- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী পাঁচজনের চারজনই স্পিনার
- বিশটির বেশি টেস্ট খেলেছেন মাত্র চারজন পেসার
- শেষ ম্যাচে দলে থাকা তিন পেসারের মিলিত অভিজ্ঞতা ছিল চার ম্যাচ!
- এখনো একশ উইকেটের ল্যান্ডমার্ক ছুতে পারেননি কোনো পেসার
পয়লা টেস্ট শেষে হারের ময়নাতদন্তে আমাদের পেসারদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ যখন সাত‘শ এর অধিক রান করে তখন সেটা স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু বিষয়টা আর স্বাভাবিক ঠেকবে না যখন দেখবেন পেসারদের বঞ্চনার সিলসিলা টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর থেকেই চলছে। শুধু পেসাররাই না, খামখেয়ালির শিকার স্পিনাররাও। পুরো লেখাতেই সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
মতলবি মনের শিকারে দিশেহারা পেসাররা
আপনি যদি কারো কাছ থেকে পারফর্ম্যান্স আশা করেন, তাহলে তাকে নিয়মিত সুযোগ দেয়া আবশ্যক। আমাদের পেসাররা কি সে সুযোগটা পায়? এক কথায় ‘না’। সর্বশেষ টেস্ট খেলা দু’জন পেসারের দিকেই দেখুন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই দারুণ খেলেছিলেন খালেদ। হ্যাঁ, তিনি উইকেট পাননি। সেটা পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন পাননি আর তিনি কেমন করেছিলেন সেটি তো নির্বাচকদের দেখার কথা। তারপরের টেস্টেই তিনি বাদ! কেন? স্পিনিং উইকেট বানিয়ে প্রতিপক্ষকে বধ করতে হবে যে! সে সিরিজেই দলের বাইরে বসে থাকা খালেদকে আবারো শুরু করতে হয়েছে শূন্য থেকে! এবং আমরা তার কাছে পারফর্ম্যান্স আশা করছি।
যে সিরিজে খালেদের অভিষেক তার আগের সিরিজে বেশ ভালো করেছিলেন রাহী। ভালো করার পুরষ্কার হিসাবে পরের সিরিজে দলেই নেই তিনি! এবার তার কাছেও আমরা পারফর্ম্যান্স আশা করছি। উইকেট যখন পুরোপুরি ব্যাটিং সহায়ক, প্রতিপক্ষ যখন বোলারদের উপর চওড়া হচ্ছে তখন কেমন বোলিং করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শটা দিবে কে? আগেই তো বললাম, তিন জনের মিলিত টেস্ট অভিজ্ঞতাই চার ম্যাচের, যার মধ্যে একজনের আবার অভিষেকও।
এখন, বলতে পারেন যে তাইলে কি দেখিয়ে তারা দলে এসেছে যে, সামান্য আক্কলও নেই? আক্কলটা যে জায়গায় হবে সে ঘরোয়া ক্রিকেটের হালত যদি জেনে থাকেন এ প্রশ্নটি করবেন না। আমাদের ঘরোয়া লিগে পাইকারি দরে স্পিনার খেলানো হয়। পেসাররা দলে থাকেন নামকাওয়াস্তে। আর থাকলেও যে পিচ পান তাতে কি করার থাকে? যেখান থেকে খেলা শেখার কথা সেখানকার হালতই যখন এমন তখন আপনি পেসারদের দোষটা দিবেন কিভাবে?
আপনি যদি আমাদের পেসারদের দিকে আঙুল তুলতে চান আমি শক্তভাবে তার প্রতিবাদ জানাবো। যখন বাংলাদেশ দলের দুরাবস্থা চলছিলো তখন কিন্তু শাহাদাত রাজিব নিয়মিত খেলেছেন এবং আশিটির কাছাকাছি উইকেটও নিয়েছেন। চোট জর্জরিত অবস্থাতেও মাশরাফি শিকার করেছিলেন ৭৮টি উইকেট। এ দু’জনই ত্রিশের বেশি টেস্ট খেলা ভাগ্যবান পেসার। আস্থা তো রাখতে হবে। একজন বোলারকে পাঁচ ম্যাচ খেলালেন, সেটিও বড় বড় বিরতির পর; সেখানে ব্যর্থ হবার পর ছুড়ে ফেলে দিলেন, এভাবে পারফর্ম্যান্স আশা করা যায়? রবিউলের শুরুটা বেশ ভালো ছিল। তিনিও অবসর নিলেন নয় ম্যাচ খেলেই। এবং মাত্র নয় ম্যাচেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভও লুকাননি তিনি।
যত সম্ভাবনাময়ই হোক না কেন, একবার বাদ পড়লে যেন ফিরে আসার আর রাস্তা নাই। শহীদ, আল আমিনরা তো বেশ সম্ভাবনাময় ছিলেন, তারা কোথায়? বাদ পড়ার পরে তাদের কি কোনো লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে, কি করলে দলে ফিরবেন? কেউই জানে না। ইবাদত, খালেদ দু’জনই মানের বিচারে শাহাদাতের চেয়ে এগিয়ে। তাদের যে ছুড়ে ফেলা হবে না এ সিরিজ শেষে তার নিশ্চয়তা আছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় খেলাতে হয় বলেই খেলানো।
স্পিনারদের উপরে ভরসা শুধুই দেশে
বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ উইকেট শিকারির চারজনই স্পিনার। পয়লা বাংলাদেশি হিসাবে টেস্টে একশো উইকেট নেয়া মোহাম্মদ রফিরও কিন্তু শুরুর দিকে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। দক্ষতা দেখিয়ে দলে জায়গা করে নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করার পরেও তাকে বিদায় নিতে এক রকম বাধ্যই করা হয়েছে। রফিক সে কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন। আরেক স্পিনার তাইজুলের উপর ভরসা করা হয় দেশের মাটিতেই। বিদেশে তার রেকর্ডও ততটা ভালো না। আরেক স্পিনার মিরাজ এখন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও বিদেশের মাটিতে তার হালতও তথৈবচ। যার সর্বশেষ নমুনা আমরা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই দেখেছি।
উপমহাদেশের দেশ হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের স্পিনারের মজুদ বেশি। কিন্তু তাদের বিকাশটাও কি ঠিকভাবে হতে দেয়া হচ্ছে? উইকেটের আনূকল্য না পেলে তারা যেরকম অসহায় হয়ে পড়েন তাতে এ জায়গায় একটি বড় প্রশ্নবোধক পড়ে যায়। ঘরের মাঠে আমরা এমন উইকেট বানাই যেখানে পয়লা দিন থেকেই বল ঘুরতে শুরু করে। সেখানে বাড়তি কিছু না করে শুধু জায়গায় বল ফেলতে পারলেই চলে। হ্যাঁ, জায়গায় বল ফেলাটাও একটা বড় ক্ষমতা কিন্তু শুধু এ দিয়ে টেস্টে সফল হওয়া কঠিন।
এমন পরিস্থিতিতে সাফল্য পাবার ফলে বাড়তি কিছু করার ক্ষুধাটা মরে যায়। এছাড়া মিডিয়া যে হাইপ সৃষ্টি করে তাতে পা মাটিতে রাখাও কঠিন। সে সময় উড়তে থাকা ব্যক্তি বিদেশের মাটিতে আচমকাই নিজেকে আবিষ্কার করেন নখ দন্তহীন রুপে। এক জায়গায় আমরা দেখছি স্পিনাররা প্রতিপক্ষকে তুর্কি নাচন নাঁচিয়ে ছাড়ছেন, অপর জায়গায় আমরা দেখছি সেই একই স্পিনাররা দিশা হারিয়ে দিক বেদিকে বল ছুড়ছেন!
স্পিনাররাও কিন্তু নির্বাচকদের খেয়ালের শিকার। জুবায়ের’র কথা তো এত দ্রুত ভুলে যাবার কথা না। ঐ বয়সেই তার হাতে যে পরিমাণ কাজ ছিল তাতে তাকে যদি ঠিক ভাবে ঘষামাজা করা হতো তাহলে বেশ ভালো একটি স্পিনার পেতাম আমরা। আজকে তিনি যে অন্তরালে তার দায় কি শুধুই তার? সীমিত ওভারের জন্য উপযুক্ত নাজমুল অপুকে নামিয়ে দেয়া হলো টেস্টে। তাতে তিনি খুব একটা খারাপও করেননি। তারপরের টেস্টেই তিনি বাদ! এ যেন মনের খেয়ালে দল নিয়ে খেলা।
অতঃপর…
এসব খেয়ালি আচরণের ফলাফল কি হয় তা আমরা বিদেশে গেলেই দেখছি। এই যে এখন বোলারদের ব্যর্থতা নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা তা নিয়ে প্রশ্ন করলেই শুনবেন স্পোর্টিং পিচ নিয়ে বিসিবি ভাবছে। এ ভাবনা গত আঠারো বছর ধরেই চলছে। ভাবনাও শেষ হয় না কাজের কাজও কিছু হয় না। নির্বাচকরা সুযোগ পেলে দায় বোলারদের উপর চাপিয়ে দিয়ে বর্তে যান।
স্পিনিং পিচ বানানো গুনাহ না। তবে পয়লা দিন থেকে যে পিচে বল ঘোরে সেটাকে স্পিনিং বলতেও বাধে। এ পিচের খেলে কৃতিত্ব নেয়ার ফসল তো আমরা দেখছি। এখন যদি ভালো করে খেয়াল করেন দেখবেন যে নগ্ন ফায়দা নেবার প্রবণতা কমে আসছে। ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের, আফ্রিকার মাটিতে শ্রীলঙ্কার সাফল্য সেদিকেই ইঙ্গিত করে। ন্যূনতম একটা মান বজায় রাখার চেষ্টা দৃশ্যমান। তার ফায়দাও কিন্তু এ ফলাফলগুলো। ভারত তাদের পুরোনো পন্থা থেকে ফিরে এসেছে বলেই কিন্তু এখন বিশ্ব ক্রিকেটে রাজ করতে পারছে।
আমি ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের কৃতিত্ব খাটো করছি না। ম্যাচগুলো আমরা খেলেই জিতেছি। ইংলিশ দলেও মঈন আলী, আদিল রশিদের মত স্পিনার ছিল। একটি বিষয় কিন্তু লক্ষ্য করা প্রয়োজন। কিছুদিন আগেও শক্তির বিচারে আমরা, শ্রীলঙ্কা এবং উইন্ডিজ ছিলাম কাছাকাছি। কিন্তু সাম্প্রতিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বাকি দুটা দল এগিয়ে গেলেও আমরা রয়ে গিয়েছি সেই তিমিরেই। টেস্টে বিশ উইকেট নিতে না পারলে এ অবস্থা অবসানেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এমন খামখেয়ালিপণা চলতে থাকলে সেটা সম্ভবও না।
উপসংহার
ওয়ালশের মত বোলিং কোচ থাকার পরেও পেসারদের এ অবস্থা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে এবং তিনি তার জবাবও দিয়েছেন। আমাদের পেসাররা যে ভালো করতে পারে, সেটা কিন্তু আমরা স্ট্রিকের জামানায় দেখেছিলাম। স্পিনাররাও যে যেকোনো কন্ডিশনে কার্যকর তার প্রমাণ রেখেছেন সাকিব-রফিকরা। সুতরাং, ফল অনুকূলে আনার প্রয়াসে এই দেওলিয়াত্ব বন্ধ করা এখন আবশ্যক। এটি করে কালভদ্রে সাফল্য হয়তো পাওয়া সম্ভব, কিন্তু আখেরে ক্ষতি ক্রিকেটেরই।