ঘরে বাঘ, বাইরে বেড়াল; এ বাক্যটি ক্রিকেটে বহুল ব্যবহৃত। বিশেষ করে ভারতীয় দলের হাতল বোঝানোর জন্য এটির জিকর হত। সময়ের প্রেক্ষিতে প্রায় সব দলের হালতই এখন একই রকম। যার নমুনা আমরা দেখছি নিউজিল্যান্ডে। ঘরের মাটিতে দুর্দান্ত দাপটে কিউইদের কুপকাত করা বাংলাদেশ দল যেন আদর্শলিপি পাঠ নিচ্ছে নিউজিল্যান্ড সফরে!
আপনি দুটো ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং এর মেরুদণ্ড তামিম এবং মুশফিকের হালত দেখুন। সুইং বোলিংয়ে অনুপম নৃত্যই যেন পরিদর্শন করছেন তামিম। পয়লা ম্যাচে বোল্টের সুইংয়ের বিভ্রান্ত তামিম পরের ম্যাচে যেন রীতিমত সংগ্রামী একটা ইনিংস উপহার দিলেন তিনি। তবে তার সংগ্রাম অঙ্কুরেই বিনাশ করে বেরহম দিলের পরিচয় দিয়েছে ব্লাক ক্যাপস বোলাররা। বাংলাদেশ বিরূপ পরিস্থিতে পড়া মাত্তরই যার দিকে ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে থাকে তিনি হচ্ছেন মুশফিক। চলতি সফরে তিনিই যেন বিভ্রান্ত নাবিক এক। এক ইনিংসে দু’দুবার জীবন পাবার পরেও বিশের ঘর পার করতে পারেননি তিনি!
শোনা যাচ্ছে চলতি সফরে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পয়লা দশ ওভার। স্বাভাবিকভাবে এ সময়টিতে সবগুলো দলই চায় পাওয়ার প্লের সুবিধা কাজে লাগিয়ে রান রেট বাড়িয়ে নিতে, সেখানে বাংলাদেশ চাচ্ছে উইকেটে টিকে থাকতে! এটি এক রকম পশ্চাতমূখিতার পরিচয়ই দেয়। তবে, বাস্তবতা যদি খেয়াল করা হয় তাহলে বলতে হয় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দল বাস্তবের জামিন এ ফিরে এসেছে। কিউই কন্ডিশনে তাদের হারানোর মত অবস্থায় যে আমরা এখনো যেতে পারিনি এটিই তার সাবুদ। বর্তমান সময়ে দশ ওভারে ত্রিশ-চল্লিশ করে ম্যাচ জয়ের খোয়াব কেউ দেখে বলে ইয়াকিন করা কঠিন। সে হিসাবে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ লড়াইটা করছে মূলত সম্মানজনক একটি সংগ্রহের জন্য।
সফরের শুরু থেকেই পরিবেশ আলোচনার একটি অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। তাসমান দ্বীপের হিমেল হাওয়া মনকে রোমান্টিক করে তুললেও ক্রিকেট খেলার জন্য তা কঠিনই বটে। সেটি মাথায় রেখেও বলতে হয়, যতটা হতশ্রী বাংলাদেশকে দেখাচ্ছে পরিবেশ কি আসলেই ততটা বিরূপ? যদি ভোর রাত্রের সাধের ঘুম বাদ দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে টিভি সেটের সামনে বসে বাংলাদেশ দলের কলার প্রদর্শনী দেখে থাকেন তাহলে এরুপ সাওয়াল আপনার মনেও জন্ম নিতে বাধ্য।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, সবুজ পিচে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে সুইংয়ের প্রদর্শনীতে ব্যাটসম্যানদের কসরত করানোর আগেই তো তারা সাজঘরে গিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিচ্ছেন মহাসুখে। লিটনের দিকে দেখুন। বোলারকে খাটাতে যেন তার মায়া হচ্ছে। কয়েকটি বল টুকটাক করে উদারতার অনুপম নজির স্থাপন করে উইকেটটি বিলিয়ে দিয়ে আসছেন। বান্দা সম্ভবত তার গড়-টর খেয়াল করেন না। চলতি সময়ের একজন ওপেনার হিসাবে তার গড় একজন বোলারের কাছাকাছি। সেটি মাথায় রেখে উইকেটে টিকে রান করার চেয়ে তার নজর বলকে সীমানা ছাড়া করার দিকে। সেটি করতে গিয়ে মাঠ ছাড়ছেন দর্শকরা নিজ আসনে জুৎ করে বসার আগেই!
সৌম্যকে নিয়ে যতটা লেখা হয় তার দুয়েকটাও যদি তিনি পরতেন লাজে বোধ করি ঘর থেকে বের হতেন না। উল্টো চিন্তাও মাথায় আসছে। যে বীরদর্পে তিনি বলেছিলেন যে নিজের কোনো সমস্যাই তার চোখে পড়ছে না সেটি ইয়াদে রাখলে বলতে হয়, আরও সহস্র লাইন লিখেও তার বোধে পরিবর্তন আনা যাবে না। দুই ইনিংসে বিশ আর ত্রিশের ঘরে স্কোর করে তিনি যে বর্তে গিয়েছেন তা তো বলাই বাহুল্য। আপনি যদি তার আউট হবার ধরন সামনে এনে কোনো সাওয়াল তুলতে চান, তবে খামোশ থাকার পরামর্শ থাকবে অধমের তরফ থেকে। শূন্যের সাথে প্রণয়ের পরেও যাকে নিয়ে সাওয়াল তোলা দায়, তার বিশোর্ধ্ব দুটি ইনিংসের পর এহেন প্রচেষ্টাতো গুনাহ তূল্য।
চলতি সিরিজে গরীবের আশা ভরসা বলতে একজনই, মিথুন। তিনিও পঞ্চাশের চক্রে ঘুরে মরছেন। সিনিয়রাই যেখানে আদর্শ লিপি নিয়ে বসে পরেছেন সেখানে মিথুন কেন ইনিংস বড় করতে পারছেন না, তা নিয়ে আলোচনা করা আদমির সাথে অন্যায়ই হবে। তিনি বরং আরও একটি পঞ্চাশ করে হলেও ইজ্জতটা বাঁচান সে আর্জিই থাকুক।
ব্যাটসম্যানদের বেতাল অবস্থায় বোলারদের পোয়া বারো। কথার খই মুখে ফুটলেও বল হাতে হতচ্ছাড়া হালত সবার। পিচ ব্যাটিং বান্ধব, স্কোরবোর্ডেও যথেষ্ট রান নেই, সত্য; তাই বলে মহল্লার বোলারদের মত বেদিশা লাইন লেন্থে বোলিং করার তো ব্যাখ্যা নেই। গাপটিল যেভাবে খেলছেন তাতে খোদার দরবারে শুকরিয়া যে নিউজিল্যান্ড এখনো আগে ব্যাট করেনি। করলে দু’শোর আরেকটি ইনিংস দেখতে পাওয়া বোধয় অসম্ভব হতো না।
আমাদের পেস অ্যাটাক নিয়ে আমরা যে আশার জাল বুনতে শুরু করেছিলাম সেটি যে ঠিক হয়নি সেটিও বোঝা যাচ্ছে বেশ। বিপিএল এ বোলারদের সাফল্য দেখে যে বিষয়টি আমরা ভুলে বসেছিলাম তা হলো বেশিভাগ ম্যাচই খেলা হয়েছে ব্যাটসম্যানদের জন্য টি টোয়েন্টির মাইন ফিল্ডে। সেখান থেকে সরাসরি নিখাঁদ ক্রিকেট পিচে নামা মাত্রই উদোম হয়ে দেখা দিচ্ছে বাস্তবতা।
মূল অস্ত্র মোস্তাফিজের এশিয়ায় বোলিং গড় যেখানে মাত্র ১৭.৫০ সেখানে এশিয়ার বাইরের অঞ্চলগুলোর মধ্যে হয়ে যায় ২৮-৩০! নিউজিল্যান্ডের মাটিতে চার ম্যাচ খেলে একবারও দুইয়ের বেশি উইকেট নিতে পারেননি তিনি। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ক্যাপ্টেনের অবস্থা তো আরো করুণ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি মাশরাফি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে যেন বোলিংই ভুলে যান। নয় ম্যাচ শেষে তার শিকার সাকুল্যে পাঁচটি, গড়ও আশি ছুঁই ছুঁই! দলের মূল এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলারের হালতই বলে দেয় ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় তারা বেঁচে গিয়েছেন। নতুবা, তারাও এখনো আদর্শ লিপি শেখার পর্যায়েই রয়েছেন।
প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় রুবেলের নাম, যাকে না খেলানো নিয়ে সমালোচনা চলছে। তিনি থাকলেও যে অবস্থার উন্নতি ঘটতো তা জোডর দিয়ে বলার সুযোগ রেকর্ড দেখলে থাকে না। নিউজিল্যান্ডে খেলা চার ম্যাচে তিনি চার উইকেট নিয়েছেন প্রায় ছাপ্পান্নো গড়ে! মূল তিন বোলারের দিকে তাকিয়েই বলে দেয়া যায় পরিচিত কন্ডিশনের বাইরে গেলেই তারা নখদন্তহীন হয়ে পড়েন।
বিষয়টা হচ্ছে আপনি সাফল্যকে কিভাবে দেখতে চান? সাফল্যের মানদণ্ড যদি হয় শুধু দেশের মাটিতে ভালো করা তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই বেহতার দলে পরিণত হয়েছে। রেকর্ডও তাই বলে। কিন্তু সার্বিকভাবে ভালো দলের খেতাব পাওয়া থেকে বাংলাদেশ যে বহুদুরে এ সিরিজ সেটি ভালো মতই দেখিয়ে দিচ্ছে। হার-জিত খেলারই অংশ কিন্তু তারও ধরণ রয়েছে। যে দলটি ঘরের মাঠে সব দলকেই হারাচ্ছে, সিরিজ জিতে চলেছে তারা যখন বিদেশে গিয়ে প্রতিপক্ষের পাঁচটি উইকেটও ফেলতে পারে না, কিংবা পাওয়ার প্লেতে রান তোলার বদলে উইকেটে টিকে থাকার লড়াইয়ে জি জান লাগিয়ে দেয় তখন বলতেই হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের আসল রূপ বড় রুগ্ন। আমরা এখনো আদর্শ লিপি পাঠই শেষ করতে পারিনি।
বাংলাদেশ এখনই নিউজিল্যান্ডে গিয়ে সিরিজ জিতবে এমন আশা বাস্তববাদী কেউ করে না। কিন্তু ন্যূনতম লড়াই ও করতে পারবে না, এমনটাও গ্রহণযোগ্য না। আপনি তর্ক করতে পারেন, সাফাই গাইতে পারেন, সেটি দিন শেষে কাজে দিবে না। খেলোয়াড়দের বিপক্ষে যে সাক্ষ্য দিচ্ছে পরিসংখ্যানের বোবা সংখ্যাগুলো।