উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রাম

উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রাম

প্রথমে ভেবেছিলাম লিখবো না, পরে লিখবো না, লিখবো না করেও পারা গেলো না, কিছু কথা মাথার ভেতরে ক্রমশ যন্ত্রণা করে যাচ্ছে, না লিখলে মনে হয় শান্তি নাই। তাই অগত্যা লিখতে হলো। আসলে কি লিখবো, কি লেখার বাকি আছে কাশ্মির নিয়ে— এক কাশ্মির কতো লেখক, গবেষক আর পর্যটক’র বিবরণে নিজের দূর্দশার বাণী বিলি করে যাচ্ছে কতো কতো বছর ধরে। ঠিক ফিলিস্তিনের মতো। কিন্তু মুক্তির আলোর ইশারা কই? মুক্তি নাই!! এই কথা অনেককেই আহত করবে আমি জানি কিন্তু অন্ততপক্ষে আগামী সত্তর বছরেও প্রয়োজনে আরো নিরীহ শহিদে ভরে যাবে ভূস্বর্গ কাশ্মির, হয়তো আরো ক্যাজুয়ালটি লিস্ট হবে ভারতীয় সেনা শিবিরে। কিন্তু কাশ্মির আজাদ হবেনা এই অবস্থা চলতে থাকলে।

কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আপামর ভারতীয় জনতা কাশ্মির স্বাধীনতার অধিকার এবং এর ন্যায্যতা স্বীকার করে দখলদার রাষ্ট্রশক্তিকে বাধ্য করতে না পারবে ততক্ষণ মুক্তি নেই। এবং মুক্তি না আসা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

এখন আসুন এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে আমরা উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রের সাথে তার নাগরিকদের সম্পর্কের ব্যাপারটা একটু দেখি। ‘উত্তরাধুনিক’ এই টার্মটার সাথে অন্য অনেক তরুণের মতো আমিও সম্প্রতিই পরিচিত হলাম। কি এই উত্তরাধুনিক যুগ বা রাষ্ট্র?

এটা জানার জন্য আপনি ৭০ এর দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনগুলো দেখেতে পারেন। মূলত ১৯৭৯ সালে লিওটার্ড এর ‘পোস্টমর্ডান কন্ডিশন’ বইটি প্রথম উত্তরাধুনিকতার বিস্তারিত অবস্থা আমাদের সামনে তুলে ধরে। এর পরে ফুকো-দেরিদার যে চিন্তাশীল লেখা-লেখি তার মধ্যে দিয়ে গোটা ভাবনার জগতটাই আধুনিকতার কালপর্বকে পরিসমাপ্ত ধরে নিয়ে উত্তরাধুনিকতায় প্রবেশ করে। ফলে উত্তরাধুনিক অবস্থায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়।

উত্তরাধুনিক চিন্তায় ‘স্বাধীনতা’ ধারণাটিকে কীভাবে দেখা হয় তা সংক্ষিপ্ত আকারে বললে এমন হয়— “মানুষের স্বাধীন পছন্দ বা মানবাধিকার এর উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিলো আধুনিক রাষ্ট্র, কিন্তু উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রের হইতেছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। যেখানে আপনার পছন্দের স্বাধীনতা, পছন্দের অধীনতায় রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ এখন আপনি পছন্দ করতে বাধ্য, না করে উপায় নাই, এটাকেই ইউরোপীয় জবানে বলা হইতেছে উত্তরাধুনিক যুগ। এখন এই ব্যাখ্যা অনুসারে দেখেন ভারতের যে সাধারণ নাগরিক, তার পক্ষে হালের হামলার পক্ষে অথবা বিপক্ষে এই দুই-এর একটা নিতে হবে। এই বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব না। ফুকো কীভাবে বন্দিশালা ও তাদের শাসন করার পদ্ধতিটি দেখিয়েছিলেন তা পাঠকরা দেখতে পারেন। এই যে রাষ্ট্র আইন বা নিয়মের নামে আসলে স্বাধীনতার গাল ভরা আওয়াজের মধ্য দিয়েই মানুষকে পরাধীন করে রাখে।  এর জন্য কৌশলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও মান্যতার সংস্কৃতি সমাজে পয়দা করা হয়। যা আসলে নাগরিকদের অধিকার হরণের হাতিয়ার। উত্তর আধুনিক যুগে রাষ্ট্র ও রাজনীতি চিন্তার পুরো ব্যাপারটিই বেশ পাল্টে গিয়েছে। এটা নিয়ে আজ বিস্তারিত আলোচনা না করে কাশ্মিরে ফিরছি।

এখন সন্ত্রাস, আর স্বাধীনতাকামী এই দুইয়ের মধ্যে একটা প্যাঁচ লাগতেছে। পশ্চিমারা সন্ত্রাস বলে যেটারে দুনিয়াব্যাপী চালানোর চেষ্টা করতেছে, এই বক্তব্য ধরে আপনি এগুলো, দুনিয়ার সব সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রচলিত প্রতিরোধ আপনার কাছে সন্ত্রাস মনে হবে।

 

ভারতের সেনাদের সাথে যা ঘটল তাতে নাগরিকরা একটা সংকটে পড়ছে। কারণ ভারতে যে স্বাধীনতা নগরিকদের জন্য বরাদ্ধ তা একটা ফোর্স ফ্রিডম, সে চাইলেই এটার মাঝামাঝি বা নীরব থাকতে পারছেনা। সে পক্ষে গেলে জাতীয়বাদী আর বিপক্ষে গেলে বা এই ঘটনার মূল গোঁড়ায় হাত দিলে হয়ে যাবে এন্টি-ন্যাশনালিস্ট। মোটামুটি এই ধারণা সেখানে বেশ ভালোভাবে ইমপ্লিমেন্ট করা হয়েছে। এটা করতে কিছুটা অবদান রাখছেন তথাকথিত বড় বড় তারকারাও। এর মধ্যে আছেন অক্ষয় কুমারও। এই অসুস্থ জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডার বড় এম্বাসেডর আমার তাকেই মনে হয়। সেনা নিয়ে বেশি বিজ্ঞাপনে সেই মডেলিং করেছে। কাজেই আপনারা দেখবেন বর্তমান অবস্থায় ভারতীয় অনেক সেলিব্রিটি রাষ্ট্রের সুরে সুর মিলায় পাকিস্তান দোষারোপ ফেনোমেনায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশেও একই ঘটনা দেখবেন। তরকারা এইসব ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের স্তাবক হয়ে ওঠেন। তারা নির্দিষ্ট কোন সমাধানের কথা বলতে পারতেছেনা। কামাল হাসান ব্যতিক্রম, তবে বলার পর তার বিপক্ষে আবার শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। সম্প্রতি ভারতীয় নানা পত্রিকার বরাতে আমরা দেখলাম, সাম্প্রতিক বোমা হালমলার ঘটনায় জড়িত ‘দার’ তার যুবক বয়সেই ভারতীয় স্পেশাল ফোর্স দ্বারা নিগ্রহের স্বীকার হয়েছেন। আমার ধারণা, এই অবস্থা কাশ্মিরের সব পরিবারের কারো না কারো সাথে ঘটেছে। মজলুমের এইক্ষেত্রে প্রতিরোধের আর কি ব্যবস্থা বাকি থাকে।। অথচ এই আলাপ কোন বুদ্ধিবৃত্তিক মহল থেকে শোনা যাইতেছেনা, তারা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্যাটার্নে নিয়ে আলাপ করতেছেন। এর কারণ হলো, উত্তরাধুনিক জমানায় তার কাছে চয়েস নাই, রাষ্ট্রের বিপরীতে যাওয়ার, এই  ক্ষেত্রে সে বিসর্জন দিতেছে তার ভাব-ভাবনা, তার মানুষ সত্ত্বার এবং সর্বোপরি কাশ্মিরের নিপীড়িত জনগণের অধিকারের প্রশ্ন।এর বিপরীতে দাঁড়ানো মানে প্রতিরোধ, বিপ্লব যার সাম্রাজ্যবাদী নাম সন্ত্রাসে গিয়ে দাঁড়াইতেছে। এখন সন্ত্রাস, আর স্বাধীনতাকামী এই দুইয়ের মধ্যে একটা প্যাঁচ লাগতেছে। পশ্চিমারা সন্ত্রাস বলে যেটারে দুনিয়াব্যাপী চালানোর চেষ্টা করতেছে, এই বক্তব্য ধরে আপনি এগুলো, দুনিয়ার সব সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রচলিত প্রতিরোধ আপনার কাছে সন্ত্রাস মনে হবে, আসল কথা হল, এইটা কারো মননে থাকলে পরিহার করেন। কারণ, এই ধারণায়, ফিলিস্তিনি, কাশ্মিরিসহ সকল নিপীড়ত জাতিই সন্ত্রাসী, কিন্তু আসলে কি তাই?? আমরা জানি সেটা সত্য নয়। ফলত সন্ত্রাস আর স্বাধীনতার সংগ্রামের এই পশ্চিমা ফেনোমেনা ঝেড়ে কথা বলার সময় এসেছে। আপনার বুদ্ধি এই তাগিদ অনুভব না করলে তার প্রতি আমার করুণা থাকবে। এইক্ষেত্রে পশ্চিম অনেকখানি সফলও বলা যায়, আজ এই সময়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অদৃশ্য একটা দৈত্য আমাদের ঘাড়ে ভর করে। এটাই এর ইমপ্যাক্ট। সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ক্ষেত্রে এই যুক্তি পশ্চিম ব্যবহার করে আসতেছে বহু কাল ধরে। সন্ত্রাসবাদ কি, এর ডেফিনেশন আর ধরণ-ধারণ আরেক আলোচনা, এই ব্যাপারে বাংলায় ভালো কাজ খুব একটা নাই।

এইক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটা হতে হবে কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্রের যে ন্যারেটিভ সেটাকে প্রোটেস্ট করা তারপর আপনি পরের আলাপ এ যাইতে পারেন। এবং এই কাজটা ভারতীয় বিবেক, তরুণদের মাধ্যমে হওয়ার প্রয়োজনীতা আছে বলে আমি মনে করি।

 

পশ্চিমের আইডিওলজি দিয়ে পশ্চিমকে পাঠ করার চেষ্টা না করাই উত্তম। ফলত ভারত রাষ্ট্র এই নাগরিক মতের দোহায়ে তার বলপ্রয়োগের একটা বৈধতা হাসিল করে নিতেছে, এবং দুনিয়ার সামনে ম্যাসাকার এর আরেকটা কারণ হাজির করতেছে। যেমনটা পৃথিবীর প্রায় বড় শক্তিগুলা করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে আপনি, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, আফগান, লিবিয়া, সিরিয়া আগ্রাসনকে ধরতে পারেন।। রুশের আগ্রাসন, চীনে উইঘুরদের বিপক্ষে আগ্রাসন, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন সব দেখতে পারেন। জিজেক তার এক আলেচনায় বলছিলেন, ইউরোপে হাল আমলে ইমিগ্র্যান্টস এর বিরুদ্ধে ডানপন্থার সরবের বিপদ হচ্ছে এটা স্টেটকে এমারজেন্সির দিকে প্রভোক বা ফোর্স করবে এবং সেটা হলে ফলাফল কারো জন্যই বেটার হবেনা। তাই কাশ্মির নিয়ে আলোচনায় উপরের আলাপ অনেকের কাছে অ্যাবসার্ড বা অপ্রাসঙ্গিক  ঠেকতে পারে, তাদের জন্য বলি এই আলাপ ধরে না এগুলে কাশ্মির সমস্যার চিরস্থায়ী কোন সমাধান হবেনা আসলে। এইক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটা হতে হবে কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্রের যে ন্যারেটিভ সেটাকে প্রোটেস্ট করা তারপর আপনি পরের আলাপ এ যাইতে পারেন। এবং এই কাজটা ভারতীয় বিবেক, তরুণদের মাধ্যমে হওয়ার প্রয়োজনীতা আছে বলে আমি মনে করি। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি এমন যেকোনো স্বাধীনতাকামী জাতির একটা হেল্পিং হ্যান্ড এর প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের উদাহরণও  এইক্ষেত্রে নিতে পারেন। এখন কাশ্মীর এর ক্ষেত্রে দেখতে হবে এই হেল্পিং হ্যান্ডটাকে বাড়ায়? যেহেতু তার প্রতিবেশীদের উপর ভরসা নাই। তাই আমি খোদ ভারতীয় জনগণের নিকট এই আব্দারের কথা হাজির করলাম। অন্যথায় আপনি একটি আধুনিক অস্ত্রে, প্রযুক্তিতে, স্বসজ্জিত বাহিনীর সামনে একদল মানুষকে কি করে লড়াই এর কথা বলতে পারেন? আমরা তো ফিলিস্তিন দেখতেছি, ইনতিফাদা, পাথর কোনটাই ইজরাইলি কামান, স্নাইপারের সামনে কিছু না। আর মানবতা, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস এসবের আলাপে না যাই। তো এইখানে তাদের নিরস্ত্র প্রতিরোধটারে আমি ছোট করতেছিনা বাট এটাকে আরেকটু বলবান এর কথা বলতেছি। অন্যথায় শহীদের সংখ্যাই বাড়বে কেবল। আর আধুনিক পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিবেকের কাছে এটা কোন মাইনেই রাখেনা, শেষমেশ তারা শুধু স্মরণ ও শোকসভায় বেঁচে থাকে। অনেকেই প্রশ্ন করেন ভারত এতো বিশাল রাষ্ট্র একটা কাশ্মির ছেড়ে দিলে কি আসে যায়।

তাদের মনে রাখা দরকার এটা ভারত কোনদিন করবেনা, যেমন ইতিহাসে গ্রীস সাম্রাজ্য করেনি। এক স্পার্টাকে ম্যাসেজ দিতে গিয়ে লুটিয়ে দিয়েছিলো পুরো মেলোস। এইটা হবে তার অশনিসংকেত বা ভাঙ্গনের যাত্রা, কারণ কেবল এই এক কাশ্মির এইটা সফলকাম করতে পারলে ভারতের অভ্যন্তরে এমন আরো ঘুমিয়ে থাকা কয়েকটি কাশ্মির জেগে উঠবে। এবং এটাই গোটা সাম্রাজ্যের জন্য ভয়ের, এই ভয়ের কারনেই যুক্তরাষ্ট্রের হাজার মাইল উড়ে এসে কাবুলে বোমা হামলার দরকার পড়ছে। এটা হলো দূর্বল মিত্ররে পিষে শত্রুদের এবং বাকি স্বাধীনতাকামী পক্ষকে হুশিয়ারির ধরণাটা জানন দেয়া। এটা পরিস্কার করে বলে দেয়া যে, সাম্রাজ্যের বাইরে যেতে চাইলে তুমিও শত্রুর দলভুক্ত হবা, এবং তোমার কপালেও এই পরিণতি হবে। এর একটা ছোট উদাহরণ হাল আমলে দেখবেন, কানাডিয়ান প্রেসিডেন্ট ট্রুডো তার দেশে খালিস্তান সমর্থকদের এক মাহফিলে হাজির থাকায়, তার ভারত সফরকালে সে যখন মোদির রাজ্যে গেলো সেখানে মোদির সম্ভাষণ পায় নাই। তো এই হলো আমার বক্তব্য। আশা করি কারো কোন দ্বিমত থাকলে জানাবেন। কাশ্মিরের প্রতি তার জনগণের প্রতি আমার সমবেদনা। পাশাপাশি কাম্মিরের স্বাধীনতার জন্য সাধারণ জনগণের দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যেন এটা ভুলে না যাই।