বার্সেলোনা তাদের বর্তমান ম্যানেজার আর্নেস্তো ভালভার্দের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। এটি পুরোনো খবর। ভালভার্দে নিজেই বলেছিলেন তার সাফল্য মূলত বিবেচিত হবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফলাফলের উপর। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্ব শুরু হবার আগেই চুক্তি নবায়ণের বিষয়টিতে বার্সা ভক্তদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। সেটি কেন, তা স্পষ্ট হয়েছে লিওর বিপক্ষে ম্যাচের পর। আমার চোখে ভালভার্দের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেগুলো পার করা তার পক্ষে বেশ কঠিন হবে। এ লেখায় আলোচনা করবো সে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে এবং কেন ভালভার্দেতে আস্থা রাখা কঠিন সেটি নিয়ে।
কিছুদিন আগে বার্সা সভাপতি বেশ স্পষ্টভাবেই বলেছেন বার্সার বর্তমান বিনিয়োগগুলো হচ্ছে মেসি পরবর্তী সময়কে মাথায় রেখে। বার্সা বোর্ডের যে বিষয়টির সব সময় প্রসংশার দাবিদার তা হলো, তাদের দূরদর্শিতা এবং স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার। চিরবৈরী প্রতিপক্ষ রিয়ালের রোনালদো পরবর্তী অবস্থা বার্সা খুব ভালোভাবেই খেয়াল করছে। সেটি মাথায় রেখে এমন সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাধুবাদের দাবি রাখে। কিন্তু এখানেই ভালভার্দের কাজটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগে দেখে নেই তার সামনের চ্যালেঞ্জগুলো;
- বার্সার সাফল্য অব্যাহত রাখা
- মেসির জায়গায় একজন যোগ্য বিকল্প তৈরি করে নেয়া
- মেসি থাকাবস্থায় তার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা
মেসি পূর্ব সময়ে বার্সার প্রাণ ছিলেন রোনালদিনহো। মূলত তার পায়ের জাদুতেই বার্সার বার্সা হয়ে ওঠার শুরু। দিনহোর সে সোনালি সময়টাতে তার পরে কেউ এমন মুগ্ধতা ছড়াতে পারবেন তা বোধ করি কেউই ভাবেনি। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি, তার চেয়েও বেশি সময় ধরে, তার চেয়েও বেহতার ভাবে কেউ ফুটবল বিশ্ব শাসন করতে পারেন। এখানেই ভালভার্দের কাজটি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মেসিকে সামনে রেখে মেসি পরববর্তী সময়ের জন্য দলকে প্রস্তুত করা।
কাজটি কিন্তু রাইকার্ড খুব সফলতার সাথে করেছিলেন। দিনহোর ছায়াতেই মেসিকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছিলেন তিনি। যদিও রাইকার্ড নিজে মেসি মেহেকের পুরোটা উপভোগ করতে পারেননি। যেটা পেরেছিলেন গার্দিওলা। রাইকার্ড পরবর্তী ম্যানেজাররা সে পথে এগুচ্ছিলেন নেইমারকে সামনে রেখে। সন্দেহ নেই, মেসির পর ক্যাম্প ন্যু এর মধ্যমণি হবার সব যোগ্যতাই তার ছিল। কিন্তু টানা মেসির ছায়ায় পড়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত নেইমারের ক্লাব ত্যাগের সিদ্ধান্তটি তার ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক হলেও বার্সার জন্য একটি বড় ধাক্কা।
মেসির ছায়া থেকে নেইমারকে বের হতে যতটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে মেসির কিন্তু ততটা লাগেনি। আচমকাই পথ হারানো দিনহো বার্সা ছাড়লে পুরো নজরটা এসে পরে মেসির উপর। ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছেন ইনিয়েস্তা, জাভিরাও। যার ফলে শূন্যতা সৃষ্টির বদলে বার্সার শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। বার্সা এমনিতেই জাভি-ইনিয়েস্তার বিকল্প খুঁজে যাচ্ছে এখনও। সেটিই ঠিকমত না পাওয়া অবস্থায় মেসির বিকল্প তৈরি করার কাজটি হয়ে যাচ্ছে কঠিন। সাথে যোগ হয়েছে নেইমারের শূন্যতা।
যার উপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রেখেছে বার্সা ম্যানেজমেন্ট, সেই কৌতিনহো কিন্তু এখনো লস প্রজেক্ট। ভালভার্দে এখনো ঠিক করে উঠতে পারেননি কোথায় তিনি সবচেয়ে কার্যকর। বিশাল অঙ্কের এই ট্রান্সফার পুরোটাই পানিতে গেল কি না সে আলোচনা কিন্তু এখন বেশ জোরেশোরেই হচ্ছে। আরেকটি বড় সাইনিং ডেম্বেলে। যিনি এই জ্বলেন তো এই নিভেন।
মেসির ওপর নির্ভরতা কমাতে গেলেই হিতে বিপরীত হচ্ছে। ফল অনুকূলে আনার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে মেসির উপরেই। এ মৌসুমে মেসি যেমন খেলছেন, তাতে তাকে কেন্দ্র করে না খেলাটাও হবে আত্মঘাতী। ইনজুরির আগ পর্যন্ত মেসিকে কেউ থামাতে পারবেন বলে মনে হচ্ছিলো না। ইনজুরির পরে মেসির ফর্ম যেই একটু পড়েছে তখনই পথ হারিয়ে ফিরছে বার্সা।
রাইকার্ড যেটি করেছিলেন সেটি হলো দিনহো নির্ভরতা আচমকাই কমিয়ে না ফেলে বিভিন্ন পজিশনে বাকিদের তৈরি করা। ভালভার্দেকে এখানে বেশ দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে। তিনি কখনো পুরো মেসি নির্ভর হচ্ছেন, কখনো পুরোই বাকিদের উপর নির্ভর করার চেষ্টা করছেন। ব্যালেন্সটা তিনি খুজে পাচ্ছেন না। এর মধ্যে বাড়তি সমস্যা সুয়ারেজের ফর্ম।
মেসি কিন্তু রাইকার্ডের সময় ফ্রি লাইসেন্স পেয়েছিলেন। ভালভার্দেকেও এখানে ফাদার ফিগার হতে হবে। যার উপর আস্থা রাখতে চান, তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সময় দিতে হবে নিজেকে তৈরি করে নেয়ার। নেইমার খুব দ্রুত সেটা পেরেছিলেন। বাকিরাও দ্রুত পারবেন এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, ভালভার্দের এখানে কাজটা হলো সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাকে জ্বলে উঠার সময় দেয়া। কৌতিনহো বা ডেম্বেলে, অথবা ম্যালকম, আর্থার; কারোর প্রতিভা নিয়েই সন্দেহ নেই। তাদের ধারাবাহিক করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ, যেটির উপর বার্সার বর্তমান এবং ভবিষ্যত সাফল্যের অনেক কিছু নির্ভর করছে।
এই সমীকরণের মধ্যেই ভালভার্দেকে ধরে রাখতে হবে সাফল্য যাত্রা। বর্তমান বার্সা শুধু লা’লিগা বা কোপা জয়ে সন্তুষ্ট থাকার মত দল না। বিশেষ করে চির প্রতিদ্বন্দি রিয়াল যেখানে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে বসে আছে। সবগুলো শিরোপার জন্য লড়তে গিয়ে ব্যর্থ হবার বদলে তাকে প্রায়োরিটি ঠিক করতে হবে। সেখানেও অবশ্য তাল হারাচ্ছেন তিনি। গতবার লিগ এবং কোপাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বরণ করেছিলেন করুণ পরিণতি। এবার আবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে পাখির চোখ করতে গিয়ে প্রায় তাল কেটে যাচ্ছে লিগে। যদিও রিয়াল বা অ্যাথলেটিকো সেটির ফায়দা নিতে না পারায় কোনো সমস্যা আপাতত হচ্ছে না।
সময়টি একটু স্পর্শকাতর। সে হিসাবে মাঠের নৈপুণ্য দেখে ভালভার্দেকেই সঠিক ব্যক্তি মনে করা কিছুটা কঠিন। যদিও পরিসংখ্যান তার পক্ষে। কেন যেন মনে হয়, তার চুক্তি বাড়িয়ে বার্সা একটি জুয়াই খেলছে। খোলা চোখে যে জুয়ায় জেতার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। তবে, সময় যেহেতু আছে ভালভার্দেরও সুযোগ আছে শঙ্কাগুলো উড়িয়ে দেয়ার। সেটা করতে পারলে তা তো বটেই বার্সার জন্যও মঙ্গলজনক। সেটি না হলে বার্সাও কম খেসারত দিবে না।