আমার অ, আ, ক, খ…. -দের প্রাণ আছে

আমার অ, আ, ক, খ…. -দের প্রাণ আছে

এই কথাগুলো যখন লিখছি, এর ঠিক দু’তিন মিনিট আগেও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে কিছু লেখার নিয়ত অন্তত ছিল না, কারণটা কিছুটা আবেগপ্রবণতা আবার অনেকটা অভিমানজনিত। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘটনায় কিছু কথা ভিতর থেকে বারবার আমাকে খোঁচা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তাই কথাগুলো নিজের মতো করেই বলে ফেলি। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে হঠাৎ এহেন সিদ্ধান্ত নিলাম, তা বলার ইচ্ছাটা একান্তই ব্যক্তিগত।

ফেব্রুয়ারি মাস নিয়ে দু’চারটি কথা না বললে মনের ভিতরের খচখচানিটা রয়েই যাবে। আমার এই ক্ষুদ্র পরিসরের পথচলায় যতটুকু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তাতে বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস বরাবরই বাঙালির কাছে শ্রেণিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আর্বিভূত হয়।

যেমন, উচ্চবিত্তের বিলাসী ভুবনে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আসে বসন্তের সূচনা, তারপরই বিশ্ব ভালোবাসার শত সহস্র আদিখ্যেতার চরম পরিণতির আঁড়ালে নিবদ্ধকৃত হয়ে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি বরাবরই পুঁজিবাদী আগ্রাসনে এ বিশেষ শ্রেণির কাছে একটা উৎকট উৎযাপনের বিষয়ে পরিণত হয়। আর হাড়-হাভাতেরা হাপিত্যেশ করতে থাকে এইসব দেখতে দেখতে।

কেন এভাবে বললাম?

একটু ভেবে দেখুন, উচ্চবিত্তের বিলাসিতার এক চরম পর্যায়ে আজ বাংলা ভাষা ও ভাষাকে ঘিরে গড়ে ওঠা ফেব্রুয়ারি ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে বিপুল আনুষ্ঠানিকতায়। ভাবনার জগৎ হাতড়িয়ে আপনি যখন আমার এই লেখায় চরম আগ্রহ কিংবা অনাগ্রহে চোখ বুলাচ্ছেন, ঠিক তখনি এই বিশেষ উচ্চবিত্ত শ্রেণির একাংশ ফুলের তোড়া আর মুখের হাজারো ফাঁকা বুলি আওড়ানোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

আপনি যখন আবার শুধু মার্ক্সীয় তত্ত্বে পূঁজিবাদের সংঙ্গায়নে ব্যস্ত, ঠিক তখনি পুঁজিবাদ তার সকল তত্ত্বের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে অদ্ভূত প্রকৃতির বিশেষ একটি শ্রেণির কাছে মাতৃভাষা প্রীতির এক মহা দৌরত্ম্যে পরিণত হয়েছে, হতাশার বিষয় এটাই, পুঁজিবাদ আর পুঁজিবাদীরা পুরো পৃথিবীকে যেভাবে শাসন করে চলেছে, তাতে পুরো পৃথিবী ক্রমশ উন্নত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পৃথিবীরই অংশ, বিশেষ শ্রেণির কতক বাঙালির কাছে এই  ক্রমশ উন্নতি বরাবরই “বিবস্ত্র তবু তথাকথিত বস্ত্রাবৃত আতিশয্যে” আবির্ভূত। মানে এই উন্নতি যতটা বাড়ছে তার চেয়ে ভয়াবহতা-সহিংসতা ও দারিদ্রতা আরও কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সহজ করে বললে ব্যাপারটা ঠিক এমন যে, সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির প্রত্যেকেই জানেন, আদৌও তাদের সাজানো-গোছানো ফাঁকাবুলির দৌড়, টক যুক্ত শো- এর দু’এক ঘন্টার চকচকে পরিবেশনাগুলোতেই শেষ হয়ে যাবে, যার শুরুটা হবে প্রথম প্রহরে বাহারি কতক তোড়া, অঞ্জলি নিবেদনের মধ্য দিয়ে। এর কিছুতেই কি আমজনতা পুঁজিবাদের আগ্রাসন দেখতে পেল? আমার মনে হয়, অর্ধেকাংশ ব্যর্থ হয়েছে এহেন আগ্রাসনের আক্রমন শনাক্ত করতে। বরং এটাকে রিচুয়াল বা রীতি হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এটা হয়েছে অবশ্যই মিডিয়ার কারণে।

আরও একটু ব্যাখ্যা করি,

উপরে যে টক যুক্ত শো- এর কথা বললাম, তার সঞ্চালনার পুরোটা জুড়েই থাকবে মিনিস্টার ফ্রিজ, ভিশন এলইডি টিভি ওয়ালাদের আরাধ্য অনুপ্রবেশ, মাঝখানে নেসক্যাফে কফির পেয়ালায় গোটা দশেক চুমুক তারপর এটা সেটা করতে হবে, অমুক তমুক উদ্ধার করার মাঝখানে কখনো কখনো বিরতিও আসবে।

বিশেষ দিনে এহেন লোকদেখানো আতিশয্যের আড়ালে যে পুঁজিবাদী আগ্রাসন কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা একটু ভাবলেই টের পাবেন, যখন এহেন টকশো উপভোগ করেই পরদিন মুখোমুখি হবেন ‘ইনট্রোডিউস ইউরসেল্ফ’ প্রশ্নটির।

হ্যাঁ, বলছিলাম, রুজি জোগানোর জায়গাগুলোর বেশিরভাগেই এহেন অবস্থার সম্মুখীন আপনাকে হতেই হবে। এভাবেই আপনার চারপাশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনটা হয়েছে। এর পিছনে আমি চিৎকার করে বারংবার অন্ধ পুঁজিবাদকেই বহুলাংশে দায়ী করবো, কেননা, ওই পুঁজির খোঁজেই আজ সালাম, বরকতের রক্তে রঞ্জিত আমার অ, আ, ক, খ.. গুলো প্রাণ হারিয়ে ফেলছে প্রতিনিয়ত। পরানুকরণ আর অন্ধ মনোজগতে আমরা যেন এক একটা জীবন্মৃত সারশূন্য জীবে পরিণত হয়েছি। আর নিজের মাতৃভাষা পরিণত হয়েছে ঠাট্টা, বিদ্রুপ আর ভাড়ামী প্রকাশের মুখ্যম মাধ্যমে।

বাংলা ভাষা, এর সাহিত্যরস আর বাঙালির অস্তিত্বকে শিকড় থেকে অনুভব করতে পারা এবং তা আমজনতার উপলব্ধিতে আনার মতো মানুষ যদি এই বাংলার মাটিতে এখন আর খুব বেশি নাই। এই ভাষা এতোদূর এসছে আসলে সাহিত্যের উপর ভর করে। এই ভাষার ঝুলিতে আছে নোবেল। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদের মতো ব্যাপক সৃজনক্ষমতার অধিকারীরা এই ভাষাকে অবলম্বন করে সাহিত্য করেছেন। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে কায়েম হওয়ার পরেও কলকাতার ভাষাভঙ্গি ও সাহিত্যের যে মাস্তানি আমাদের উপর জারি হয়েছে তার বিরুদ্ধে  আমাদের ব্যাপক সৃজনক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবার মতো লেখক হাতে গোনা। আহমদ ছফার মতো কিছু লোক চেষ্টা করেছেন। যদিও তাদের সাহিত্য ও চিন্তার স্তর পশ্চিমা আলোকায়ন ধারণার বাইরে পৌঁছাতে পারে নাই। কিন্তু তাদের দরদ ও আন্তরিকতার কথা স্বীকার করতে হবে।

কি খুব গর্ববোধ করছেন এ কথা শুনে?

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠটাও দেখে নিবেন তাহলে গর্ববোধ হতে গর্ভবতীতে পরিণত হতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। মুদ্রার উল্টোপিঠেই দেখবেন ভাষা হিসেবে বাংলা যতখানি সমৃদ্ধ, ততখানির ধারেকাছেও এর সাহিত্যকে নিয়ে যেতে পারি নি আমরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, চেতনাবাজির ফুলকো তৈলের আঁড়ালে প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা নিজের অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে তবু আমরা বিশেষ দিনে এক একজন আপাদমস্তক বাঙালিরূপে আবির্ভূত হয়ে সকল দায়িত্ব পালন করে ফেলছি ভেবে তৃপ্ত হয়ে যাচ্ছি।

প্রতিবছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ২১ তারিখে “সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন” নামক হাজারো বুলি আওড়ানো হচ্ছে, তারিখটা পাল্টে ২২ হলেই সমাজের যে উঁচু শ্রেণির কথা শুরুতেই বললাম, তাদের কাছে বাংলা আওড়ানো নির্বোধ বালক বা বালিকাটি বরাবরের মতোই পিছিয়ে থাকা ভোতা বাঙালি বলেই হয়তো বিবেচিত হবে, আর এটা এতটাই হাস্যকর রূপ পাবে তখন, যখন অনর্গল বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি পাকানো কিংবা সাহেবদের ভাষা ইংরেজি আওড়ানো ছেলেটিই যোগাযোগে পারদর্শী, দক্ষ, ব্যক্তিত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় সুবোধ বালক বা বালিকায় পরিণত হবে। এ সবই বছরের অন্ততপক্ষে ৩০০টি দিনের বাস্তবতা, না মানতে চাইলেও একটু ভাবলে মেনে নিবেন আপনিই।

এখনো বাংলা ভাষার অনুবাদশৈলীকেও আশাব্যঞ্জক কোনো অবস্থানে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা, নেই এহেন কর্মকাণ্ডে জোরালো কোনো পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকিটাকি যা হয়ে ওঠে, তবুও তা পাঠকমহলে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেকটা অতলেই তলিয়ে যায়।

ভাষার এহেন ভগ্নদশার জন্য যেমন ব্যক্তিমানুষগুলোর আহম্মকি, তথাকথিত চেতনাবাজি কিংবা পুঁজিবাদী আগ্রাসন অনেকাংশে দায়ী, তেমনি দায়ী এ দেশের আর্থ-সামাজিক নানাবিধ সংকট। যার ফলশ্রুতিতে ভিনদেশি বুলি স্থান পেয়েছে বিশেষ যোগ্যতার মাপকাঠিতে।

এই সংকট উত্তরণের পথ তখনি উদ্ধার করা সম্ভব হবে যখন এ দেশের তরুণ সমাজ বৈদেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় সংস্কৃতির আঁড়ালে ব্যক্তিসত্ত্বার শিকড়কে খুজে নেয়ার চেষ্টাটা করবে। এ জন্য অবশ্যই তরুণদের প্রত্যাশার মান ও মননকে উৎসাহিত করে এরূপ সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোকে সামনে আনার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি, এক্ষেত্রে উজ্জ্বীবিত তরুনসমাজই রাখতে পারে অগ্রনী ভূমিকা।

পাশাপাশি বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তদ্রুপ অপরাপর ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা প্রদর্শণ করার মানসিকতা তৈরি করাটা জরুরি তবে তা করতে গিয়ে যদি নিজের সম্পদকে সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়, তবে তা বিশেষ দিনের জন্যে “বিবস্ত্র কায়ায় বস্ত্রবিলাসিতায়” পরিণত হবে বরাবরের মতোই। আর তাতে ‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন’ এর বদলে ‘সর্বস্তরে বাংলার বস্ত্রহরণ’ টাই বেশি হবে।

নিজের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে কিংবা সাহেবদের দলভুক্ত করার নিমিত্তে তাকেই ধ্যান, তাকেই জ্ঞান ভেবে বাবুয়ানা ফলানোর মাঝে কৃতিত্ব এমনিতেই নেই, তার উপর আবার যখন বাংলা ভাষার কাণ্ডারি হওয়ার ভান করে পুরোদস্তুর ২১ প্রীতি দেখানো হবে, তখন তা নেহাতই কৃত্রিমতার চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে।

একইভাবে, ঘন্টার পর ঘন্টা টকশো, সেমিনার করে ‘বাংলাকে সর্বস্তরে প্রচলন’ নামক স্লোগানে আশপাশের বায়ু গরমের জোগাড় করে, দিন পেরোতেই ভিনদেশিদের আওড়ানো বুলি আওড়ানোকে বিশেষ যোগ্যতার কাতারে ফেলতে যদি দ্বিধাবোধ না হয়, তবে ফলাফল উপরে বর্ণিত পরিস্থিতির মতোই হবে। মধ্যবিত্ত সমাজ সবসময়ই দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যবিত্ত ভেবেই জীবন পার করে দিতে অভ্যস্ত থাকে, আবার তারাই অনভ্যস্ত কিছুর শুভসুচনা করে জাতির ক্রান্তিলগ্নে।

পরিশেষে দু’একটা কথায় শেষ করবো, অপরাপর সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষাগত উপাদানগুলোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত সর্বাবস্থায় তবে খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন মাত্রাকে অতিক্রম করে ফেলে দৈনন্দিন জগাখিচুড়িতে পরিণত না হয়। আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা হয়েছে বলেই, আমরা না পেরেছি শুদ্ধভাবে বাংলাটাকে লিখতে, পড়তে, বলতে; না পেরেছি অন্য একটি ভাষাকেও যথাযথভাবে, যথাস্থানে ব্যবহারের নিয়মাবলি অধিগত করতে। যদিও আজ পর্যন্ত তাদের উত্তরসুরীরা বিশেষ দিনে ফুলের বাহারি রঙের তোড়া ছাড়া খুব কমকিছুই প্রতিদান কিংবা অঞ্জলি হিসেবে দিতে পেরেছে।

ব্যক্তি আমি নিজেও এ দায়মুক্ত নই। এ দায় চিরদিন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে প্রতিনিয়ত, যতদিন না আত্মায়, মননে, চিত্তে স্বাধীন হয়ে উঠতে পারছি আমি, আমরা।

“ভালো থাকুক অনেক দাম দিয়ে কেনা,

আমার অ, আ, ক, খ….”