কাবারো কাপে চেলসি-সিটি ফাইনালের ফলাফল ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রতে এখন কেপা। তার চূড়ান্ত অখেলোয়াড় সূলভ আচরণে স্তম্ভিত স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন সিটির ক্যাপ্টেন কম্পানিসহ ফুটবল বিশ্লেষকরা। খেলোয়াড় কোচের দ্বন্দ্ব এখন বলতে গেলে নিয়মিত একটি বিষয়, এটি নিয়ে লিখবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু কেপা যে এভাবে মাসালার যোগান দিবেন তা ভাবিনি।
কোচের খেলোয়াড় বদলের সিদ্ধান্তকে সম্পুর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে মাঠে থেকে যাবার দৃশ্য এর আগে কেউ কখনো দেখেছেন কি না জানা নেই। আমি তো বটেই অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ বিখ্যাত ব্রিটিশ কোচ হ্যারি রেডন্যাপও এমন কিছু দেখেননি বলেই জানিয়েছেন সাংবাদিকদের। এমন অবস্থায় সারির অগ্নিমূর্তিই ছিল স্বাভাবিক, সেটি দেখাও গিয়েছে। ইউনাইটেড হতে মোরিনহো বরখাস্ত হবার পরেই বিষয়টি আলোচনায় এসেছিলো যে, বর্তমানে খেলোয়াড়রা অতিমাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করছেন কি না? সেটির এক অনন্য নজিরই যেন দেখালেন কেপা। কোচ-খেলোয়াড় সম্পর্কের এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে এখানে মিডিয়ার ভূমিকাটা আলোচনা করবার জারুরাত বোধ করছি।
দেখুন, বর্তমান সময়ের মিডিয়া আর আগের মত নেই। এখন মিডিয়া বেশ লাভজনক একটি ব্যবসা। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সেসব খবরই গেলানো হয় যা আমরা গিলতে চাই। খোলামেলা ভাবে বলি, ইদানিং ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির কল্যানে যে কোনো খেলোয়াড় বা কোচ সম্পর্কে সাধারণের ভাবনা জানা যায় বেশ সহজেই। যেমন মোরিনহোর কথাই ধরুণ, কাকার সাথে তার কর্মের ফলে রিয়াল সমর্থকদের একাংশের চক্ষুশূল তিনি অনেকটা সময় ধরেই। এটি আপনি মো কে নিয়ে প্রকাশিত যেকোনো খবরের কমেন্ট সেকশনে গেলেই বুঝতে পারবেন। একই সাথে ডি ব্রুইনির এবং সালাহর আচমকা উত্থান রোষ সৃষ্টি করেছে চেলসি সমর্থকদের মনেও। এখানে মিডিয়ার ভূমিকাটি কী?
যেহেতু প্রতিভাবান কিছু খেলোয়াড় পরখে মো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, এবং ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে সাংবাদিক এবং প্রতিপক্ষের তার বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে, সে খবরটিই অধিকহারে প্রচার করা হয়েছে যেটি মোর বিপক্ষে যায়। বেল জিদান এর যে দ্বন্দ্বটির কথা ইদানিং শোনা যায়, সেটি কিন্তু মিডিয়া সেভাবে প্রচার করেনি। খেলোয়াড়দের সাথে মো’র নেতিবাচক সম্পর্কের খবর প্রচার করলে যতটা সাড়া পাওয়া যায় ততটা অন্য কারোর বেলায় হয় না। এখন, আপনি যদি ক্রমাগত কারো সম্পর্কে নেতিবাচক শুনতে থাকেন তাহলে আপনার মনের মধ্যে সে আদমি সম্পর্কে আপনা আপনিই যে ধারণাটি তৈরি হবে সেটিও নেতিবাচক। এটি এখন ইচ্ছে করেই করা হয়। কাকা যদি বলেন মো তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করেছেন, এটি যেভাবে প্রচার করা হয়, দ্রগবার মোর সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য সেভাবে প্রচার করা হয় না।
অপর চিত্রটি দেখুন। মোরিনহোর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পেপ সম্পর্কে কিন্তু কাকার চেয়েও আক্রমণাত্মক ভাষায় একাধিক বয়ান দিয়েছেন ইব্রাহিমোভিচ। সেটি যতটা প্রচার হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রচার হয়েছে পেপ সম্পর্কে কারো ইতিবাচক বয়ান। যার ফলে পেপের ইমেজ কিন্তু খুব ইতিবাচক। আমি বলছি না পেপ খারাপ, মিডিয়া তাকে ভালো বানিয়েছে। আমি যা বলছি তা হলো, পাবলিক পারসেপশনকে ব্যবহার করে মিডিয়া কিভাবে একজনের ইমেজ তৈরি করে সে সম্পর্কে।
এ বিষয়টি নিয়ে কেন বললাম তার ব্যাখ্যার আগে চেলসি এবং ইউনাইটেডে একটু ঢু মারবো। নিকট অতীতে চেলসি দুজন ম্যানেজার বদলেছে এবং সারিও বরখাস্ত হবেন বলেই গুঞ্জন। সারির আগে যে দু’জন বরখাস্ত হয়েছেন তার একজন মোরিনহো। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে সারির একটি মন্তব্য মনে করিয়ে দিতে চাই যা খুব প্রাসঙ্গিক। কিছুদিন আগে ম্যাচ পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন চেলসির বর্তমান স্কোয়াডটাকে মোটিভেট করা অত্যন্ত কঠিন। চেলসিতে থাকাবস্থায় মোরিনহোও প্রায় অনুরূপ একটি মন্তব্য করেছিলেন। সেটি পাত্তা পায়নি খেলোয়াড়দের সাথে তার অতীত সম্পর্ক, যে বিষয়ে একটু আগেই কথা বললাম; সেটি বিবেচনায়।
বরখাস্ত হবার আগের মৌসুমেই কিন্তু মো’র অধিনেই উড়ছিলো চেলসি। সে দলটিই আকস্মিক রেলিগেশন জোনের কাছাকাছি কি করে পৌঁছে গিয়েছিলো সেটি একটি বড় রহস্য। যেটি জানা যায়, তা হলো তার কিছু সিদ্ধান্তে খেলোয়াড়রা নাখোশ ছিলো, এটির প্রভাবই দেখা গিয়েছে খেলাতে। এখন, যে বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিলো, তা হলো মোর রক্ষণাত্মক মানসিকতা। এটি কেমন যেন আশ্চর্য ঠেকে, কেননা এ মানসিকতা নিয়েই তো আগের মৌসুমে চেলসি লিগ কাপিয়েছিলো। খোলা চোখে দেখলে যা মনে হয়, তা হলো মোরিনহো অভ্যাস বসতই কাউকে বাড়তি গুরুত্ব দেননি। যা, অনেকেরই মনঃপুত হয়নি। তাদের নেতৃত্বে সবার সম্মলিতি প্রচেষ্টার ফল সে ভয়ানক ফলাফল এবং শেষ অবধি খোলোয়াড়দের চাহিদামত মোরিনহোর বরখাস্ত হওয়া।
আপনি যদি আমার এ ধারণাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে চান তাহলে কন্তে এবং সারির অবস্থাটা দেখার অনুরোধ করবো। মোরিনহোর জায়গায় দায়িত্ব নেয়া কন্তের কিন্তু খেলোয়াড়দের সাথে বিরোধের তেমন বড় কোনো অতীত ইতিহাস নেই। তারপরেও তিনি টিকতে পারেননি। অথচ, কন্তের পয়লা মৌসুমটাও কেটেছিলো স্বপ্নের মত। মোরিনহো, কন্তে দুজনই ইউরোপের অন্যতম কুলিন ম্যানেজার। তারা শিরোপা জেতার পরের মৌসুমেই শীর্ষ চারে থাকতেও যুদ্ধ করবেন এটি ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। কন্তেও মোরিনহোর ধারাবাহিকতায় খেলোয়াড়দের সাথে বিরোধে জড়িয়েছিলেন যার সমাপ্তি ঘটেছিলো তার বরখাস্ত হবার মধ্য দিয়ে।
মোরিনহোর বিদায়ের অন্যতম নেপথ্য কারিগর ছিলেন ডিয়াগো কস্তা। মোরিনহো বরখাস্ত হবার পরে কন্তে যখন দায়িত্ব নিলেন কস্তা ছিলেন কন্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি দু’জনের মধ্যে তুলনা টেনে কন্তেকে বিশাল সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এই কস্তাই পরে কন্তের বিদায়ে ক্রীড়নকের ভূমিকায় হাজির হয়েছিলেন। কস্তার ব্যাড বয় ইমেজের কথা সর্বজন স্বীকৃত। তাকে পথে আনতে গেলেই বিপত্তি বেধেছে। বিদ্রোহী কস্তা সাঙ্গপাঙ্গ সমেত ছাঁটাই করে ছেড়েছেন কোচকেই!
কন্তের বিদায়ের পর সারির শুরুর সময়টাতেও কিন্তু উড়ছিলো চেলসি। মোরিনহো বা কন্তের মত পরিচিতি সারির ছিল না। খেলোয়াড়দের সাথে বাহাসে জড়ানোর খবরও তেমন শোনা যায়নি। অথচ তার অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। যা বোঝা যাচ্ছে, কঠিন চরিত্রের ম্যানেজার হলে খেলোয়াড়রা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন, কিছুটা নরম হলে তাকে পেয়ে বসছেন। সারির খেলার ধরনও কিন্তু বেশ প্রশংসিত ছিলো, যা চেলসিতে এসে মুখোমুখি কঠোর সমালোচনার। অর্থাৎ খেলার ধরন বা সাফল্য না, এখন কোচদের টিকে থাকা নির্ভর করছে খেলোয়াড়দের দাক্ষিণ্যের উপর।
বিষয়টা এমন কেন হচ্ছে তার সরাসরি উপসংহারে আসা এ মুহূর্তে কঠিন। তবে, যা ধারণা করা যায় তা হলো খেলোয়াড়দের উপর ক্লাবগুলোর বিশাল লগ্নি। কেপা এ মুহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দামি গোল রক্ষক। যেহেতু কোচের অবস্থা সুবিধার নয়, তাই বেপোরোয়া হতে তার বাঁধেনি। কারণ, এক মৌসুম শেষে নিশ্চয় চেলসি চাইবে না এত টাকা লগ্নি করা হয়েছে যার পিছনে তাকে ছেড়ে দিতে। আর কেপা একাই যে এতটা বেপোরোয়া হয়েছেন তা বিশ্বাস করা কিছুটা কঠিন। চেলসির নিকট অতীত বলছে কোচের পিছনে একাট্টা হয়ে লাগার বিদ্যাটা চেলসির খেলোয়াড়রা রপ্ত করেছেন বেশ ভালোভাবেই। কেপা যদিও একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন নিজের পক্ষে, কিন্তু স্বভাবতই সেটি বিশ্বাস করা কঠিন। ঐ ঘটনার পরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কেপার চোখ টিপে দেয়া কি ইঙ্গিত করছিলো বুঝতে বোধ করি কারোই কষ্ট হবার কথা না।
তবে এ ঘটনারও ইতিবাচক দিক রয়েছে। মোরিনহো খেলোয়াড়দের এই বেপোরোয়া আচরণের বিষয়টি সামনে আনলেও তা হালে পানি পায়নি। কেননা, তার ইমেজটাই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে যাই ঘটুক পুরো দায়ই তার। সারির তেমন ইমেজ না থাকায় এখন একটু নড়েচড়ে বসেছে সবাই।
মোরিনহোর ইউনাইটেড অধ্যায়ের সমাপ্তি প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা বলে ইতি টানবো এ লেখার। মোরিনহোর বিদায়ের অন্যতম কারণ খেলোয়াড়দের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি। বিশেষ করে রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে ইউনাইটেডে যোগ দেয়া পগবার সাথে। পগবার অধারাবাহিকতা এবং খামখেয়ালী আচরণে বেশ বিরক্ত ছিলেন মোরিনহো। পগবায় ইউনাইটেড দর্শকরা মজে ছিল বেশ আগে থেকেই। সাথে ছিলো মোরিনহোর খেলার ধরনের উপর ক্ষোভ। যার ফলে মিডিয়া স্বভাবতই পক্ষ নিয়েছিল পগবার। তার প্রতিভা সম্পর্কে প্রশ্ন নেই, কিন্তু নিবেদন বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। সেটিকে সজ্ঞানেই পাশ কাটালো সবাই। মোরিনহো হয়ে উঠলেন ভিলেন।
এরপরে কিন্তু আমরা অনেকটাই কন্তে কাহিনির পুনরাবৃত্তি দেখেছি। সোলসকায়ারের অধিনে উড়তে শুরু করলো ইউনাইটেড। যথারীতি মুণ্ডুপাত হলো মোরিনহোর। অথচ, পগবার বিষয়ে তার মূল্যায়ন যে যথার্থ ছিলো তার চিত্র আমরা দেখলাম পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচে। হারতে বসা ইউনাইটেডকে বাঁচানোর বদলে পগবা বিপদ বাড়ালেন লাল কার্ড দেখে। সেটি নিয়ে তার কোনো ভাবান্তরও দেখা যায়নি। লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে পগবার আচরণ নিয়ে পুনরায় মুখ খুলতে শুরু করেছেন ইউনাইটেডের কিংবদন্তিরা।
একটা সময় কিন্তু ইউনাইটেডে ম্যানেজারের কথাই ছিল শেষ কথা। যখনই স্যার ফার্গুসনের মনে হয়েছে কোন খেলোয়াড় ক্লাবের চেয়ে বেশি বড় হয়ে উঠছে ছেঁটে ফেলতে দ্বিধা করেননি। মো একই মানসিকতার। সেটি প্রয়োগ করতে গিয়েই বাধছে বিপত্তি। সারিকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে দলের অন্দরের হালত কতটা খারাপ। এখন মিডিয়া কি করবে? খেলোয়াড়দের এই বেপোরোয়া মানসিকতা সৃষ্টির পেছনে যে তাদের দায়ও কম না। অতিমাত্রার বাণিজ্যিক মনোভাবের ফলাফল কতটা খারাপ হতে পারে তার একটি নগ্ন উদাহারণই যেন সৃষ্টি করে দেখালেন কেপা।