যে উপন্যাস দুনিয়াকে বিভক্ত করে দিয়েছিল

যে উপন্যাস দুনিয়াকে বিভক্ত করে দিয়েছিল

 

“দ্য স্যাটানিক ভার্সেস” – লেখক সালমান রুশদির বিরুদ্ধে আয়াতুল্লাহ খোমিনির ফতোয়া প্রকাশের ৩০ বছর পূর্ণ হল এই বছরে।

১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবসে ইরানের আধ্যাত্বিক নেতা এই উপন্যাসটির লেখক সালমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুর ফতোয়া জারি করেন।

এই ফতোয়া জারির আগেই ভারতীয় বংশজাত এই লেখক সাহিত্যে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন বিষ্ময়কর উপন্যাস মিড নাইট চিলড্রেনস (১৯৮১) লিখেন যা বুকার পুরস্কার পেয়েছিল সেই বছরে। তার পরে লিখেন শেইম (১৯৮৩)।

দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসটি নিয়ে পাকিস্তানে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। এর পরে তা সব মুসলিম দেশেই ছড়িয়ে পরে। খোমেনী যদিও ইংরেজি পড়তে পারতেন কিন্তু তিনি এই উপন্যাসের মাধ্যমে মুসলমান জনগোষ্ঠির যে প্রতিক্রিয়া সারা দুনিয়াতে তৈরি হয়েছিল তারই প্রেক্ষিতে ফতোয়া জারি করেন।  ইরান বিপ্লবের ১০ বছরের মাথায় এমন একটি ফতোয়া ইরানকে মুসলাম বিশ্বের কাছে ইসলামের ব্যাপারে অধিক সতর্ক ও প্রতিনিধি হিসেবে হাজিরের সুযোগ করে দেয়।

অনেকের কাছেই এটা একটি উপন্যাস মাত্র। যে খানে রুশদি জাদুবাস্তব কাহিনী বর্ণনা করেছেন। যদিও এই কাহিনীর মূল ভিত্তিটা তিনি নিয়েছেন ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জিবনী থেকেই। শয়তানের বাণী নাম করণের কারণ হল। কুআনের আয়াতের মত কিছু বাণী তখন কিছু লোক প্রচার করছিল। যা ছিল মূলত শয়তানের বাণী। এই ধারণা ও এইসব কিছু বাণী উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ইসলাম ও মহানবীর চরিত্র নিয়ে বাজে ভাবে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে। এবং এটা কোন ভাবেই মুসলামনদের কাছে কেবল মাত্র একটি উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এটা মুসলমানদের পবিত্র বিশ্বাস ও নবীকে অপমানের এক পশ্চিমা এজেন্ডার অংশ বলেই মনে করেন ইসলামে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠি। যে কারণে বইটি প্রশংসা কুড়িয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী মহলে।

১৯৮৮ সালে এটি বুকার -এর চূড়ান্ত তালিকায় ছিল। যদিও পিটার ক্যারির অস্কার অ্যান্ড লুসিন্ডার কাছে হেরে যায়। একই বছর উপন্যাসটি হুইটব্রেড অ্যাওয়ার্ড  লাভ করে। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস একটি বিশাল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সারা দুনিয়াতেই। মুসলিমরা বইটিকে ব্লাসফেমি এবং তাদের বিশ্বাসের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে আখ্যায়িত করে।  মুসলিমের প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী ১৯৮৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সালমান রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেছিলেন। এর পরে সালমান রুশদী আত্মগোপনে চলে যান। সেক্যুলার দুনিয়ায় খোমেনীর এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে উঠেছিল বিতর্ক। লেখকের স্বাধীনতার পক্ষের শিবির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। বিখ্যাত লেখক-চিন্তক হামিদ দাবাশি সাম্প্রতিক আল জাজিরাতে এক লেখায় বলেছেন,

এই উপন্যাসটি মূলত দুনিয়াকে ২ দুটি শিবরে ভাগ করে দিয়েছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে এতবড় বিভাজন আর আগে দেখা যায়নি। একদল ইসলামের পক্ষে। অন্যদল পশ্চিমা উদারপন্থার পক্ষে চলে গিয়েছিল।

আর কোন উপন্যাসের বেলায় এই ধরণের ঘটনা ঘটেনি। রুশদির এই উপন্যাস ইসলামোফোবিয়াকে যেমন জাগ্রত করেছে তেমনি ইসলামি দুনিয়া বইটি ভাল করে না পড়েই সমালোচনা ও প্রতিবাদে নেমেছিল।

আসলে রুশদি যে মানের লেখক, তার আগের বইগুলোতে তিনি যে শক্তির পরিচয় দিয়েছেন সেই দিক থেকে বিচার করলে এটা খুব বাজে একটি সাহিত্যকর্ম। এবং এই উপন্যাসটির পরেও মূলত রুশদি আর কোন মাস্টারপিস লিখতে পারেন নি। দাবাশির মতে সাহিত্যের নামে একটি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ঘৃনা উস্কে দেবার প্রকল্প নেয়ার মধ্য দিয়ে জিবীত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে এক প্রতিভাধর লেখকের। মূলত দ্য স্যাটানিক ভার্সেসে বইটির মাধ্যমে রুশদির যে পরিচয় তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে একজন লেখকের মৃত্যু ঘটেছে। রুশদি পরিচিত হন উগ্র ইসলাম বিদ্বেষী সাহিত্যিক হিসেবে। এবং এর মাধ্যমে উপন্যাস মাধ্যমটিও রুশদির জীবন থেকে মৃত্যু বরণ করে। এখন রুশদির কাছে মানুষ উপন্যাস আশা করতে পারে না। এই একটি বই লেখক ও তাঁর জন্য উপন্যাসের মৃত্যুর এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দুনিয়াতে।

এই উপন্যাস সাহিত্যের কোন উপকার তো করেইনি বরং পশ্চিমা দুনিয়াতে ইসলামোফোবিয়া ও মুসলমানদের উগ্র প্রতিবাদি হিসেবে তৈরি করতে সাহায্য করেছে। দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রুশদি একজন শক্তিশালি লেখক এই বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবে না। কিন্তু দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকল্প তাঁর শক্তিমত্তাকে চিরতরে হত্যা করেছে। দুনিয়ার মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল দুটি বিভক্ত শিবিরে। একদল ছিল লেখক বা ব্যাক্তিস্বাধীনতার নামে ইসলামকে হেয় করার পক্ষে। আর একদল ছিল ইসলামের যে কোন অপমানের বিরুদ্ধে এবং এই মৃত্যু পরোয়ানা বাস্তবায়নের জন্য দাবি উঠেছিল মুসলিম বিশ্বে।

এই উপন্যাসের পরেও রুশিদি লিখেছেন। কিন্তু সেই মহান লেখক যিনি মিড নাইটস চিলড্রেনের লেখক সে যেন কবেই মারা গেছেন। এখন কেউ আর মনে রাখেন না, রুশদির সাহিত্য আমাদের জন্য কি নতুন চমক নিয়ে আসছে।

সাহিত্যের ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল। এই থেকে পরর্বতী প্রজন্মে লেখকদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছুই।