আলোর ফেরিওয়ালা। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। বইওয়ালা দাদুভাই। বইদাদু। তার কর্মযজ্ঞ নাম-পরিচয় অতিক্রম করে পছন্দসই খেতাব তৈরি করেছিল বাংলাদেশের জনমানসে। তার অকপট কথায়, “জ্ঞানদান সবচেয়ে বড় দান। তাই আমি বই বিতরণের মাধ্যমে বেছে নিয়েছি সবচেয়ে বড় দানের কাজটি!” বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি বই সরবরাহ করতেন পড়াশোনায় আগ্রহী সাধারণ মানুষদের বাড়ি গিয়ে। পড়া হলে বই ফেরত নিয়ে দিতেন নতুন বই। বিনিময়ে তিনি নিতেন না কানাকড়িও। তবে তার উদ্দেশ্য কী ছিল? উদ্দেশ্য একটাই, জ্ঞানদান মহৎ দান! এই একুশ শতকেও বিজ্ঞানময় চরম উৎকর্ষতার জমানায় লন্ঠনের নিচে বিদ্যমান নিকষ অন্ধকারের মতো অজ্ঞানতা ছড়িয়ে আছে গ্রাম তথা অনুন্নত এলাকায়। গ্রাম্য এলাকায় অজ্ঞানতা দূরীভূত করার আন্তরিক প্রয়াসে তার স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমাদের মননে তাকে প্রাতঃস্মরণীয় মনীষা করে তুলেছে। বাংলাদেশে তিনি অভিনব জ্ঞান-বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন একক প্রচেষ্টায়। তিনি পলান সরকার। সেই ব্যতিক্রমী যুগপুরুষ ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। ১ মার্চ, শুক্রবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে দুপুর ১২:৩০ নাগাদ বাসভবনে শেষ নিশ্বাস করেন তিনি। বিগত কিছুদিন বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন পলান সরকার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। স্ত্রী রাহেলা বেগম প্রয়াত হয়েছেন গত বছরে। রেখে গেলেন ছয় পুত্র, তিন কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের। তার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সমগ্র বাংলাদেশ।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে পলান সরকার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হায়াতউল্লাহ সরকারের মৃত্যু হয় যখন তার বয়স মাত্র পাঁচ মাস। সাংসারিক অস্বচ্ছলতা ছিল, তাই চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয় যাওয়া। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি মায়ের সঙ্গে চলে আসেন নানা মইনউদ্দিন সরকারের বাড়ি। তার নানা ছিলেন স্থানীয় জমিদার। পলান সরকার বাঘা থানার বাউসা বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পর্বে ভর্তি হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেই বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা যেত। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় ইতি পড়ে তার। হারেজ উদ্দিন সরকার তার প্রকৃত নাম। মা ডাকতেন পলান নামে, সেই নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।
পলান সরকারের কর্মজীবন শুরু হয় নানার জমিদারির গোমস্তা অর্থাৎ খাজনা আদায়কারী হিসাবে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়, তারপর তিনি বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারী হিসাবে চাকরিতে যুক্ত হন। যৌবনকালে তিনি যাত্রাদলে ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন রোজগারের জন্য। ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার সূত্রে নানার ভূসম্পত্তি থেকে তিনি চল্লিশ বিঘা জমির মালিক হন। ১৯৬৫ সালে বাউসা হারুন-অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় তৈরি হয় তার দান করা ৫২% ভূমিতে। এলাকার মানুষদের অনুরোধে এই বিদ্যালয়ে তিনি পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকাকালীন তিনি ছাত্রছাত্রীদের বই পড়তে অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষায় সব শ্রেণির প্রথম থেকে দশম স্থানাধিকারী শিক্ষার্থীদের তিনি বই উপহার দিতেন। তখন থেকে শুরু বই পড়তে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বই সরবরাহের কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রাতঃরাশ সেরে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন অন্যান্য গ্রামে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে রাজশাহী এলাকার সমস্ত গ্রামে তিনি প্রত্যহ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এই ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তিরিশ বছরের অধিক সময়। জ্ঞানের প্রসারে মানুষকে পাঠমুখী করে তুলতে তার এই অভিনব আন্দোলন আমাদের বাধ্য করে তাকে কুর্নিশ করতে! তাই পলান সরকার নামটা শুনলেই মাথা ঝুঁকে যায় বিনম্র শ্রদ্ধায়!
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ‘বিটিভি’-তে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ মারফত প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন এই বইপ্রেমী মানুষটি। সমাজসেবা এবং জ্ঞান-প্রসারে অসামান্য অবদানের জন্য পলান সরকার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’ অর্জন করেন ২০১১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। নির্বিরোধী, অমায়িক এই মানুষটাকে ইউনিলিভার বাংলাদেশ ভূষিত করে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ‘অবদান’ নামের নাটক, যা সম্প্রচারিত হয়েছিল ‘বিটিভি’ চ্যানেলে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অন্যান্য সংবাদপত্রে তার কর্মযজ্ঞ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে সরকারি উদ্যোগে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার তৈরি করে দেয় যা ‘পলান সরকার পাঠাগার’ নামে জনপ্রিয়।