একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই প্রশ্ন উঠেছিল যে, বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে কিনা? নির্বাচন সে সংশয় দূর করে দেয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের বিজয় নিজেরাই নিশ্চিত করে নেয়। ভোট নয় সিল মেরে জয় লাভ করে।
এই জয় অর্জনের জন্য ক্ষমতাসীনরা ভোটকেন্দ্র দখল, আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা, বিরোধীদের ভোট দিতে না দেয়া সহ নানান অনিয়মের আশ্রয় নেয়। সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা’র ‘হেড টু হেড’ অনুষ্ঠানে দেশের এই ভয়াবহ সংকটসহ নানা প্রশ্নে মুখোমুখি হতে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। মেহেদী হাসানের সঞ্চালনায় দীর্ঘ ৫০ মিনিটের এই অনুষ্ঠানে প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকেন গওহর রিজভী। দিতে পারেননি কোন প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর।
আল জাজিরা’র জনপ্রিয় ওই শো’তে এক্সপার্ট প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম, এসেক্স ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয় বিশেষজ্ঞ আব্বাস ফাইজ এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুইডশ সাংবাদিক তাসনিম খলিল। তাসনিম খলিল ও আব্বাস ফাইজ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি, বাক-স্বাধীনতা ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের ব্যর্থতা সামনে নিয়ে আসলেও মুনা তাসনিম সরকারের সাফাই গাওয়াতেই ব্যস্ত ছিলেন।
প্রথম প্রশ্ন হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশ কি আদৌ একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে কিনা? উত্তরে তিনি না বললেও কোন কারণ দেখাতে পারেননি। অন্যদিকে মেহদী হাসান নির্বাচনের সমস্ত অনিয়মই তার সামনে তুলে ধরেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য উল্লেখ করে বলেন যে, এরা যে তথ্য প্রকাশ করছে তা কি মিথ্যা। গওহর রিজভী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টকে গুটিকয়েক কেন্দ্রের পরিস্থিতি উল্লেখ করেন এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত নিউজকে বিচ্ছিন্ন বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে বললে তিনি তা অস্বীকার করেন এবং ‘আগের চেয়ে এখন বেশি টিভি চ্যানেল’ আছে বলে যুক্তি দেন। অথচ খবর প্রকাশের দায়ে সাংবাদিকদের আটকের ঘটনাও ঘটেছে। উঠে এসেছে শহিদুল আলমের আটক ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের কথাও। গওহর রিজভী নিজেকে শহিদুল আলমের বন্ধু পরিচয় দিলেও তার উপর নির্যাতন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানেন না বলেছেন। আবার একই সাথে স্বীকার করেন যে, শহিদুল আলমকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
আব্বাস ফাইজ গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেন। কিন্তু গওহর রিজভী তা প্রত্যাখান করেন। উপস্থিত একজন আইনজীবী তার ক্লায়েন্টের গুম হওয়ার কথা উল্লেখ করলে তিনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান এবং বলেন, “আপনার ক্লায়েন্ট কোথায় আছে, তা আপনি জানেন”। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার কাছে এটি হতাশাজনক।
অন্যদিকে গওহর রিজভী বাংলাদেশকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র দাবি করলে সামনে আসে হেফাজত ইসলাম ও জামায়াত ইসলাম প্রসঙ্গ। রিজভী বলেন, জামায়াত ইসলাম রাজনৈতিক সংগঠন তাই তারা সেকুলার রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ, কিন্তু হেফাজত ইসলাম একটি সংগঠন। এই প্রসঙ্গে এসে, ব্লগার হত্যার অভিযুক্তদের বিচার ত্বরান্বিত করা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয় সরকার।
পরিশেষে সামনে আনা হয় রোহিঙ্গা ইস্যু যেখানে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। কিন্তু তা ঝুলিয়ে রাখার জন্য দায়ী করা হয় সরকারকে। কানাডা তাদের কিছু সংখ্যক নাগরিকত্ব দিতে চাইলে বাংলাদেশ বাধা দিয়েছিল। কেন? সেকথা জানতে চাইলে গওহর রিজভী জানান, “সেটা দিলে তৃতীয় কোন দেশে সেটেল হওয়ার লোভ পেয়ে বসবে তাদের”। অন্যদিকে সরকার মিয়ানমারের এই আচরণকে ‘গণহত্যা’ বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বললেও কেন আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে না সেকথা জানতে চাইলে রিজভী কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
এছাড়াও ওই শোতে, বিরোধীদের দমন, মৃত ব্যক্তির নামে মামলা, রোহিঙ্গাদের রেশন না দেওয়া, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন-ভাতা নিশ্চিত না করে আটক ও ছাঁটাই করাসহ নানান ইস্যু উঠে আসে। মূলত আওয়ামী লীগ আমলে ঘটে যাওয়া অনিয়মগুলোর নিয়েই মুখোমুখি হয়েছিলেন মেহেদী হাসান আর গওহর রিজভী সদুত্তরের অভাবে শ্রেফ করমর্দন করেই বিদায় নিয়েছিলেন।