বেহায়া মনা ভালোবাসা, জাতীয় দলের দুরাবস্থা!

বেহায়া মনা ভালোবাসা, জাতীয় দলের দুরাবস্থা!

বর্তমান সময়ে বাউল গানের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী শামসেল হক চিশতী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ সূর্য সন্তানের অন্যতম সৃষ্টি ‘বেহায়া মন’। যার জেরে অনেকেই তাকে বেহায়া মন শিল্পী বলেও ডাকেন। বলা বাহুল্য ভালোবেসেই এ সম্মোধন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে খেলতে দেখে আজকে আচমকা এ গানটির কথা মনে পড়ে গেল। কেন, সেটি বরং ব্যাখ্যা করি।

এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে বেহায়া মন গাবার পরে শ্রদ্ধেয় শামসেল হক বলেছিলেন ভালোবাসার ক্ষেত্রে বেহায়া হওয়া দোষের না। কেন যেন মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নির্বাচকরা সে অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন এবং উনার সে মন্তব্যটিকে অন্তরের গভীরে স্থান দিয়ে বসে আছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ান ডে সিরিজ শেষ হবার পরে আমার ধারণাটি আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।

নিউজিল্যান্ড সফর বাংলাদেশের জন্য বরাবরই কঠিন বলে প্রমাণিত। এবারের সিরিজ শেষে যেটি আরো স্পষ্ট হয়েছে। খেলার ফলাফল এতক্ষণে সবাই জেনে গিয়েছেন তাই সেটি নিয়ে কথা বলে বাহুল্য বাড়াবো না। আমি কথা বলতে চাই দল নির্বাচন নিয়ে যেটি বহুদিন ধরেই স্বেচ্ছাচারিতার মুখোমুখি।

কিউই সফরে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ টপ অর্ডারের ব্যর্থতা। এদের একজন এতটাই অসাধারণ যে, গেলো বিপিএল’এ তার ফ্রাঞ্চাইজিই তাকে বসিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল! অপরজন নসিহত করছেন নয়া কিসিমের ধারাবাহিকতা। তিন ইনিংসেই তিনি ফিরেছেন এক রান করে! কিন্তু দিনশেষে কাউকেই বাদ পড়তে দেখা যায় না। ব্যাটসম্যান আউট হবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা হয় সেটি হচ্ছে আউট হবার ধরণ। যে ভঙিমায় তারা আউট হন, তা অন্যদেশে হলে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিয়মিত খেলা তো দূর, আর কখনো বিবেচিত হতেন কি না সন্দেহ। অথচ, তাদের প্রেমে বেহায়া হয়ে নির্বাচকরা উপেক্ষা করে চলেছেন বিশ্লেষকদের।

হ্যাঁ, বিশ্লেষকদের মত নিয়েই যে দল গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু বেহায়া ভালোবাসায় দলের বারোটা বাজানোর চেয়ে বিশ্লেষকদের মন্তব্য, তা যদি দলের উপকারে আসে, সেটি আমলে না নেয়াও হতাশা জনক। আমরা প্রতি সিরিজ শেষে নির্বাচকদের ব্যাখ্যা চাই না; আমরা চাই যাদের দলে নেয়া হয়ে তাদের হয়ে কথা বলুক তাদের ব্যাট-বল। সেটি অনুধাবনের মত কেউ নির্বাচক প্যানেলে আছেন বলে মনে হয় না।

এই নওবাত নয়া না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নির্বাচকের খেয়ালে আমরা এমন কিছু খেলোয়াড়কে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেখি যাদের উপর তাদের ক্লাবই ভরসা করতে ভয় পায়। সুভাগত হোমের কথা তো ইয়াদে থাকার কথা। আমাদের নির্বাচকরা আচমকাই এক ব্রত নিলেন তাকে অলরাউন্ডার সাবুদের জন্য। অনেকেই এখনো দ্বিধান্বিত যে, তিনি আসলে কি হিসাবে জাতীয় দলে খেলেছেন?

এই তালিকাটা কিন্তু খুব ছোট না। বিভিন্ন সময়ে বিচিত্র সব ব্যাখ্যায় দলের অংশ ছিলেন তানভীর, ফরহাদ রেজা, মোশাররফ রুবেলরা। অপরদিকে বিনা ব্যাখ্যাতেই বাতিলের কাতারে চলে গিয়েছেন আল আমিন, আব্দুর রাজ্জাক, শাহরিয়ার নাফিসরা। তুষার ইমরান তো হয়ে থাকবেন অভাগার অপর নাম হয়েই। নির্বাচক পদে বসলেই কেমন যেন বেবোধ হয়ে যান সবাই। নিজের চিন্তা সঠিক প্রমাণের প্রয়াসে বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন দলের।

শুরু থেকেই আমাদের জাতীয় দল খেয়াল খুশির এক জায়গা যেন। কেউ কেন দলে আসেন, কেন উপেক্ষিত থাকেন কেনই বা বাদ পড়েন তা নিয়ে কঠিন প্রশ্ন তুললেই হলো, জবাব তো পাবেনই না, বক্রবাক্যে বিদ্ধ হতে হবে আপনাকে। নিউজিল্যান্ড সফর কি পরীক্ষা নিরীক্ষার জায়গা? চূড়ান্ত অফ ফর্মে থাকা খেলোয়াড়দের কি জন্য এখানে নামিয়ে দিতে হবে? যদি নির্বাচকরা বলেন যে পাইপ লাইনে যথেষ্ট মজুদ নেই, তাহলেও প্রশ্নটা তাদের দিকেই যায়, নেই কেন?

যে পক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের দল নির্বাচন করা হয়, তাতে কেউ কি করে বুঝবে যে কি করলে সে দলে ঢুকবে? ইমরুল তো এ সফরের আগে প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন যে, তিনি এটা বুঝতেই হিমশিম খান যে কেন তিনি বাদ পড়লেন, কি করলেই বা দলে ঢুকবেন? জাতীয় দলে নিয়মিত খেলা একজনের যখন এই হালত, তখন যারা জাতীয় দলের অন্দরই দেখেননি তাদের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়। ঘরোয়া আসরগুলো হবার কথা জাতীয় দলে ঢোকার প্রবেশ পথ। আমাদের এইখানে কি সত্যিই তা হয়?

আমার সমালোচনায় বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন, যে সবকিছু ঠিক মত চলছে? নির্বাচকরা ঘরোয়া আসরের মানের দোহাই দেন, তা আপনারা বিসিবি’কে মান নিয়ে অসন্তোষ্টির কথা জানান না কেন? যদি তারপরেও বিসিবি উদ্যোগ না নেয় সংবাদ মাধ্যমে সেটি জানিয়ে পদত্যাগ করুন। সেটি করার মত বুকের পাটা আপনাদের নাই, এইটাই নির্মম সত্য।

বাংলাদেশ রিস্ট স্পিনে বরাবরই দূর্বল। এটির অন্যতম কারণ আমাদের মাঠে রিস্ট স্পিনার না থাকাটা। লিখনের মধ্যে অমিত সম্ভাবনা ছিলো। তিনি নিজে যেমন ভুল করেছেন তেমনি তার সঠিক যত্ন হয়নি এটাও তো সত্য। জাতীয় দলের স্বার্থে নির্বাচকদেরই উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিলো তিনি যে ক্লাবে খেলছেন তাতে যেন নিয়মিত সুযোগ পান সে ব্যবস্থা করা। কথাটি অদ্ভুত ঠেকতে পারে, কিন্তু বাস্তবটা খেয়াল করুন। আমাদের এখানে রিস্ট স্পিনারদের বেড়ে উঠার সুযোগ দেয়া হয় না, অথচ, জাতীয় দলে একজন ভালো মানের রিস্ট স্পিনার বোলিংয়ের বৈচিত্র বাড়ায়। সেটি মাথায় রেখে উদ্যোগটির কথা বলছি।

বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি যাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে তাদের অপরিপক্ক অবস্থায় মাঠে নামিয়ে দু’দিন পরেই ছুড়ে ফেলে দিতে। শরীফ, তালহারা যার শিকার। জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়ার পরে জাতীয় দলে ফেরার প্রক্রিয়াটাও তাদের বলা হয় না। অপর দিকে কয়েকজনের ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পুর্ণ ভিন্ন চিত্র। যারা বাদ পড়ার পরে ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো ম্যাচ না খেলেই ফিরে আসেন দলে। এটি একটি চূড়ান্ত রকমের বাজে প্র্যাক্টিস, যা খেলোয়াড়দের জন্য ক্ষতিকর।

বর্তমান ওয়ান ডে দলের অধিনায়ক মাশরাফিই তো এর শিকার। এগারোর বিশ্বকাপে তিনি পনেরো জনের স্কোয়াডেও কেন জায়গা পাননি তার ব্যাখ্যায় নির্বাচকরা যা বলেছিলেন তা কি তারা নিজেরা বিশ্বাস করেছিলেন? এখনো, মুশফিক বা মাহমুদুল্লাহ কয়েক ম্যাচ খারাপ খেললেই গেল গেল রব উঠিয়ে দেন নির্বাচকরাই। অপর দিকে যারা সত্যই যাবার মতন তাদের পক্ষে যুক্তির ঢাল তুলে রক্ষায় হয়ে পড়েন ব্যতিব্যাস্ত!

গেল কয়েকটি সিরিজ খেয়াল করুন। কয়জনের অভিষেক হয়েছে মনে রাখতেই হিমশিম খাবেন। কে ঢুকছে, কেন ঢুকছে, কেনই বা পরের ম্যাচে বাদ পরছে ব্যাখ্যা নেই। খোলা চোখে দেখে যা মনে হয়, যাদের তারা দলে চাননা; তাদের কেউ ব্যর্থ হলেই নতুন কাউকে বাজিয়ে দেখা হচ্ছে। তারা যখন ব্যর্থ হচ্ছে অনোন্যপায় হয়ে ফিরিয়ে আনছেন বাদ পড়া ব্যক্তিকেই। এটা জাতীয় দল নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয় কি করে?

যে গানটির জিকর করে লেখাটি শুরু করেছি, তার একটি লাইন হলো, “তুই যতই ব্যাথা দিয়েছিস নিঠুর, ব্যাথার পরিবর্তে সেথা লেগেছে মধুর…”এ বাক্যটি কোন প্রেমিকের মুখে শুনতে খারাপ লাগে না। নির্বাচকরা যদি এতে মজে গিয়ে থাকেন তবে বিপদ। কেন যেন মনে হয় তারা এতে বেশ ভালোই মজেছেন। তাই বেহায়া ভালোবাসায় যাদের ক্রমাগত সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ব্যর্থতার পর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কঠোর সমালোচনাও তাদের মধুর ঠেকছে। নতুবা, এমন দল নির্বাচনের তো মানে নেই, বিশেষ করে সামনে যখন বিশ্বকাপ।

নিউজিল্যান্ড সফরের ব্যর্থতায় বিশ্বকাপেও বেইজ্জুতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। সেটি হবে ভিন্ন কন্ডিশনে, ভিন্ন পিচে। আর বিশ্বকাপ সামনে রেখে প্রস্তুত হবার জন্য যথেষ্ট সময়ও পাওয়া যাবে। কিন্তু সব আশাই হতাশায় পরিণত হতে থাকবে যদি এ বেহায়া প্রেম বন্ধ না হয়। এ সফর থেকে নির্বাচকরা শিক্ষা নিয়ে যোগ্যতা দিয়েই দল গঠন করবেন বলে আশা করি, প্রেম দিয়ে না।