। এটাকে আমেরিকায় কালোদের ভ্রমণ গাইডও বলা যায়।

সম্প্রতি অস্কার পাওয়া সিনেমা ‘গ্রীনবুক’। আসলে কি লিখা যায় এমন একটা মুভি নিয়ে, কীভাবে এটার তারিফ করা যায় সেটা ভেবে কুল পাচ্ছিনা। প্রথমেই বলেছি এটা একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা। সিনেমাটিকে একটু স্লো বলা যায় কিন্তু অসাধারণ।  নির্মাণশৈলী প্রায় পারফেক্ট। প্রতিটি দৃশ্য যে মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে বাস্তবতা ও নান্দনিকতার একটা যৌথ সম্মিলন ভাল মতই ঘটেছে। এক একটা ফ্রেইম যেন চিত্রকর্ম। ক্যামেরার কাজের প্রসংশা করতে হয়। অভিনয় ছিল বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য খুবই পরিমিত। মানে ওভার অ্যাক্টিং ছিল না। অস্কারের জন্য এমন ছবি বিবেচনায় নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও কোন তর্ক নাই। তবে সিনেমা শুধু এই সবই না। আছে গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকও। সেটা একটু বলেই লেখা শেষ করব।

আমাদের মনোজগতের অনেক দিক এতে পরিস্কার ধরা পড়েছে। সিনেমার বড় একটা শিক্ষা হল, নৈতিকতা, ভদ্রতা এগুলো গায়ের রং দিয়ে বিচার করার বিষয় নয়। কালো চামড়ার একজনও আভিজাত্যে সাদাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে। সাদাদের পোষাকি ভদ্রতা কলোরা নকল না করে বরং প্রকৃতভাবে মানবিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করতে পারে। এই ছবিতে যেটা দেখা গেছে।

 

সিনেমার গল্পটা এগিয়েছে মূলত আমেরিকায় রেসিজম বা বর্ণবাদ নিষিদ্ধ হওয়ার পরবর্তী সময়ে মানে ১৯৬২ সালের একজন ব্ল্যাক পিয়ানোবাদক ড. শার্লি এবং তার দেহরক্ষী কাম ড্রাইভার ইতালিয়ান-আমেরিকান টনি লিপ’র মাঝে তৈরি হওয়া বন্ধুত্ব এবং ভ্রমণের গল্প বলতে বলতে। ছবির মূল প্রাণ টনি লিপ (ভিগো মর্টেনসেন) এবং ড. শার্লি (মাহেশারা আলি) এই দু’জন। পুরো সিনেমায় এই দুইজনের কথোপকথনটা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ডায়লগের ভেতরেই ধরা পরেছে কমেডি, ইমোশন, ভালোবাসা, বিরহ সবকিছু। ড. শার্লি একটা ক্যাসেট কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমেরিকায় ট্যুর করতে বের হয়, তখনো আমেরিকা থেকে কেবল আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে বর্ণপ্রথা কিন্তু মানুষের মন ও মগজে লেগে আছে সেই বর্ণবিদ্বেষ। কালোদের জন্য তখনো অনিরাপদ আমেরিকায় ভ্রমণ। এই ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়াতেই শার্লি নিযুক্ত করে টনি লিপকে। দুই সন্তানের জনক টনি তখন বার বন্ধ থাকায় চাকরির জন্য এদিক ওদিক ছুটছিলো। টনি মানুষটা কথা বার্তায় বেশ সহজ সরল প্রাণবন্ত কিন্তু তার ভেতরেও ছিল কালোদের প্রতি হীনমন্যতা। যে কালোদের প্রতি তার এমন হীনমন্যতা সেই কালোদের একজনের বডিগার্ড হওয়ার প্রস্তাবে প্রথমে টনি রাজি হয় না, পরবর্তীতে টাকার প্রয়োজনে সে কাজে যোগ দেয়। পরস্পরের বিপরীত মনন ও রং’র এই দুই মানুষের জার্নিটা কেমন ছিল সেটা জানতে আপনাদের অবশ্যই সিনেমাটা দেখতে হবে। আমি শুধু এইটুকু বলি, এই ছবিতে টনি আর শার্লির মধ্যকার প্রতিটা সংলাপ, তাদের দু’জনের অভিনয়, চেহেরার এক্সপ্রেশন, ডায়লগ ডেলিভারি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সব অসাধারণ লেগেছে। বিশেষত টনি ক্যারেক্টারটা এতোটা পার্ফেক্ট ছিল যে আপনার ইচ্ছে করবে মুভি দেখতে দেখতে লোকটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে, এতোটা নিখুঁত ও জীবন্ত অভিনয়।

‘গ্রীনবুক’র একটি দৃশ্যে মাহেশারা ও ভিগো

এসব ছাড়া এই সিনেমায় যে দিকটা বেশি ভালো লেগেছে সেটা হলো, তৎকালীন বর্ণবাদী আমেরিকান সমাজটাকে একদম হুবহু প্রেজেন্ট করছে। কোন ভনিতা ছিল না, বর্তমান দুনিয়াকে প্রগতিশীলতার ছবক দেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেওয়া এই সাদা জাতটা এই নিকট অতীতে ষাটের দশকেও কি পরিমাণ জুলুম, অবিচার কালোদের উপরে করেছে সেটার নিন্দার ভাষা নেই। এই ব্যাপারগুলো বেশ ভালোভাবে এসেছে পর্দায়। তবে সিনেমার একদম শেষ দৃশ্যে টনি লিপ’র স্ত্রী যখন ব্ল্যাক ম্যান শার্লিকে জড়িয়ে ধরে, যে আবেগ দিয়ে সে জড়িয়ে ধরেছিলো,তার চোখের যে ভাষা তখন পর্দায় দেখলাম, আমার মনে হলো সেটার জন্য কয়েকশত অন্যায় মাফ করে দেওয়া যায়। তবে কালো পিয়ানোবাদক যে নৈতিকতা দেখিয়েছে তা সাদাদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। ভ্রমণের সময় বিরতিতে একটা দোকানে গিয়ে সাদা চরিত্র টনি একটা খেলনা পাথর পকেটে পুরে নেয়। গাড়িতে বসে এটা দেখে ড. শার্লি সেটা ফেরত দিতে বলেন। অনেক তর্ক হয়। এবং টনি এটা ফেরত দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু টনি মূল চরিত্র না হলেও তাকে যেভাবে গরুত্ব দেয়া হয়েছে তাতে সাদাদের প্রধান্যটা ভাল চোখে পড়েছে। এতোটা গুরুত্ব সম্ভবত দর্শকদের খুশি করতেই দেয়া হয়েছে। কালো হওয়ার পরেও ড. শার্লিকে তার মেধার জন্য সম্মান ও গায়ের রংয়ের জন্য যে নির্যাতন সহ্য করতে হয় তা সত্যি হৃদয় বিদারক। আমেরিকাতে এখন আবার নতুন করে বর্ণবাদ দেখা দিয়েছে। এমন সময়ে এই সিনেমাটি সত্যি দরকার ছিল। আমাদের মনোজগতের অনেক দিক এতে পরিস্কার ধরা পড়েছে। সিনেমার বড় একটা শিক্ষা হল, নৈতিকতা, ভদ্রতা এগুলো গায়ের রং দিয়ে বিচার করার বিষয় নয়। কালো চামড়ার একজনও আভিজাত্যে সাদাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে। সাদাদের পোষাকি ভদ্রতা কলোরা নকল না করে বরং প্রকৃতভাবে মানবিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করতে পারে। এই ছবিতে যেটা দেখা গেছে।

তাছাড়া সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমাটোগ্রাফি, ডিরেকশন সব অনবদ্য ছিল। আমার আফসোস থাকবে টনি লিপ মানে ভিগো মর্টেনসেন অস্কার না পাওয়ার জন্য। এই মুভি দেখার পর আমার বারেবারে মনে হয়েছে অস্কারটা রামি মালিক এবং ভিগো দুইজনকে ভাগাভাগি করেও দেওয়া যেতো।