মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ। তিনি দু’বার (১৯৭৯, ১৯৮০) ডাকসু’র ভিপি বা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাল ছাত্র সংসদ চাকসু’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ডাকসু এবং চাকসুর মতো প্লাটফর্মে দায়িত্ব পালন করা এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আসন্ন ‘ডাকসু নির্বাচন ২০১৯’ নিয়ে কথা বলেছেন জবান’র সাথে। প্রকাশ করেছেন সংশয়। জবান’র পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাহাতুল ইসলাম রাফি।
জবান : তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নির্বাচন কেমন হবে ভাবছেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না : একটা বিরাট বিতর্ক চলছে যে, হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন হবে কি হবে না। হলগুলোতে ক্ষমতাসীনদের এখনও যে দৌরাত্ম্য , গেস্টরুমে এখনও নিপীড়ন চলে বলে শুনলাম; অর্থাৎ হলগুলোতে ক্ষমতাসীনদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে; বাইরের কেউ নেই। এই অবস্থায় নির্বাচন তো মহানাটক!
আসলে বিভিন্ন দলের দবি না মেনেই ভোটকেন্দ্রগুলো হলে স্থাপন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়টি যৌক্তিক মনে করেন?
হলগুলোতে তাদের (ছাত্রলীগ) নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। হল প্রশাসনকে ওরা তোয়াক্কাই করে না। এই অবস্থায় হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করাটা একদমই অযৌক্তিক। এছাড়া বিভিন্ন দলের যে দাবি— ভোটকেন্দ্রগুলো হলের বাইরে অ্যাকাডেমিক ভবনে স্থাপন করা, সেটা যৌক্তিক।
১৯৯০-৯১ সালে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর দেশে গণতন্ত্র ফিরলেও ‘ডাকসু’ নির্বাচন হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকার কেন ডাকসু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আসলে ‘গণতন্ত্র’ কথাটা তো অনেক ব্যাপক। জাস্ট পাঁচ বছর পর একটা ভোট হলো, তাও যদি সুষ্ঠু হতো আর কি! গণতন্ত্র একটা মৌলিক মূল্যবোধ থেকে আসে। আমি মানুষকে রেসপেক্ট করবো, তার অধিকারকে রেসপেক্ট করবো, মত প্রকাশে তার স্বাধীনতা থাকবে। মূলত গণতান্ত্রিক সরকার ফেরে নাই; এগুলোকে বড়জোর নির্বাচিত সরকার বলা যায়। তারা যতদূর পারে এটা মেনে চলেছে, যতদূর পারে মানে নাই; যেখানে তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটেছে, সেখানে তারা তা দমন করেছে। সেটা করতে করতে তারা এমন পর্যায়ে এসেছে যে, ভোটের আগের রাতেই ভোট হয়ে যাচ্ছে। তো কারণ কী হতে পারে ডাকসু নির্বাচন না দেয়ার? যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিলেন, তারা মনে করেছেন নির্বাচন দিলে তাদের স্বার্থহানী হতে পারে; অতএব নির্বাচন দেয়া যাবে না।
আপনার সময়ে ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ এবং বর্তমান সময়ের পরিবেশের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
আমার সময় তো অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। এখন তো বিতর্কগুলো দেখছেনই, বিরোধীদল মনে করছে না এখন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। মূলত এখন নির্বাচনের পরিবেশই নেই।
মোটকথা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে একেবারে স্বৈরতান্ত্রিক পরিস্থিতি। ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ নিয়ে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্রকে পুরোপুরি হত্যা করা হয়েছে। এখন কোনও ছাত্র যদি রাজনীতি করতে চায়, তবে তার কাজ হবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।
অ্যাকাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন তিনমাস পেছানোর দাবি করেছে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন। আপনি কি মনে করেন?
আসলে তিনমাস সময় চাওয়াটা আমি ইম্পরট্যান্ট মনে করছি না। সহাবস্থানের জন্য তিনদিনই যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি আজ বলে দেয় যে, অবৈধ সিট দখলকারী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে যাও, সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বলে, আপনারা যদি নির্বাচন চান তবে এই কর্তৃত্ব আমাদের দিতে হবে; তবে বাহাত্তর ঘণ্টা যথেষ্ট সময়। ছাত্রদল তিনমাস চেয়েছে, নিশ্চয় তাদের বিবেচনা আছে; আমি তাদের বিরোধিতা করছি না, শুধু বলছি পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটা তিন দিনেরও ব্যাপার না।
এখন বিরোধী সংগঠনের কি কি করা উচিত?
তারা এই দাবিগুলোতে আন্দোলন করুক। এতে বাধাগ্রস্ত হলে সেই বাধাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে।
ছাত্ররা কীভাবে জাতীয় রাজনীতির চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখতে বলতে পারেন?
যখন আমি জাতীয় চরিত্র বিষয়ে বলবো— প্রথমত, আপনি একজন ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠবেন। আপনার বাবা-মা আপনাকে সেই শিক্ষা দেবে। আপনি যখন স্কুলে পড়ছেন, স্কুল তখন আপনাকে সেই শিক্ষা দেবে। আপনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়ছেন, তখন আপনাকে সেগুলো তা শিক্ষা দেবে। আপনার দেশে যে সংস্কৃতির চর্চা হয়, নাটক-সিনেমা প্রভৃতির মাঝে তার ব্যাসিস থাকবে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে ছাত্রদের বিরাট ভূমিকা থাকতে পারে। তারা ন্যায্যতা বোঝে, অধিকার বোঝে। আমি মনে করি ছাত্রদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা দেশ গঠনে, জাতীয় চরিত্র গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
নতুন রাজনীতির জন্য এই প্রজন্মকে কোন কোন বিষয়গুলো আমলে নিতে হতে বলে মনে করেন?
মোটকথা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে একেবারে স্বৈরতান্ত্রিক পরিস্থিতি। ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ নিয়ে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্রকে পুরোপুরি হত্যা করা হয়েছে। এখন কোনও ছাত্র যদি রাজনীতি করতে চায়, তবে তার কাজ হবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা। গণতন্ত্রের জন্য লড়তে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে তাকে উজ্জীবিত হতে হবে। আমাদের মতো দেশ যাতে অগ্রগতি করে, উন্নতি করে এবং সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন হয়, এর জন্য যে কন্সেপ্ট ওয়েলফেস্টিং— সেই ধারণাটা তাদের আসা উচিত।
এই যে আপনি বললেন ‘৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ নিয়ে ফেলা হয়েছে’, ডাকসু নির্বাচনে কি এমনটা আশা করেন?
হলে যদি ভোট হয়, তবে তো ভোট ছিনতাই করতে হবে না। অন্যরা কেউ ভোটকেন্দ্রে যেতেই পারবে না। জাতীয় নির্বাচনে তো পুলিশের সাহায্য নিয়েছিলো তারা, এইখানে তো ওটাও লাগবে না। মোটকথা, এই নির্বাচন নিয়ে সবকিছুই করবে তারা।