পাকিস্তান-ভারতের ২২ গজের লড়াই মানে অন্যরকম উত্তেজনা। ক্রিকেটের সবুজ গালিচা ছাড়িয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারি, টিভি পর্দার সামনে বসে থাকা ভক্ত-সমর্থকদের মধ্যে এমনকি দুই দলের জয়-পরাজয় হয়ে যায় ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। কিন্তু সেটা কখনো দুই দেশের রাজনীতির মাঠে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় না, দুই দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় না। কিন্তু রাজনীতির তপ্ত মাঠের উত্তপ্ততা ক্রিকেটের শান্ত সবুজ গালিচাকে উত্তপ্ত করতে ভুল করে না। তেমনই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান-ভারত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
ঘটনার সূত্রপাত ভারতের পুলওয়ামায় একটি সেনা বহরকে কেন্দ্র করে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ওই এলাকায় জঙ্গি হামলার ঘটনার জবাব দিতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কয়েকটি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে ভারত। এরপর দুই দেশের সীমান্ত রেখা বরাবর পাল্টা হামলার কথা জানিয়েছে পাকিস্তানও। এখানেই শেষ নয়। প্রতিবেশী বৈরী এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। তবে এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বা উত্তেজনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় যা ছিল দেশ বিভাগের মাত্র দুই মাসের মাথায়। যে যুদ্ধ ছিল অমিমাংসিত কাশ্মিরকে নিয়ে। এরপরের যুদ্ধও হয় কাশ্মিরকে ঘিরে। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে কাশ্মির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আগের চেয়েও বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। এবার দুই দেশের মধ্যে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ক্রিকেটাঙ্গণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলার অবকাশ রাখে না।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) কাশ্মিরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ভারতের ৪০ জনের বেশি জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনার পরই একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানায়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদেশি ক্রিকেটারদের বলা হবে, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) অথবা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ পিএসএলে খেললে আইপিএল খেলা যাবে না। আইপিএলে খেললে পিএসএলে অংশগ্রহণ করা যাবে না। অবশ্য, অনেক যুক্তিতর্কের পর বিসিসিআই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। কারণ, আইপিএলে বিদেশি খেলোয়াড়দের বোর্ড নয় বরং ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলো কিনে থাকে। খেলোয়াড়েরা অর্থের বিনিময়ে দলগুলোকে সেবা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করলে ব্যাপারটা অতি উৎসাহী হয়ে নাক গলানোর শামিল। তবে কাশ্মিরে হামলার পরই ভারতের আইএমজি-রিলায়েন্স গ্রুপ পিএসএলের প্রযোজনা থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে । এ ছাড়া সম্প্রচারক সংস্থা ডি স্পোর্ট ভারতে পিএসএলের সম্প্রচার বাতিল করেছে।
পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে তাতে এর আঁচ দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কে না লাগাটা অস্বাভাবিক। এ বছরই ইংল্যান্ডে বসবে ২০১৯ বিশ্বকাপের আসর। আর এই আসরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কটের দাবি তুলেছেন ভারতীয়রা। কাশ্মির হামলার পর বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কটের দাবিতে সোচ্চার ভারতীয়রা। এই বিতর্কে দেশটির ক্রিকেটাঙ্গন দ্বিধাবিভক্ত হলেও কেন্দ্রীয় সরকার ম্যাচ ছেড়ে দিতে বিসিসিআইকে নির্দেশও দিয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। আইপিএলে বিদেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অটল থাকতে না পারলেও এটা নিয়ে ভাবছে ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই)। অনেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপ ম্যাচ বয়কটের পাশাপাশি সব ধরনের সম্পর্ক ত্যাগ করার বার্তা দিয়েছেন। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলকে চিঠিও দিয়েছে ভারতীয় বোর্ড। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানকে যেন নিষিদ্ধ করা হয়। আইসিসিকে বিসিসিআইয়ের ম্যাচ বয়কট প্রস্তাবের পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। তারাও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ভারতীয় বোর্ড কি সিদ্ধান্ত নেবে তাদের জানা নেই। তবে ভারত ম্যাচ ছেড়ে দিলে তারা সানন্দে সাথে দুই পয়েন্ট নেবে।
আগামী ৩০ মে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে গড়াবে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এরপর ১৬ জুন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের মাঠে পাক-ভারত মাঠের যুদ্ধ হওয়ার কথা। তবে দুই দেশের কোন্দলের পর সেটা এখন মাঠে গড়ায় কি না, সন্দেহ।
১৯৪৭ সালের পাকিস্তান-ভারতের বিভক্তির পর কেটে গেছে বহু বছর। দুই দেশের রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে কোনো সমঝোতা না আসলেও দুই পক্ষই সংঘাত ভুলে ক্রিকেটকে স্রেফ খেলা হিসেবেই চালিয়ে গেছে, অংশগ্রহণ করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার ম্যাচগুলি পূর্ববর্তী বছরগুলোর আগ্রাসন, সংগ্রাম ও প্রতিযোগিতাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে। ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তান টেস্ট সিরিজের জন্য ভারত সফর করেছিল। একইভাবে, ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফর করেছিল। মাঝে সংঘাতময় সময় গেলেও ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে ভারতে প্রথমবারের মতো একটি টেস্ট ম্যাচে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নাগরিকদের ভিসা দেওয়া হয়েছিল, যারা একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরেছিলেন। দুই দেশের রাজনৈতিক অন্তঃকোন্দলকে থামানোর জন্য ১৯৯০ সালের পর ক্রিকেট বেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি, আন্তর্জাতিক স্পনসর থেকেও এ ব্যাপারে ব্যাপক সমর্থন আসে। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা দুই দেশের স্নায়ুযুদ্ধকে আরো একটু উস্কে দিলেও ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মধ্যে ক্রিকেট কংক্রিটের ভূমিকা পালন করেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যে ক্রিকেটকে ঘিরেই দুই দেশ আস্তে আস্তে মিলিত হয়েছিল, এবার এই ক্রিকেট থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিতে চায় ভারত। পাকিস্তানও সেক্ষেত্রে মৌন ভূমিকায়ই থাকবে মনে করা হচ্ছে। এমনটা হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেকাংশে তার জৌলুস হারাবে, ক্রিকেট সমর্থকরা হাই ভোল্টেজ ম্যাচ থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে, পাকিস্তান-ভারতের সমঝোতার পথও অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যাবে।