সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের আলোকে জামায়াতে ইসলামী’র উত্থান-পতন : পর্ব ২

সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের আলোকে জামায়াতে ইসলামী’র উত্থান-পতন : পর্ব ২

জাতিগঠনের প্রথম দিনগুলো, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭

জাতির স্থপতি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তার অধস্তন লিয়াকত আলী খান কখনোই পাকিস্তানের ইসলামী পরিচয় ও জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করেননি। জিন্নাহ বলতেন, “পাকিস্তান হবে এমন একটি দেশ যেখানে ইসলামের আলোকে সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে” (মতিন ২০০২, ২৪)। তিনি আরও বলেছেন, “আমরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়বো এবং এই পৃথিবীকে উপহার দেবো এমন একটি অর্থব্যবস্থা যা ইসলামের সাম্যতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে তৈরি হবে” (মতিন ২০০২, ২৬)। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের জেগে উঠতে হবে ইসলামী রেঁনেসার ডাকে – কল্যাণ ও মুক্তি অর্জনে; ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায়; কোরানের আলোকে পথ চলতে; এবং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে” (মতিন ২০০২, ২৪)। পাকিস্তানের সংবিধান কেমন হবে এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সংবিধান রচিত হবে গণতন্ত্র ও ইসলামের মৌলিক আদর্শের আলোকে, এবং এর ভিত্তি হবে শরিয়াহ” (মতিন ২০০২, ২৫)।  ১১ আগস্ট ১৯৪৭-এ আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সভায় দেয়া ভাষণেও তিনি ইসলামের ন্যায়বিচার, সাম্যতা, নৈতিকতা, ধার্মিকতা, এবং সহনশীলতার আলোকে সমাজ গঠনের কথা বলেছেন। তবে তিনি এটাও পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে পাকিস্তান একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে এবং কোনক্রমেই মোল্লাদের দ্বারা শাসিত হবেনা (গ্রেয়ার ২০০১, ৪)। মুসলিম লীগ মউদুদীর মত মোল্লাতন্ত্র কায়েম করতে চায়নি, চেয়েছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝেই ইসলামের কিছু রীতি-নীতি প্রয়োগ করতে। মুসলিম লীগের এই স্বাতন্ত্র্য জামায়াতের আবেদনকে ম্লান হয়ে দিয়েছিল এবং মুসলিম লীগ তাদের আদর্শের পক্ষে বিশাল জনসমর্থন গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে জামায়াত এবং মুসলিম লীগের মাঝে তেমন কোনো বিরোধ ছিলোনা এবং মউদুদী মুসলিম লীগের উপর মোটামুটি সন্তুষ্টই ছিলেন বলা যায়। তবে দু’টো বিষয়ে মউদুদীর সাথে মুসলিম লীগের মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রথমটি ছিল কাশ্মির ইস্যু।

পাকিস্তানের জনগণ কাশ্মির ইস্যুকে আত্মসম্মানের ইস্যু মনে করতো এবং অনেকে মনে করতো এটি ভারতের বিরুদ্ধে একটি জিহাদ, ঠিক সেই সময় মউদুদী জনমতের বিপক্ষে গিয়ে বলেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের উচিৎ ভারতের সাথে ১৯৪৮-এর চুক্তি মেনে চলা এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিহার করা।” এই অবস্থানের কারণে তিনি পাকিস্তানের জনগণের কাছে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাষ্ট্রের আনুগত্যের শপথবাক্য পাঠ করা নিয়ে। যেই দেশ দু’দিন আগেও পৃথিবীতে ছিলনা শপথবাক্য পাঠ করে সেই দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের কোনো অর্থও তার কাছে ছিলনা। তার মতে আনুগত্য হবে একমাত্র আল্লাহর, তাই তিনি রাষ্ট্রের আনুগত্যের শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান। সরকার এই আচরণ ক্ষিপ্রতার সাথে দমন করে। ১৯৪৮ এর অক্টোবরে মউদুদীকে গ্রেফতার করা হয়, সরকার থেকে জামায়াতের ২৫ জন সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়, এবং ‘তরজমানুল কোরান’ সহ জামায়াতের সকল প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয় (জিলানি ১৯৪৮, ২৭৩)।

এতসব বিরোধের পরেও মুসলিম লীগ ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথেই এগিয়ে যাচ্ছিল, যা প্রকারান্তরে জামায়াতেরও লক্ষ্য। জিন্নাহ’র মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও পাকিস্তানের ইসলামী পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ১৯৪৯ এর ৭ মার্চ আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সভায় জাতির দিক-নির্দেশনামূলক একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। সেখানে লিয়াকত আলী খান বলেন, “পাকিস্তান বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চায় যে মানবজাতি আজ যেসকল ব্যাধিতে ভুগছে সেগুলোর নিবারণকারী দাওয়াই আছে ইসলামের কাছে” (মুরাদ ১৯৪৮, ২৮)। তিনি নিশ্চিত করেন, “ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে রাষ্ট্র সবধরনের সহায়তা দেবে” (মুরাদ ১৯৪৮, ২৯)। মুসলিম লীগের এক সিনিয়র নেতা সরদার আবদুর রব খান নিশতার মুসলিম লীগের ভাবধারা আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এবং রাশিয়া ও চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে ইসলামের আলোকে একটি বিকল্প সমাজব্যবস্থা প্রণয়নের” (রহমান ১৯৯৯, ৩৪)।

জামায়াত মুসলিম লীগের এই প্রস্তাবনায় সন্তুষ্ট ছিল। জামায়াত বলেছিল এই প্রস্তাবনা পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাইলফলক এবং প্রকারান্তরে জামায়াতের আন্দোলনেরই ফসল। কিছু পরিবর্তন সাধনের পর এই প্রস্তাবনা ১৯৫৬ সালের সংবিধানে মুখবন্ধ হিসেবে যুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে এটা সংবিধানে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়। এই প্রস্তাবনায় নিশ্চিত করা হয়েছে, “সমগ্র জগতের সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং দুনিয়াতে তাঁর প্রতিনিধিরা তাঁর দেয়া সীমানার ভেতরে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।” এভাবে এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্ব ও ইহলৌকিক সার্বভৌমত্বের মাঝে এক ধরনের আপোসের চেষ্টা করা হয়।

পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান জামায়াত যতটা ইসলামী সংবিধান চেয়েছিল মোটেও তেমন হয়নি, তারপরও পাকিস্তানের ইসলামীকরণ মোটামুটি এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটি ঘটনায় এই গতিপথে পরিবর্তন আসে। সেটা হলো ১৯৫৩-এর আহমদীয়া বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল আহমদীয়া সম্প্রদায়কে সরকার কর্তৃক অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঘোষণার দাবি

 

যদিও পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান জামায়াত যতটা ইসলামী সংবিধান চেয়েছিল মোটেও তেমন হয়নি, তারপরও পাকিস্তানের ইসলামীকরণ মোটামুটি এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটি ঘটনায় এই গতিপথে পরিবর্তন আসে। সেটা হলো ১৯৫৩-এর আহমদীয়া বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল আহমদীয়া সম্প্রদায়কে সরকার কর্তৃক অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঘোষণার দাবি এবং সেই সাথে জাফরুল্লাহ খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে বাদ দেয়া কারণ তিনি ছিলেন কাদিয়ানি। আহমদীয়া বা কাদিয়ানিরা ছিল গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নামক এক ব্যক্তির অনুসারী যিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত পুরুষ এবং প্রতিশ্রুত ইমাম মেহেদী। এই দাবি মুসলমানদের ক্রুদ্ধ করতে যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু সরকার এই দাবির প্রতি উদাসীন ছিল। তাই আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে পাঞ্জাবে বিশাল বিক্ষোভ করে। সেই বিক্ষোভ সন্ত্রাসী রূপ নিয়ে লাহোরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকার বাধ্য হয় ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ তারিখ লাহোরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে।

এই আন্দোলনে জামায়াতের কোন ভূমিকা ছিলনা। জামায়াতের কাছে তখন আহমদীয়া ইস্যুর চাইতে সরকারের কাছ থেকে একটি পরিপূর্ণ ইসলামী সংবিধান আদায় করার আন্দোলনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে জামায়াতের পরিষ্কার অবস্থান ছিল আহমদীয়াদের অমুসলিম ঘোষণার পক্ষে এবং যখন আলেম-ওলামাগণ আহমদীদের বিরুদ্ধে মুসলিম দলগুলোর একটি সম্মেলন ডাকেন তখন জামায়াতকেও সেখানে আমন্ত্রন করা হয়। জামায়াত সেই সম্মেলনে যোগ দেয়। বলা বাহুল্য জামায়াত ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল। এই সুযোগকে কাজে লাগায় পাকিস্তানের তৎকালীন মিশ্র সামরিক-সুশীল অন্তবর্তীকালীন সরকার। তারা বলে যে এই অন্দোলনের হোতা হচ্ছে জামায়াত এবং তারা ইসলামী সংবিধানের দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে আহমদীয়া ইস্যুকে উস্কে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আহমদীয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলন নিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়। সেই তদন্ত রিপোর্টেও পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য জামায়াতকে দায়ী করা হয় (খুরশিদ ১৯৮০, ২৮৪)।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৭ এপ্রিল ১৯৪৯-এ আলেম-ওলামাদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে পদচ্যূত করেন। গভর্নর জেনারেল নিজে ছিলেন একজন সেক্যুলারিস্ট এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন আরেক সেক্যুলারিস্ট মোহাম্মদ আলী বোগরা’কে। মোহাম্মদ আলী বোগরা ‘জাতীয় উলামা পরিষদ’ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। সমর্থন পান পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর চৌধুরি খালেকুজ্জামানের, যিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কথা বলতেন এবং উলামাদেরকে পাকিস্তানের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করতেন। একইভাবে, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা উলামাদের মতের বিপক্ষে ছিলেন। যদিও আহমদীয়া সম্প্রদায় খুব ছোট একটা সম্প্রদায় ছিল তাদের সদস্যসংখ্যা বিচারে, কিন্তু এই ঘটনায় তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা জামায়াতকে কোনঠাসা করার এবং একইসাথে তাদের সেক্যুলার এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যায়।

মউদুদীর ভাষায় সেই সময়ের সরকার ইসলামকে একটি “কার্যকরী, অর্থবহ, বাস্তবভিত্তিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে যা জনগনের সামজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে পারতো” (মউদুদী ১৯৭৪, ১৮৯)। এই ব্যর্থতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী করা যায় পাকিস্তানের তৎকালীন সামন্তবাদী-পুঁজিবাদী শক্তি এবং সামরিক-সুশীল আমলাতন্ত্রকে। কারণ ইসলাম যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো এই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। ইসলাম পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে যে সমতা আসবে তা এই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী মেনে নেবে না। তাই তারা সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করেছে। “তবে ইসলামের জন্য জনগণের যে আবেগ-অনুভূতি সেটাকে তারা ১০০% কাজে লাগিয়েছে এবং তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামের আদর্শে সমাজ গঠনের ফাঁকা বুলি আউড়েছে” (মুরাদ ১৯৮০, ৩১১)। মউদুদীর মতে সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দরিদ্র, অশিক্ষিত, ও ইসলাম থেকে দুরে রাখার রাষ্ট্রীয় চেষ্টার কারণ হচ্ছে যেন সহজে এই জনগোষ্ঠীকে সুবিধাভোগীরা তাদের ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

১৯৫৩ সালের কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলনে ইসলামী দলগুলোর শক্তি সম্পর্কে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কিছুটা ধারণা পায়। তাই তারা সেক্যুলার হলেও রাষ্ট্রের আচার-অনুষ্ঠান থেকে ইসলামী আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিলোনা। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ নামটাও অক্ষুণ্ন থাকলো। ইসলামী দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগও খর্ব হলো না। তবে রাষ্ট্রকে ‘আধুনিক’ করার প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকলো। ইসলামী দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ থাকলেও কোনটা ইসলামিক বা কোনটা অনৈসলামিক সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ থাকলোনা, কারণ সকল সিদ্ধান্ত জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক গৃহীত হতে হবে। সংবিধানে এও বলা হলো যে প্রশাসন হবে আধুনিক এবং ধর্মীয় প্রভাবহীন (মতিন ২০০২, ১৯৮)। তাই ইসলামের আলোকে সমাজ গঠনের কথাগুলো কেবল ফাঁকা বুলি হয়ে রইলো। যদিও সংবিধানে বলা হয়েছে ইসলামী বিধি-বিধান নিয়ে গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান করা হবে এবং এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে ইসলামের কোন বিধিগুলো সংবিধানে সংযোজন করা যায় এবং যে আইনগুলো ইতিমধ্যে সংবিধানে আছে সেগুলো কিভাবে ইসলামের আলোকে পরিবর্তন করা যায় তার সুপারিশ করা। তবে সেই প্রতিষ্ঠানের দৌড় সুপারিশ দেয়া পর্যন্তই। সেই সুপারিশ আবার সংসদে পাঠানো হবে বিবেচনার জন্য, কারণ একমাত্র সংসদেরই ক্ষমতা আছে আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তনের। অর্থাৎ চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যাস্ত হলো জনপ্রতিনিধিদের উপর যাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করবে ইসলামের কোন আইন কতটুকু বাস্তবায়ন হবে বা হবেনা। যদিও বলা হয়েছে সংসদ কোনো ইসলামবিরোধী আইন পাশ করবে না, কিন্তু পরিষ্কার করে বলা হয়নি সংসদ যদি ইসলামবিরোধী আইন পাশ করেই ফেলে তাহলে কী হবে। যেহেতু সংসদের কোনো বিষয়ে বিচারবিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারেনা তাই এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তার উপর অব্যাহত থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বস্তরে ধর্মের প্রভাবকে কমানোর চেষ্টা, বিশেষ করে জামায়াত এবং মউদুদীর প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা। যেমন বলা যায় ১৯৫৪-তে সরকারি উদ্যোগে ‘ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক কালচার’ গঠন করা হয়। এর প্রধান করা হয় খলিফা আবদুল হাকিমকে যিনি সুফি ইসলামের অনুসারী ছিলেন। তিনি ইসলামকে কেবল ‘প্রেরণা’ হিসেবে দেখতেন এবং এর অনুশাসনকে অবশ্যপালনীয় বলে মনে করতেন না (খুরশিদ ১৯৮৪, ৩০০)। তার এই অবস্থান ছিল জামায়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত কারণ ইসলামের অনুশাসন অবশ্যপালনীয় জন্যই জামায়াত মানুষের মাঝে ইসলাম পালনের স্পৃহা তৈরি এবং এর মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।

১৯৫৭ সালের শেষদিকে মউদুদী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিগ্রহণ ছাড়া তিনি যে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যদিও খাতা-কলমে পাকিস্তান একটি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’, বাস্তব চিত্র হচ্ছে এটা পুরোটাই ভাওতাবাজি। মউদুদী যুক্তি দেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার বিকল্প নেই এবং এটা কোরান দ্বারাও সমর্থিত

 

১৯৫৭ সালের শেষদিকে মউদুদী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিগ্রহণ ছাড়া তিনি যে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যদিও খাতা-কলমে পাকিস্তান একটি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’, বাস্তব চিত্র হচ্ছে এটা পুরোটাই ভাওতাবাজি। মউদুদী যুক্তি দেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার বিকল্প নেই এবং এটা কোরান দ্বারাও সমর্থিত (সুরা ইসরা, আয়াত ৮০) (মউদুদী ১৯৭৪, ১২৩)। তবে তিনি এটাও বলেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পন্থাটি অবশ্যই সাংবিধানিক হতে হবে, অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে হতে হবে – কারণ শরিয়াহ রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য অসাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন করাকে সমর্থন করে না। তখন মউদুদীর এমন ধারণা ছিল যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জামায়াত এমনিতেই জিতে যাবে, কারণ পাকিস্তানের জনগণ ইসলামকে ভালোবাসে। একারণে তিনি তার নিজের রচিত মূল কর্মপন্থাকে পাশ কাটাতে তোয়াক্কা করলেন না, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিগ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে বলা হয়েছিল জনগণকে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কথা। তার এই সিদ্ধান্তে জামায়াতে ফাটল দেখা দেয় এবং জামায়াতের একজন প্রভাবশালী নেতা মাওলানা ইসলাহি দলত্যাগ করে তানজিম-এ-ইসলাম দল গঠন করেন। এছাড়াও দলত্যাগ করেন ড. ইসরার। দলত্যাগী নেতারা মনে করতেন নির্বাচনের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ জামায়াতের মূল কর্মপন্থার পরিপন্থী এবং দলের কর্মক্ষেত্রকে ছোট করে ফেলবে।

আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার শাসনামল (১৯৫৮-১৯৭১) এবং ১৯৭০ এর নির্বাচন

১৯৫৬ সংবিধান প্রণয়নের পরই সাধারণ নির্বাচন হবার কথা ছিল। কিন্তু ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার কারনে নির্বাচনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আইয়ুব মার্শাল ল’ জারি করলে জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়। ইসলামী দলগুলো মনে করতো যে আইয়ুব খান তাদেরকে নির্মূল করার জন্যই ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে ক্ষমতা গ্রহন করেছে। কারণ তারা মনে করতো নির্বাচন হলে ইসলামী দলগুলোর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল। এদিকে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ বন্ধ হলেও সামাজিক, ধর্মীয়, ও শিক্ষা কার্যক্রমের আড়ালে জামায়াতের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলো।

এই অভ্যুত্থান গোটা জাতির মনোযোগ ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের মাঝে আদর্শের লড়াই থেকে জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দিকে সরিয়ে দিলো। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই ছিল আইয়ুব খানের মূল লক্ষ্য (মতিন ২০০২, ১৮৪)। তিনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেন এবং প্রশাসনকে এই লক্ষ্যে ঢেলে সাজান। সেই সাথে তার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের সংস্কার সাধন এবং আধুনিকায়ণ। এর জন্য তিনি দু’টো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি হচ্ছে লাহোরে ‘ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক কালচার’। অপরটি করাচিতে ‘ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক রিসার্চ’। উভয় প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল ইসলামের ‘যুগোপযোগী’ ও ‘আধুনিক’ ব্যাখ্যা দেয়া এবং ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তা জনপ্রিয় করা।

এদিকে ১৯৬২ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় এবং সেখানে পাকিস্তানকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ এর পরিবর্তে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ রূপে ঘোষণা করা হয়। জামায়াত এর তুমুল বিরোধিতা করে। এছাড়াও জামায়াত সরকারের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতা, পাশ্চাত্যমূখী নীতি, এবং ইসলামবিরোধী জীবনধারাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার বিরোধিতা করে। কিন্তু জামায়াতের এইসব হুংকার কোনো কাজে আসছিলো না, কারণ উন্নয়নের যে ধারা আইয়ুব শুরু করেছিলেন তা দেশের কল্যাণে আসছিল এবং জনগণ সন্তুষ্ট ছিল। এবিষয়টি জামায়াতের বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। ততদিনে আইয়ুব দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে আরো কিছুদুর এগিয়ে নিয়ে যান এবং জামায়াত অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায় আইয়ুব খানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা জামায়াতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখো দেয়। এখন জামায়াত ও মউদুদী যতই বলুক যে শরিয়াহভিত্তিক অর্থনীতি সমাজে সাম্যতা আনবে ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে – তাতে জনগণ উৎসাহিত হবেনা। কারণ আইয়ুব সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে এবং জনগণ একটি সফল মডেল বাদ দিয়ে পরিক্ষীত নয় এমন একটি মডেলের জন্য পরিবর্তন চাইবে না। আইয়ুব বিরোধীতার জের ধরে জামায়াত ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে সকল ইসলামী দলের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে জিন্নাহ’র বোন ফাতেমা জিন্নাহকে রাজনৈতিক সমর্থন দেয়। কিন্তু এতেও ফাতেমা জিন্নাহ জিততে পারেননি। আইয়ুব ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজের পক্ষে নিয়ে যান।

এসময়ও আইয়ুব খান ধর্মীয় ইস্যুগুলোকে শিকোয় তুলে রাখতে সক্ষম হন। এমনকি ক্ষমতার চরম দূর্দিনেও তিনি ইস্তফা দেয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ধর্মীয় ইস্যু মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। তার সময় যে বিরোধ দেখা দেয় তা ছিল মূলত শহুরে জনগোষ্ঠীর মাঝে বেতনবৈষম্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে এবং এই সুযোগে উত্থান ঘটে বামপন্থী জুলফিকার আলী ভুট্টো’র পাকিস্তান পিপলস পাটি (পিপিপি) এবং সমমনা সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের সায়ত্ত্বশাসন দাবি করে বসেন। সবমিলিয়ে রাজনীতির অঙ্গন তখন দখল করে রেখেছিলো সমাজতান্ত্রিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো। এর মাঝে জামায়াতের কথা বলার কোনো সুযোগই ছিলোনা, বা তারা কথা বললেও কেউ শুনবে এমন অবস্থা ছিলনা।ে

আইয়ুব খান ইস্তফা দেয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং জামায়াত দেশকে ভুট্টোর মতো সমাজতন্ত্রীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য মধ্যম ও ডানপন্থী দলগুলোর সাথে জোট বাধে। ১৯৬৮ সালে জামায়াত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যের আহবান জানিয়ে সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারণায় নামে। কিন্তু এতকিছুর পরও ১৯৭০-এ পাকিস্তানের প্রথম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জামায়াতের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এই নির্বাচনে প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ।

 

আইয়ুব খান ইস্তফা দেয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং জামায়াত দেশকে ভুট্টোর মতো সমাজতন্ত্রীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য মধ্যম ও ডানপন্থী দলগুলোর সাথে জোট বাধে। ১৯৬৮ সালে জামায়াত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যের আহবান জানিয়ে সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারণায় নামে। কিন্তু এতকিছুর পরও ১৯৭০-এ পাকিস্তানের প্রথম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জামায়াতের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এই নির্বাচনে প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ। তারা ১৬২ আসনের মাঝে ১৬০টিতেই জিততে সক্ষম হয়। পশ্চিম-পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মাঝে পিপিপি পায় ৮২টি। জামায়াত সারাদেশে মাত্র ৪টি আসন পায় (পূর্ব-পাকিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধ, ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে ১টি করে)। এই ফলাফল জামায়াতের ইতিহাসকে বদলে দেয়। জামায়াত সবসময়ই নির্বাচনের পক্ষে ছিল এবং তারা সবসময় বলে এসেছে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জামায়াত অবশ্যই বিজয়ী হবে কারণ জামায়াত বিশ্বাস করতো যে মানুষ জাহেলি মতবাদের পরিবর্তে ইসলামকেই বেছে নেবে। নির্বাচনের আগের রাতেও মউদুদী এক ভাষণে বলেছেন যে জামায়াত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী শক্তি পরাজিত হবে। জামায়াতের মনোবলে এই নির্বাচন ছিল চরম এক আঘাত (মতিন ২০০২, ১২১)।

ভুট্টোর শাসনকাল, ১৯৭১-১৯৭৭

ভুট্টোর সময়ও জামায়াত তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠে (খুরশিদ ১৯৮০, ২৭৬)। ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নে পাকিস্তানের ব্যর্থতাকেই এর জন্য দায়ী করা হয়। ইয়াহিয়া খান ব্যক্তিজীবনে ইসলাম মানতেন না। এজন্য তার প্রচুর সমালোচনা হবার পরও জামায়াত ভুট্টোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে ইয়াহিয়ার পক্ষ নেয়। এর চেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে ১৯৭১-এ পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জামায়াত ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়েছিল। জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা এতটাই কমে যাচ্ছিল যে পরবর্তীতে ভুট্টোর জনপ্রিয়তায় ভাটা দেখা দিলেও জামায়াত সেটা কাজে লাগাতে পারেনি। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে মউদুদী ভুট্টোর সাথে লাহোরে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। তিনি ভুট্টোকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সমাজতন্ত্র পাকিস্তানের জন্য নয় এবং পিপিপি থেকে চরমপন্থী সমাজতন্ত্রীদের বাদ দেয়ার পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি সংবিধানে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনার কথা বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পুনর্বহাল, এবং কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এই মর্মে প্রজ্ঞাপন জারির অনুরোধ করেন। বিনিময়ে তিনি ভুট্টোর খসড়া সংবিধানে জামায়াতের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। ভুট্টো ১৯৭৩-এর সংবিধানে মউদুদীর সবগুলো অনুরোধ রেখেছিলেন এবং জামায়াত সেই সংবিধানকে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সমর্থনও জানিয়েছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই জামায়াতের ছাত্র সংগঠন জমিয়তে তলাবা’র সদস্যদের সাথে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের লোকদের কথা কাটাকাটির জের ধরে জামায়াত ও আহমদীয়াদের মাঝে গণ্ডগোলের সূত্রপাত হয়। পাকিস্তানে আরেকটি আহমদীয়াবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং এবার এর নেতৃত্বে থাকে জামায়াত। জামায়াত অন্যান্য ইসলামী দলের সহায়তায় এই আন্দোলন জোরদার করে তোলে। এতে সরকার বাধ্য হয় সংবিধানে সংশোধনী এনে আহমদীয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করতে। এসময় জামায়াত আবার জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এক হিসেব মতে সেসময় জামায়াতে যোগদানকারী নতুন সদস্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫০,০০০ (খুরশিদ ১৯৯০, ৮৯)।  এই সাফল্যের জের ধরে ১৯৭৬-এ জামায়াত শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের আন্দোলনে নামে। এবারও তারা সাথে পায় ইসলামী ও ডানপন্থী দলগুলোকে। ভুট্টোকে হটানোর জন্য তারা একমত হয় এবং সূত্রপাত হয় ‘নিজামে মুস্তফা’ আন্দোলনের। ১৯৭৭ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে পিপিপি’র বিরুদ্ধে গড়ে উঠে ডানপন্থী ও ইসলামী দলগুলোর মহাজোট ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল এলায়েন্স’ (পিএনএ)। কিন্তু নির্বাচনে আবারও ভুট্টো বিজয়ী হন এবং পিএনএ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। ভুট্টো এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে পিএনএ সর্বাত্মক আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয়। ভুট্টো আন্দোলন দমানোর জন্য পিএনএ’র বেশকিছু নেতাকে গ্রেফতার করেন। এতে ফল হয় উল্টো। আন্দোলন থেমে যাবার পরিবর্তে আরো বেগবান হয়। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ভুট্টো আবার যোগাযোগ করেন মউদুদীর সাথে। ১৯৭৭ এর ১৬ এপ্রিল আবারো তারা মিলিত হন লাহোরে। কিন্তু এবারের বৈঠক কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়। কোনোপক্ষই ছাড় দিতে রাজি না। বাধ্য হয়ে ভুট্টো মউদুদীকে গ্রেফতারের হুমকি দেন। পিএনএ জানিয়ে দেয় মউদুদীকে গ্রেফতার করা হলে গণবিদ্রোহ শুরু হবে। শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের অনুরোধে মউদুদীকে গ্রেফতার করা থেকে বিরত থাকেন ভুট্টো। তবে মউদুদীকে আমেরিকার চর বলে আখ্যা দেন এবং বলেন যে আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই মউদুদী একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। পাকিস্তানের এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ৫ জুলাই ১৯৭৭ যখন জেনারেল জিয়া-উল হক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে পাকিস্তানকে ‘সত্যিকার’ মুসলিম রাষ্ট্র বানানোর ঘোষণা দেন।

পড়ুন : প্রথম পর্ব