কেন কাশ্মির ইস্যুকে ভুলে যাওয়া হচ্ছে

কেন কাশ্মির ইস্যুকে ভুলে যাওয়া হচ্ছে

পাক-ভারত যুদ্ধের উত্তেজনায় হারিয়ে যেতে বসেছে ‘কাশ্মির ইস্যু’ যার কারণে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি। ভারতীয় প্রশাসন আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে কাশ্মিরকে করে রেখেছে বিশ্বের সবচেয়ে মিলিটারাইজড জোন। কাশ্মিরিদের সেই অধিকার নিয়ে কলম ধরেছেন দিল্লী ভিত্তিক কাশ্মিরি গবেষক শামরিন মুস্তাক ও মুদাসির আমিন।  গত ২ মার্চ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’র মতামত পাতায়। এখানে জবান’র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মাইনুদ্দিন সেজান।


“কী বলাবলি করছে তারা যুদ্ধ নিয়ে? এটা কি লেগে যাবে?” কাশ্মিরে থাকা আমাদের পরিবারের সদস্যরা কিছুদিন ধরে আমাদেরকে এ প্রশ্নগুলিই করছে, তাদের ধারণা যেহেতু আমরা দিল্লিতে থাকি, আমাদের কাছে উত্তরগুলো থাকতে পারে।

আমাদের মাতৃভূমিতে এই অস্থিরতা এবং ভয় বিরাজ করছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে, যেদিন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পুলওয়ামা জেলায় একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় জোয়ান নিহত হয়।  তৎক্ষণাৎ আমাদের (কাশ্মিরি) সবাইকে ঢালাওভাবে জাতীয় বেঈমান আখ্যা দেওয়া হয়, পুরো ভারত জুড়ে আমাদের উপর হামলা করা হয়, শিকার হতে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতির।  ‘প্রতিশোধে’র ডাক দেয় ভারতীয় গণমাধ্যম এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা, শুরু করে দেয় যুদ্ধের ডাক-ঢোল পিটানো।

ভারতীয় সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং কাশ্মিরে আরও সেনা মোতায়েন করে।  রাতজুড়ে পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে, গ্রেফতার করেছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের।  নিষিদ্ধ হয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী।

এদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নেয় ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং পাকিস্তানকে টার্গেট করে কিছু অভিযান পরিচালনা করে, যা পাকিস্তানকে পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য উসকে দেয়। ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে বিভক্ত করা ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ (লাইন অব কন্ট্রোল) ধরে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ।

অনেক কাশ্মিরি বাধ্য হয়ে পালিয়েছে, পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হওয়ার ভয়ে অনেকে খাদ্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করা শুরু করেছে।  লাল ক্রস চিহ্ন বড় করে একে দেওয়া হয়েছে হাসপাতালগুলোর ছাদে যাতে জঙ্গি বিমানগুলো এখানে হামলা না করে।

ঘরবাড়ি,শরীর,মনের উপর দৈনন্দিন আগ্রাসন ও দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে যে কাশ্মিরি জনগণ যুগের পর যুগ অতিবাহিত করেছে, তারা এখন আশংকা করছেন এক সর্বাত্মক যুদ্ধের।

এমন ভয়াবহ পরিবেশে আমাদের পরিবারগুলো হাজারো মাইল দূর থেকে অনবরত আমাদের ফোন করছে, মেসেজ করছে আমাদের থেকে কিছু আশার বাণী শুনতে পাবে বলে।  তাদের প্রতিটা দিন কাটে ভয়ংকর রাত আর আকাশে উড়তে থাকা যুদ্ধ বিমানগুলো গুণে গুনে। প্রতিদিন আমরা ভাবি ঘরে ফিরে যাওয়া আর আমাদের প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ মোকাবেলা করার কথা।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছে, ‘মোকাবেলা’ ‘পরিস্থিতির অবনতি’, ‘আসন্ন যুদ্ধ’ এই শিরোনামগুলো।  ব্রডকাস্টিংগুলো ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি পদক্ষেপ, আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ, দাবি ও পাল্টা দাবি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রচার করছে।  প্রতিবেদকরা নথিভুক্ত করে রাখছে প্রতিটি বক্তব্য ও পরিস্থিতি। পণ্ডিতগণ যুদ্ধ করার সক্ষমতা থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীর গঠন, অস্ত্রশস্ত্র এবং সমরকৌশল থেকে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যন্ত যুদ্ধের প্রতিটি দৃষ্টিকোণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করছেন।

সংঘর্ষ ও যুদ্ধের এতসব কানাঘুষার মাঝে একটা সহজ বিষয় চাপা পড়ে গেছে, যে কাশ্মিরের জন্য এত যুদ্ধ-কলহ।  সে কাশ্মির ইস্যু এবং কাশ্মীরি জনগণের অবস্থান সব যেন ঠুনকো হয়ে পড়েছে, যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান সংঘর্ষ এই বিতর্কিত জায়গার জন্য যেকোন কিছু করতেই প্রস্তুত।

 

সংঘর্ষ ও যুদ্ধের এতসব কানাঘুষার মাঝে একটা সহজ বিষয় চাপা পড়ে গেছে, যে কাশ্মিরের জন্য এত যুদ্ধ-কলহ।  সে কাশ্মির ইস্যু এবং কাশ্মীরি জনগণের অবস্থান সব যেন ঠুনকো হয়ে পড়েছে, যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান সংঘর্ষ এই বিতর্কিত জায়গার জন্য যেকোন কিছু করতেই প্রস্তুত।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো যখন ভারত ও পাকিস্তানের শত্রুতার ইতিহাস আলোচনা করে, কাশ্মিরি জনগণেরই যে সব থেকে বড় ধকল সইতে হয় এটা তারা স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়।  ভারতীয় গণমাধ্যম হরহামেশা ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে আলাপ করে, অথচ তারা কখনো বলে না কাশ্মির বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ‘মিলিটারাইজড জোন’র একটা।

ভারতীয় কর্মকর্তা ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা যখন আটক ভারতীয় পাইলটকে জেনেভা কনভেনশনের আলোকে আচরণ করার আহবান জানায় তখন এটা কেবল একটা ‘আইরনি’ হয়ে দাঁড়ায়।  কাশ্মিরে যেখানে শুধু জেনেভা কনভেনশনই নয় অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনগুলো ও মানা হয়নি। কাশ্মিরিদের এখনো রাজনৈতিক মামলায় কারারন্তীন করে রাখা হয়, ব্যবহার করা হয় মানব ঢাল হিসেবে।  জাতিসংঘ রেজ্যুলুশনে স্বায়ত্বশাসনের জন্য যে একটা রেফারেন্ডাম আয়োজনের কথা বলা হয়েছে, সেটাও এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।

চলমান যুদ্ধবিরোধী অ্যাকটিভিজম ছোট ছোট কিছু মিছিল আর সামাজিক মাধ্যমে ‘নো টু ওয়ার’ হ্যাশট্যাগেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে মূখ্য বিষয়টাই অনালোচিত থেকে যাচ্ছে।  কেউ আলাপ করছে না  কিভাবে সত্যিকারের শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ভারতীয়দের বুঝতে হবে কাশ্মির ইস্যুকে সমাধান না করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।  যদি তারা সত্যিই ‘যুদ্ধকে না’ চায় তবে তদের সর্বপ্রথম কাশ্মিরকে ডিমিলিটারাইজেশন করার ব্যাপারে  চাপ দিতে হবে।  যদি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, সেগুলো তাদের মানতে হবে, পাশাপাশি জাতিসংঘের নির্দেশ মেনে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। কাশ্মিরিদের তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।

 

ভারত সরকার প্রভাবশালী বয়ানগুলি প্রচার করছে।  আর মূলধারার গণমাধ্যমগুলো স্তব্ধ করে দিচ্ছে কাশ্মিরিদের কণ্ঠগুলো। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের যুদ্ধের গল্পগুলো শোনা ও বলা। কাশ্মিরের হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুম, যৌন-সহিংসতা, ছোরার আঘাতে গণ-অন্ধত্ব, প্রতিদিনকার বিব্রতকর পরিস্থিতি কার্পেটের নিচে মুছে দেয়া যায় না, উপেক্ষা করা যায় না।  এসব সহিংসতাগুলোকে সবার দৃষ্টিগোচরে আনতে হবে।  কারণ  ভারত সরকারের এখনকার নিরাপত্তা নীতিগুলো চলমান রাখলে বা আরও বেশি কার্যকর করলে শুধু বিপর্যই বয়ে আনবে।

ভারতীয়দের বুঝতে হবে কাশ্মির ইস্যুকে সমাধান না করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।  যদি তারা সত্যিই ‘যুদ্ধকে না’ চায় তবে তদের সর্বপ্রথম কাশ্মিরকে ডিমিলিটারাইজেশন করার ব্যাপারে  চাপ দিতে হবে।  যদি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, সেগুলো তাদের মানতে হবে, পাশাপাশি জাতিসংঘের নির্দেশ মেনে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। কাশ্মিরিদের তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।