চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদকে হ্যাটট্রিক শিরোপা এনে দেওয়ার পাঁচ দিন পরই কোচের পদ থেকে পদত্যাগ করে বসেন দলটির কোচ জিনেদিন জিদান। ফরাসি কিংবদন্তির এমন পদত্যাগে অবাক হয়েছেন সবাই-ই। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে লিভারপুলকে হারিয়ে শিরোপা জেতার আগে রিয়ালে জিদানের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছিল। কারণ এর আগে শেষ হওয়া লা লিগায় শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি আগের মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল। লেগানেসের কাছে হেরে কোপা দেল রে’র কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই তারা বিদায় নেয়। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পরে রিয়াল ভক্তরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো। যাক! এবার অন্তত পাকাপোক্তভাবেই স্প্যানিশ ক্লাবটির হাল ধরবেন জিদান। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দলটিকে শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে বীরদর্পেই রিয়াল ছেড়েছেন জিদান।
যদিও রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবের সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ দাবি করছেন, ‘আজীবন’ জিদানকেই রিয়ালে চেয়েছিলেন তিনি। ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা আসার আগের দিন বিষয়টি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন জিদান। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের কোচের পরিণতি সম্পর্কে ভালোই অবগত আছেন স্প্যানিশ সাবেক ফুটবলার জিদান। দলটিতে আগের কোচদের পরিণতি কোনোমতেই সুখকর ছিল না। জিদানের পরেও না। জিদানের পদত্যাগের পর লোপেতেগুইর অধিনে মৌসুমের শুরুতে ছন্দেই ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তবে কয়েক ম্যাচ পরই ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। পয়েন্ট টেবিলে রিয়ালের অবস্থান ক্রমে পেছাচ্ছিল। এরপরই গুঞ্জন ওঠে বেশি দিন টিকছেন না রিয়াল মাদ্রিদ কোচ লোপেতেগুই। মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকোতে বিধ্বস্ত হওয়ার পর গুঞ্জনটাই সত্যি হলো। ক্লাবের হয়ে মাত্র ১০ ম্যাচ ডাগ আউটে দাঁড়ানোর পরই শেষ হয়ে গেল লোপেতেগুইয়ের রিয়াল-অধ্যায়। ১৩৯ দিনের মাথায় তাঁকে সরিয়ে রিয়াল অন্তর্বর্তীকালীন কোচ করেছে সান্তিয়াগো সোলারিকে। এভাবে বারবার কোচ পরিবর্তন দলের জন্য আদৌ কি ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয়? দল কি নতুন কোচের কলা-কৌশলের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে?
কোচের পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটা ক্লাবের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হয়। এর লক্ষ্য মূল দলের খেলার কৌশলে পরিবর্তন আনা। কিন্তু খেলোয়াড়েরা সেই কৌশলের সাথে নিজেদের কতটা খাপ খাওয়াতে পারে, কতটা মেলে ধরতে পারে- সেটাই দেখার বিষয়। অনেক সময় খেলোয়াড়েরা কোচের কৌশলের সাথে নিজেদের ঠিক মেলে ধরতে পারে না। ফলে ফুটবলারের ব্যক্তিগত পারফর্ম্যান্স খারাপ হতে থাকে, যা দলকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন করে। কিছুদিন আগে কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া হোসে মোরিনহোর কথাই ধরা যাক। একের পর এক পরাজয়ে দল কোনঠাসা, দলের খেলোয়াড়েরা স্কোর না করতে পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছিলেন। মোরিনহোর সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে দলের খেলোয়াড়রাই যে আর চাইছিলেন না তাকে। ফলে বাধ্য হয়ে দল থেকে বিদায় করা হয় এই পর্তুগিজ কোচকে। শুধু ক্লাবেই নয়। জাতীয় দলেও কোচ পরিবর্তনের বাতিকের কারণে দলের পারফর্ম্যান্স খারাপের দিকে ধাবিত হয়। এক্ষেত্রে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কথাই সামনে আসে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বার আর্জেন্টিনা দলে কোচ পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দলের খারাপ পারফর্ম্যান্সের কারণ হিসেবে অনেকে কোচকেই দায়ী করেন। করবেন-ই বা না কেন! কোচ জর্জ সাম্পাওলির অধিনে আর্জেন্টিনার উন্নতি তেমন চোখে পড়ার মতো ছিল না। আর্জেন্টাইন এই কোচ দায়িত্ব নেওয়ার পর অল্প কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে আর্জেন্টিনা। শেষ হওয়া রাশিয়া বিশ্বকাপে দলকে রীতিমতো তলানি থেকে তুলতে হয়েছে। বিশ্বকাপে মূল পর্ব নিশ্চিত করার পুরো কৃতিত্ব দলের সেরা তারকা লিওনেল মেসির প্রাপ্য। ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচে মেসির হ্যাটট্রিক না হলে রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইনদের দর্শক হয়েই হয়তো কাটিয়ে দিতে হতো। ১৯৭০ সালের পর এই প্রথম এতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা মূল পর্ব নিশ্চিত করে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে আর্জেন্টিনার বিদায় হলো, সেই সাথে সাম্পাওলিরও।
মানুষের চাওয়া বা ধারণাকে পুঁজি করে কোন ক্লাব কোচ পরিবর্তন করে না। ক্লাব চায় নতুন কোচের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি দলের উন্নতি হোক, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটে না। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েও কোচকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয় না, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দল যখন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন দল কোচের ব্যাপারে পুনরায় ভাবতে বাধ্য হয়। নতুন কোচ আসা মানেই তিনি দলকে একেবারে নিজের কৌশলে পারদর্শী করে তুলবেন, এমন নয়। তবে দল পুরনো কোচের দুর্ভাগ্যের সাথে আর নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে না কিংবা চায় না বলেই কোচের পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পরেও যেসব কোচ দলের উন্নতির জন্য জেদ করে লেগে থাকে, সেসব দল নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালে প্রিমিয়ার লিগে কোচদের বরখাস্তের বিষয় নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। যেখানে দেখা যায়, প্রিমিয়ার লিগ স্যাকিংয়ের কারণে দলটির পারফর্ম্যান্সে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং চরম দুঃসময়ে যারা তাদের কোচকে রেখে দিয়েছিল, তারাই পরবর্তীতে আরো ভালো ফল পেয়েছে। নতুন কোচ এসে পুরো দলের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন না। বরং আত্মতুষ্টির জন্য নতুন একজনকে দলের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয়। নতুন কোচ পুরনো কোচের তুলনায় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় আরো ভালো হবেন কি না, এ ব্যাপারে না ভেবে দায়িত্ব তুলে দেয়ার ফল হিতে বিপরীত হয়। যার ফল ভুগতে হয় পুরো দলকে।